ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চারদিকে হুলস্থুল কাজ

পদ্মায় ৭২ ঘণ্টায় বসেছে দুই পাইল

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৯ এপ্রিল ২০১৬

পদ্মায় ৭২ ঘণ্টায় বসেছে দুই পাইল

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মায় এলাহীকা-! চারদিকে হুলুস্থুল কাজ। সঠিক পরিকল্পনার কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মূল পাইল স্থাপন হচ্ছে এখন। ৭২ ঘণ্টায় ৩৯ নম্বর পিলারে দুটি মূল পাইল ৭০ মিটার করে নদীর তলদেশে স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। আরেকটি পাইল স্থাপনের কাজ চলছে এখন। এভাবেই এখন হরদম পাইল স্থাপন চলবে। তাই আগামী অক্টোবরে দুই হাজার কিলো জুল ক্ষমতার আরও একটি হ্যামার জার্মানি থেকে আনা হচ্ছে। প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইল স্থাপন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, তবে কাজের সুবিধার্থে তিনটি করে পাইল প্রথমে বসবে ৭০ মিটার করে। পরবর্তীতে আরও ৫০ মিটার করে এর ওপর পাইল বসানো হবে। তখনই বাকি তিনটি পাইল স্থাপন হবে। ৩৯ নম্বর পিলারের ১ ও ৬ নম্বর পাইল স্থাপন হয়েছে। এখন ৩ নম্বর পাইলের কাজ চলছে। এটি বসানোর পরই রবিবার থেকে ৩৭ নম্বর পিলারে কাজ শুরু হবে। ৩৮ নম্বর পিলারের কাছে ট্রায়াল পাইলের কাজ চলছে। এই কাজের সুবিধার্থে ৩৮ নম্বর পিলারের কাজ শুরু হবে ৩৭ নম্বরে তিনটি পাইল স্থাপনের পর। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৬ নম্বর পিলারও। তাই পদ্মায় এখন কাজ আর কাজ। মাঝেরচরের কাছে যেতেই চোখে পড়বে বিশাল বিশাল ভারি যন্ত্রপাতির মিলনমেলা। এখানে এত বড় এক কর্মযজ্ঞ চলছে, তা অনেক দূর থেকেই সহজে বোঝা যাবে। শিমুলিয়া ফেরিঘাট নামতেই চোখ যাবে পদ্মায় কর্মব্যস্ত ক্রেন, মাঝে মাঝে পাইল স্থাপনের জন্য তৈরি মঞ্চ আর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং নদী শাসনের জন্য ব্যতিক্রম ড্রেজারসহ জিও ব্যাগ তৈরি ও ফেলার দৃশ্য। কিছু কর্মযজ্ঞ ধু ধু মনে হলেও নৌযানে পার হতে গেলে কাছে আসতেই আরও স্পষ্ট হবে। আর এসব কাজ তদারকির জন্য কিছুক্ষণ পর পরই দেশী-বিদেশী প্রেকৌশরীদের স্পিডবোট ও নৌযান চলাচলের দৃশ্য অহরহ। আর পদ্মায় ও তীরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ইউনিফর্ম পরে নানা দায়িত্ব পালনের দৃশ্যও চোখে পড়বে। কুমারভোগের বিশাল কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেখে যে কেউই বিস্মিত হবেন, যেখানে হরদম পাইল তৈরিসহ সেতুর কাজে ভারি ভারি যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশা। দূর থেকেই এসব শব্দ ও দৃশ্য বোঝা যায়। যেন স্বপ্নের মতো। পদ্মাপাড়ে এমন হুলুস্থুল যজ্ঞ হতে পারে, কয়েক মাস আগেও তা ভাবা যায়নি। ব্যস্ততম শিমুলিয়া ফেরিঘাটে নামতেই চোখে পড়ে এমন সব দৃশ্য। এর পর স্পিডবোট করে পদ্মা পার হওয়ার সময় যত পথ এগোচ্ছে ততই যেন চমক। এককেটার পর একেক কর্ম তৎপরতা চোখে পড়বে। মাঝেরচরের নদী দিয়ে বোট চলতেই চোখে পড়বে নতুন সাব-ইয়ার্ড। মাদারীপুর জেলার শীবচর উপজেলার করলীচরে সাপলিমেন্টারি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড স্থাপনের কাজ চলছে। বর্ষা আসন্ন হওয়ায় ইয়ার্ডটি তৈরির কাজে নতুন গতি পেয়েছে। আর এর পাশেই পদ্মায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে বিশাল বিশাল পাইল। মাঝেরচর এলাকায় মূল সেতুর কাজ চালাতে এই ইয়ার্ডটি প্রয়োজন। বর্ষায় কাজ সচল রাখার জন্য ইয়ার্ডটি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানালেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের। স্পিডবোটের পাশ দিয়েই চলে গেল মাঝিকান্দি। এর আগ পর্যন্ত চোখ ফিরিয়ে নেয়া যায়নি পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ থেকে। এসব দৃশ্য এই অঞ্চলের মানুষের কাজে বেশ নতুন। তাই কৌতূহলের সঙ্গে যাতায়াতের পথে সকলেরই চোখ থাকে নির্মাণ কর্মের দিকে। স্পিডবোটে থাকা শরীয়তপুরের এনামুল ইসলাম বলেন, ‘এতসব যন্ত্রপাতি আর বিরামহীন কাম আছেই। যখন যাই তখনই দেখি নিত্যনতুন দৃশ্য। তবে দিন যত যাইতাছে কাম আরও বাড়তাছে। রাতের বেলায় সেতুর কামের শব্দ পাওয়া যায়।’ স্পিডবোটের চালক রমজান আলী বলেন, ‘কইতে কইতে সেতুর কাজ অনেকখানি আগাইছে। চারদিকে কাজ চলতাছে। পদ্মায় অহন কাজ বেশি। বড় বড় জাহাজ আর ভারি যন্ত্রপাতি আর কহনও দেখি নাই।’ প্রকল্প এলাকায় ঘুরে নানান মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের নানা স্বপ্নের কথা। শরীয়তপুরের শহিদুল ইসলাম জানান, সেতুর কারণে তাদের আর্থসমাজাকি অবস্থানের পরিবর্তন এখনই শুরু হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে শরীয়তপুরের তেমন আর তফাত থাকবে না, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে তার। পুরো এলাকার পরিবেশই পাল্টে গেছে। বৃহস্পতিবার থেকে পদ্মা সেতুর প্যানেল অব এক্সপার্ট প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছে। শুক্রবার সকালে দ্বিতীয় দফা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পর দিনভর সভা করেছে এই বিশেষজ্ঞ দল। দেশের সর্ববৃহত প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ নানা পয়েন্ট উঠেছে দ্বিতীয় দিনেও, যার সমধানে কাজ করছে তারা। শনিবারও পরিদর্শন ও তিন দিনের চূড়ান্ত সভা বসবে। প্যানেল অব এক্সপার্টের চেয়ারম্যান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই প্যানেলে কলম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ডেনমার্কের পাঁচজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই প্যানেলে বাংলাদেশের রয়েছেন ছয়জন। প্রয়োজনীয় পুরো প্যানেলই অংশ নিচ্ছে এই সভায়। সভাটি চলছে জাজিরার সার্ভিস এরিয়া-৩ মিলনায়তনে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাটি পরীক্ষায় গুণগতমান, পাইলের লোড টেস্ট রেজাল্ট, কোন্ পাইল কী পরিমাণ লোড নিতে পারছে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্য দিয়েই পাইল ডিজাইন ফাইনাল করা এবং পুরোদমে কাজ চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া মাওয়া প্রান্তের ৭ ও ৬ নম্বর পিলারে তিনটি করে পাইল স্থাপন করা হয়েছে ৭০ মিটার করে। এর উপরে আরও ৫০ মিটার স্থাপন করতে হবে। তবে নদীর তলদেশের ১২০ মিটার নিচে ৩০ মিটার ভারি কাদার স্তর রয়েছে। তাই এখানে পাইল স্থাপন বসানো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম প্রকল্পটির নানা বিষয় তুলে ধরে জনকণ্ঠকে জানান, বর্ষায় নদী শাসনসহ কিছু কিছু কাজ করা যাবে না। তাই বর্ষার আগেই সেসব কাজ করা হচ্ছে পুরোদমে। তবে বর্ষায় যেসব কাজ করা সম্ভব সেগুলো সচল রাখার সব প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, জাজিরা প্রান্তে ৩৯, ৩৮, ৩৭ ও ৩৬ নম্বর পিলারের কর্মযজ্ঞ চলছে পুরোদমে। এর আশপাশের পিলারগুলোতেও এই মূল পাইল স্থাপনের কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। হ্যামারের ক্ষমতা দুই হাজার ৪শ’ কিলো জুল ক্ষমতার হলেও পাইল স্থাপনে প্রায় এক হাজার কিলো জুল ব্যবহার করতে হচ্ছে। ৩৭ ও ৩৯ নম্বর পিলারের মাঝে চলছে এখন ট্রায়াল পাইলের কাজও। ৩৮ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এই ট্রায়াল পাইলটিতে নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল সবগুলো রিপোর্ট এবং সরেজমিন পরিদর্শনের পরই পাইলের ফাইনাল ডিজাইন দেবে। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অবজারভেশন অনুযায়ী পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে। ধাপে ধাপে কাজের গতি বাড়ানো হচ্ছে। সেতুর নির্মাণকাজের গুরুত্বপূর্ণ সময় চলছে এখন। সেতুটির এই পিলার নির্মাণই হচ্ছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পিলারগুলো যথাযথভাবে নির্মাণ করা সম্ভব হলেই সেতু দাঁড়িয়ে যাবে। তবে বৈচিত্র্যময় পদ্মার তীব্র স্রোত আর পলিকে মোকাবেলা করে সফলভাবে এগিয়ে চলছে সেতুর কাজ। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে ৭ নম্বর পিলারের ৩ নম্বর পাইল স্থাপনের কাজ শুরুর মাধ্যমে প্রাধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মূল কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এই ৭ নম্বর পিলারে তিনটি পাইল এবং ৬ নম্বর পিলারে তিনটি পাইল স্থাপন করা হরছে।
×