ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যেখানে মেলা সেখানেই মাটির পসরা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৯ এপ্রিল ২০১৬

যেখানে মেলা সেখানেই মাটির পসরা

বাংলাদেশ মেলার দেশ। বাঙালী মাত্রই মেলা প্রিয়। আর মেলার সঙ্গে মাটির তৈরি খেলনা ও বড়দের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্রের সম্পর্ক নিবিড়। বলা চলে মাটির জিনিস ছাড়া কোন গ্রামীণ মেলা জমে না। শিশুদের কাছে মেলার প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে মাটির খেলনা। আর এ কারণে মেলা এলে মৃৎশিল্পের কারিগর খ্যাত কুমার সম্প্রদায়ের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। দিন-রাত খেটে রং-বেরঙের বাহারি খেলনা আর শখের হাড়ি-পাতিল বানায় তারা। এরপর মেলার দিন সকাল থেকে সাজায় তাদের পসরা। এ চিত্রটি চেনা যে কোন বাঙালীর। নেত্রকোনাতেও সারা বছর বিভিন্ন ধরনের মেলা হয়। সবচেয়ে বেশি হয় চৈত্র-বৈশাখে। চৈত্রসংক্রান্তি, দোল পূর্ণিমা, অষ্টমী, বারুণী ও নববর্ষ উপলক্ষে নেত্রকোনার প্রতিটি উপজেলাতেই নানা ধরণের মেলা হয়। কারু ও দারু শিল্পের নানা পণ্যের পাশাপাশি মৃৎশিল্পের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য থাকে এসব মেলায়। শিশুদের জন্য পাওয়া যায় মাটির তৈরি ষাঁড়, ঘোড়া, হরিণ, খরগোশ, হাতি, পাখি, পুতুল, পালকি, ঘর, ব্যাংকসহ অনেক কিছু। আবার বড়দের উপযোগী অনেক সামগ্রীও পাওয়া যায় মেলায়। যেমনÑ হাড়ি-পাতিল, সড়া, ঘট, কলসি, ধূপতি, ঠুলি, মূসি, টব, শোপিস প্রভৃতি। তাই ছোট-বড় সবারই ভিড় থাকে মৃৎশিল্পের দোকানে। নেত্রকোনা সদরের আমতলা, বারহাট্টার পালপাড়া, মোহনগঞ্জের বড়ান্তর, খালিয়াজুরির মেন্দিপুর, কলমাকান্দার তেলিগাঁও, শ্যামগঞ্জের মনাটি, মহিষবেড় প্রভৃতি গ্রামে কুমার সম্প্রদায়ের বসবাস। এরা এক সময় সারা বছরই মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। চৈত্র- বৈশাখের মেলাকে সামনে রেখে দু-তিন মাস আগে থেকে চলেছে প্রস্তুতি। দূর-দূরান্তের যেখানেই মেলা বসেÑ সেখানেই দেখা মেলে কুমার পরিবারের নারী-পুরুষের। এখনও এদের কিছু কিছু দেখা মেলে। তবে সংখ্যায় কম। মৃৎশিল্পের কদর এখন আর আগের মতো নেই। বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের আমদানি দিন দিন বাড়ছে। এগুলো দামে সস্তা এবং টেকসই। ফলে এসব পণ্য দখল করে নিচ্ছে মৃৎশিল্পের বাজার। অন্যদিকে শিল্প হিসেবেও মৃৎশিল্প উপেক্ষিত। বলা চলে আজও শিল্প হিসেবে মর্যাদা পায়নি। ব্যাংক ঋণ তো দূরের কথা, এনজিও ঋণও পায় না তারা। নেই শিল্পটির আধুনিকায়নেরও কোন উদ্যোগ। ফলে শিল্পটির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সম্প্রতি কলমাকান্দার খারনৈ ইউনিয়নের চেংনি মেলায় কথা হয় অধির চন্দ্র পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে চৈত্র- বৈশাগের মেলায় বিশ-ত্রিশ হাজার টেহা সহজেই কামাইতে পারতাম। অহন পাঁচ-দশ হাজার টেহা কামানোই কঠিন।’ তিনি জানান, চৈত্র-বৈশাখ ছাড়াও সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের মেলা এবং উৎসব-পার্বণ-কীর্তন প্রভৃতি হতো। সবখানেই মাটির জিনিস বিক্রি হতো। কিন্তু আগের মতো মাটির জিনিসের কদর নেই। উৎপাদন আর পরিবহন খরচ বাদ দিলে খুব একটা লাভ থাকে না। তার মতেÑ বংশ পরম্পরায় করে আসছেন বলেই এখনও নিতান্ত শখে কিছু জিনিস নিয়ে মেলায় আসেন। তার পরিবারের আর কেউ এ পেশায় জড়িত নেই বলে জানান তিনি। তারা কেউ কৃষিকাজ করে। কেউ অন্য পেশায় চলে গেছে। যাদব পাল বলেন, ‘কুমারদের পেশা টিকাইয়া রাখতে অইলে তারারে পুঞ্জিবাট্টা (পুজি) দেওন লাগব। বাজারও চাহিদা বাড়ানি (বাড়ানো) লাগব। বিদেশ থাইক্যা যেমন আমরার দেশে অনেক কিছু আয়েÑ তেমনি আমরার জিনিসও বিদেশে পাডানি (পাঠানো) লাগব। তা অইলে কুমাররা কাজ করত পারব।’ অধির-যাদবদের আক্ষেপÑ এসব নিয়ে ভাবে কে? Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×