ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষির পথ চলা ও মৃৎপাত্রের উদ্ভব হয় নারীর মাধ্যমে

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৯ এপ্রিল ২০১৬

হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প

কুমার বাড়ির সেই চাকা আজ আর তেমন করে ঘোরে না। ওরা নিজেরাই এখন সমস্যার ঘূর্ণিপাকে। মাটির কলসি কাঁখে গাঁয়ের বধূকেও আর দেখা যায় না ঘাটে যেতে। মাটির হাড়ি-পাতিল বাসনকোসন কলসি ঠিলা বদনার ব্যবহারও কমে গেছে। বর্তমানে হাতে গোনা কিছু এলাকার কুমোর অপেক্ষায় থাকে কখন মেলার ডাক আসে। বেশির ভাগই ভর বছর পহেলা বৈশাখের জন্য মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। মেলা বসলে খেলনা হাড়িপাতিল পুতুল ফুলের টব মাটির তৈরি তৈজসপত্র টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে পসরা সাজায় কোন মেলায় গিয়ে। কুমোর নারায়ণ চন্দ্র পাল বললেন, সেই দিনও নেই, মাটির হাড়িপাতিলের কদরও আর নেই। গাঁও গেরামে তাও অন্তত কিছু হাড়ি পাতিল কলসি টিকে আছে। শহুরে জীবনে তো উঠেই গেছে। এ্যালুমিনিয়াম, সিলভার, মেলামাইন, প্লাস্টিক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে মৃৎশিল্পকে। কুমোররা আর টেকে কি করে। একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিটি এলাকায় কুমোরদের দেখা গেছে। উঠান দেখলেই বোঝা গেছে এটা কুমোর বাড়ি। গরুর গাড়ির চাকার মতো দেখতে বিরাট চাকা বসানো হয় মাটি খুঁড়ে প্রায় দুই ফুট নিচে। চাকার মধ্যিখানে থাকে ফরমা। মাটি ভাল করে ছেনে ওই ফর্মার মধ্যে বসিয়ে কয়েক পাক ঘুরিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি হয় মাটির জিনিসপত্র। এরপর শুকানোর পালা। আগুনে পোড়ানো হয়, তার নাম পুইন। এই পুইন সাজানোর প্রক্রিয়াও একটা শিল্প। ফরমা অনুযায়ী মাটির নানা ধরনের জিনিস পুড়িয়ে এনে তার ওপর চলে পালিশ ও রঙের আঁচড়। মাটির জিনিস বানানোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই দিতে হয় শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়া। এ কারণে কুমোর সম্প্রদায় মর্যাদা পেয়েছে শিল্পীর। কাজের প্রতিটি ধাপেই জিনিসপত্র যেভাবে রাখা দরকার সেভাবেই রাখা হয়। কোথাও শুকানো কোথাও রঙের প্রলেপ কোথাও খড় বিছিয়ে বিক্রির জন্য প্রস্তুত। সবই কুমোরদের শিল্পী সত্তা ও ঘূর্ণনের ছন্দ। খড়ির চুলায় মাটির হাড়িতে রান্না ভাত তরকারির স্বাদই আলাদা। মাটির থালার নাম সানকি। এই সানকিতে পান্তা ভাত খাওয়ার কিই যে আনন্দ...। ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে মাটির হাড়ি পাতিল ও তৈজসপত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সভ্যতার ইতিহাস। তার প্রমাণ মিলছে প্রতœতাত্ত্বিক খননে। দেশে দেশে মাটি খুঁড়ে যে প্রাচীন ইতিহাস সামগ্রী বের আসছে, সেখানে মিলছে মৃৎপাত্র ও পোড়া মাটির নানা কিছু। দেশের প্রাচীন নগরী বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ প্রতœ খননে মৃৎপাত্রের যে সব টুকরো ও কখনও তৈজসপত্র