ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

বিএনপিকে স্বাধীনতার পক্ষের দল বলা যাবে কি?

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৯ এপ্রিল ২০১৬

বিএনপিকে স্বাধীনতার পক্ষের দল বলা যাবে কি?

যে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাসের মাইলফলক দিবসগুলো পালন করে না, সে দলকে কি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের দল বলা যায়? বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এপ্রিল মাসের গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। বরং ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে যে যে দিবস চিহ্নিত হয়ে আছে, যেমন ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি (ছাত্রলীগের জন্মদিন); ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন (আওয়ামী লীগের জন্মদিন); ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার দিন); ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাভিত্তিক নির্বাচন; ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি (বাঙালীর মেগনা কার্টা ৬ দফা পেশের দিন); ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ২২ ফেব্রুয়ারি (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি); ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণ); একাত্তরের ২৩ মার্চ (স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলন); এই মাসেরই ২৬ মার্চ (বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা); ১৬ ডিসেম্বর (আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, যে যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ ও ৫ লক্ষাধিক নারী ধর্ষিত এবং তাদের অনেককে হত্যা) প্রভৃতি দিবসের পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ১০ ও ১৭ এপ্রিল দিবস দুটিও গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে। ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অর্থাৎ কুষ্টিয়ার মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিগণ স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ইশতেহার প্রণয়ন এবং মুজিবনগর সরকার গঠন করেন, যা মুজিবনগর সরকার নামে ইতিহাসে স্বীকৃত। প্রবাসী বিপ্লবী সরকারে রাষ্ট্রপতি এবং সুপ্রীম কমান্ডার অব আর্ম ফোর্সেস বা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং যেহেতু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইয়াহিয়ার হানাদার পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে নিয়ে যায়, সেহেতু তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে তাঁর নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়, যা মুজিবনগর বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। রাষ্ট্রপতিসহ এই সরকারের সবাই ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বিপ্লবী সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ইশতেহার পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রমের নেতৃত্বে একটি চৌকস সশস্ত্র দল সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। স্বাধীনতার ইশতেহার বলা হয় : ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ৭১-এর ১৭ জানুয়ারি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যাতে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত করে। কিন্তু ইয়াহিয়ার মিলিটারি জান্তা ’৭১-এর ৩ মার্চ আহূত পার্লামেন্টের অধিবেশন বাতিল করে দেয় এবং যেহেতু হুমকি দেয় যে, ‘মুজিব বিশ্বাসঘাতক, এবার তাকে শাস্তি পেতেই হবে’ (গঁলরন রং ধ ঃৎধরষড়ৎ, ঃযরং ঃরসব যব রিষষ হড়ঃ মড় ঁহঢ়ঁহরংযবফ) এবং যেহেতু ইয়াহিয়া গোষ্ঠীই বিশ্বাস ভঙ্গ করে একটি অন্যায়-অনৈতিক যুদ্ধ শুরু করে (চাপিয়ে দেয়), সেহেতু বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার একটি যথোচিত ঘোষণা দেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখ-তা রক্ষায় সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন, যার দিকনির্দেশনা তিনি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে দিয়েছিলেন। ইশতেহারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গণপরিষদ গঠন করে এই ঘোষণা প্রদান করে যে, “বাংলাদেশ হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র এবং ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণাকে নিশ্চিত করছে... এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করিতেছে... (গণপরিষদ এই ঘোষণাও প্রদান করে) স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে।” কিন্তু ’৭১-এর ৯ মাসের এত বড় একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৪৬ বছর চলছে। এই বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করছেন তাদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই ১০ ও ১৭ এপ্রিল উদযাপন করে যথাযথ মর্যাদায় ও সম্মানের সঙ্গে। কিছু পত্র-পত্রিকা, টিভি নিবন্ধ আলোচনা ও প্রচার করে। কিছু কালচারাল সংগঠন কর্মসূচী গ্রহণ করে। এ যেন কেবল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের একারই দায়। আমি অবশ্য মনে করি আওয়ামী লীগেরই দায়। আর আছেইবা কে? জাসদ, বাসদ খ--বিখ- হতে হতে অস্তিত্ব সঙ্কটে। সিপিবিসহ বাম সংগঠনগুলোর নীতি, আদর্শ, রাজনীতি যে কি এবং কেন বোঝা দায়! সবচে’ অবাক ব্যাপার হলো বিএনপি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল বলে দাবি করে, অথচ আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মাইলফলক দিবসগুলো উদযাপন করে না। একুশে ফেব্রুয়ারি বা স্বাধীনতা দিবস-এ কর্মসূচী দিলেও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। আসলে মিথ্যা বলা ছাড়া তাদের দ্বিতীয় পুঁজি নেই। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত এই দীর্ঘ রক্তাক্ত পথপরিক্রমায় তাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিষ্ঠাতা বেচারা জিয়ার কোন অবদান বা অংশগ্রহণ নেই। এমনকি স্বাধীনতার এই ৪৬ বছরে কিছু শেখেওনি দলটি। শিখবে কি করে? জিয়া নিজে মুক্তিযোদ্ধা হলেও একাত্তরের রাজাকার মুসলিম লীগ-জামায়াত নিয়ে তার বিএনপি গঠন করে রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী রাজাকার আবদুল মান্নান বা মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী আবদুল আলিমকে জিয়াই তো মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া তো একেবারে হানাদার পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের সহযোগী জামায়াতের মঞ্চে উঠে বসে আছেন। তার পুত্র তারেক তো বলেই বসলেন- ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির একই মায়ের পেটের দুই ভাই (সহোদর)। আজও তাদের বোধোদয় হয়নি। পাকি-জান্তা আইয়ুবের করজোড়-ভিসি ড. এম এ গনির পুত্র ড. ওসমান ফারুকের লোকরাই এখনও খালেদা জিয়ার নীতিনির্ধারক। এবার যাকে ভারমুক্ত করে মহাসচিব বানালেন তিনিও একাত্তরের রাজার চখা মিয়ার পুত্র। খালেদা জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধাও দলে খুঁজে পেলেন না যাকে মহাসচিব বানানো যায়। বস্তুত তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। তাই তো পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরে তাকে বলতে শোনা যায়। পাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘একাত্তরে পাকি মিলিটারি বাংলাদেশে গণহত্যা করেনি, নারী নির্যাতন করেনি, কোন অপরাধ করেনি।’ তার পরপরই খালেদা জিয়া শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তোলেন চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে। তাই বিএনপিকে কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যাবে না। বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলোতে দেখলাম দেশের মঞ্চ টিভি নাটক ও টেলিফিল্মের সুঅভিনেত্রী বিপাশা হায়াত তার অভিনয় জীবন সম্পর্কে বলছেন, ‘রাজনীতিবিদদের দেখে অভিনয় শিখি।’ বিপাশা হায়াত অভিনয়ের পাশাপাশি একজন সফল নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, তারচেয়েও বড় কথা তিনি একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। তার বেশি লোকের অভিনয় দেখার দরকার নেই। বিএনপি’র ভারমুক্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দিকে তাকালে অভিনয়ের অনেক কৌশল আয়ত্ত করতে পারবেন। নাটক লিখতে বসেও খালেদা জিয়া আর মীর্জা ফখরুলের বক্তৃতাগুলো ফলো করতে পারেন। কিভাবে গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করে জজ মিয়া নাটক সাজানো যায়, কিভাবে পেট্রোলবোমা মেরে জ্বালিয়ে মানুষ হত্যা করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো যায়, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও বা স্বামী জিয়া ও বিচারপতি সাত্তারের দীর্ঘ শাসনামলে উন্নয়নের একটি চিহ্ন না দেখাতে পারলেও কিভাবে বক্তৃতায় বলা যায়, ‘আওয়ামী লীগ কোন উন্নয়ন করেনি, যত উন্নয়ন হয়েছে সব বিএনপি সরকারের আমলে?’ বিপাশা হায়াত, আপনি ইচ্ছে করলে ওদের বক্তৃতা থেকে অনেক জনপ্রিয় সংলাপ রচনা করতে পারবেন। ঢাকা : ৮ এপ্রিল ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব
×