মিলছে তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে দেখা যায় মৃৎশিল্পের ইতিহাস সবচেয়ে পুরনো। প্রস্তর যুগ মহেনজোদারো হরোপ্পারও অনেক আগের শিল্প। ইতিহাস বলে কৃষি সভ্যতার উদ্ভবের সঙ্গেই মৃৎপাত্রের আবিষ্কার। কৃষির পথ চলা ও মৃৎপাত্রের উদ্ভব হয় নারীর মাধ্যমে। একদা নারী ফলাত ফসল। নারীই করত রান্না। পুরুষ ঘুরে বেড়াত যাযাবর হয়ে। বন্যপ্রাণী শিকার ছিল তাদের অন্যতম কাজ। নারীর দৃষ্টিতে প্রথমে আসে চারা থেকে শস্য উৎপাদন। পাথরে পাথরে ঘষে আগুনের উৎপত্তি হওয়ার পর তাপ দিয়ে রান্না প্রক্রিয়ায় বাসন বানাতে মাটি পুড়িয়ে শক্ত করা হয়। ফসল উৎপাদন খাবার তৈরি ও সন্তান উৎপাদনে নারীর ভূমিকায় শাসন ক্ষমতাও নিয়ে নেয় নারী। পুরুষ যখন দেখল সভ্যতার সবই নারীর হাতে চলে যাচ্ছে তখন এক যুদ্ধে নারীকে বন্দী করা হয়। সেই থেকে নারী যেমন বন্দী হয়ে আছে নারীর তৈরি মৃৎপাত্র নীলনদ উপত্যকা মালভূমি পাহাড় সাগর ডিঙ্গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। এরই ধারাবাহিকতায় মৃৎশিল্প পৌঁছে যায় এশিয়ায়। এক সময় বাঙালী কুমোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লোকাচার সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে কল্পনা ও ধ্যান ধারণায় শিল্পের নৈপুণ্য আনতে থাকে। এর মধ্যে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) কাজ অন্যতম। এই শিল্পকর্ম ঠাঁই পেতে থাকে প্রাসাদে অট্টালিকায় উঁচু বিহার মঠসহ নানা স্থানে। প্রাচীন নিদর্শনগুলো এখন মেলে ধ্বংস ও চাপা পড়া কোন নগরীত। যা প্রতœসম্পদ। প্রতœ নিদর্শন। কালের বিবর্তনে কুমোর সম্প্রদায় একটা পর্যায়ে এসে পরিণত হলো শুধু মৃৎশিল্পের বাসন কোসনের ও খেলনা পুতুলের কারিগর। হাড়ি পাতিল বাসনকোসনের আড়ালে হারিয়ে গেল শিল্পকর্ম, যা দিয়ে রচিত হয় ইতিহাস। সেই কুমোররা এখন কেমন আছে? ঢাকার ধামরাইয়ের কুমোরদের কারুকাজ ও নৈপুণ্য যে কতটা ছিল, তা আজও টের পাওয়া যায় তাদের শিল্পকর্মে। ড্রইংরুমে সোফার পাশে রাখার বিশাল ফুলদানি, মাটির বড় শোপিসগুলোর চোখ ধাঁধানো কারুকাজ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের পূর্বপুরুষরা কত বড় মাপের শিল্পী ছিল। ধামরাইয়ের কুমোররা পসরা সাজিয়ে বসে মহাসড়কের ধারে। দূর-দূরান্তে কোথাও মেলার খবর শুনলেই পণ্য নিয়ে ছুটে যায় সেখানে। ধামরাই ছাড়াও চট্টগ্রামের পটিয়া নোয়াখালী পটুয়াখালী বগুড়া মাগুরা কুষ্টিয়া রাজশাহী যশোর খুলনা রংপুরের কুমোরদেরও ছিল খ্যাতি। এই কুমোররা তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাংক ঋণ পায় না। এক তথ্যে জানা যায় ভারতের তদানীন্তন রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব কুমোরদের বাঁচাতে ভারতের প্রতিটি রেলস্টেশনে চায়ের দোকানে ওয়ানটাইম মাটির পেয়ালায় চা পানের প্রচলন করেছিলেন। এরপর কুমোরদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশে কুমোর সম্প্রদায়কে পেট্রোনাইজ করা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×