ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মজিবর রহমান

নির্বাচন নিয়ে অগ্নিগর্ভ ফুটবল

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৮ এপ্রিল ২০১৬

নির্বাচন নিয়ে অগ্নিগর্ভ ফুটবল

নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তীব্র হয়ে উঠছে ‘বাঁচাও ফুটবল’ আন্দোলন। কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটির প্রতি অনাস্থা, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) নতুন কমিটি দেখতে চায় আন্দোলনকারীরা। খেলা চলছে দুইদিকে, একদিকে স্বাধীনতা কাপ দিয়ে শুরু হয়েছে ঘরোয়া ফুটবল। অন্যদিকে খেলা চলছে সালাউদ্দিন হটাও দাবির মধ্যে দিয়ে। সভা, সমাবেশ তো আছেই। পাশাপাশি মাঠের খেলা চলে এসেছে টেবিলে, আদালতে। সর্বশেষ তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি প্রমাণ করছে দেশের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এখন ‘অগ্নিগর্ভ’। যদিও এসব ঘটনা আমলে নিচ্ছেন না বাফুফে বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। আলাপে তিনি বললেন, দেখি না ওরা কোন পর্যন্ত যায়। আমি এখন ঘুড়ি উড়াচ্ছি, ঘুড়ি আকাশে উড়াতে নটাই থেকে সুতা ছাড়তে হয়। আমি তাই করছি। যখন নাটাইয়ে সুতা টান দেব ঘুড়ি সুড়সুড় করে আবার মাটিতে নেমে পড়বে। তবে এখনই টান দিতে চাই না। আরও একটু দেখতে চাই। আমি জবাবটা দিতে চাই ৩০ এপ্রিল বাফুফে নির্বাচনের পর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ আর দশটা ফেডারেশনের সঙ্গে বাফুফের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফুটবল বাদে বোর্ড/ফেডারেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সরকারের তত্ত্বাবধানে। এক কথায় পুরোপুরি সরকারী প্রভাবে। কিন্তু ফুটবলে সে সুযোগ নেই। বাফুফে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফার অধীনে। খোদ ফিফা প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে। সরকারের প্রভাব খাটানোর কোন সুযোগ নেই। সরকারী হস্তক্ষেপ মানেই বিশ্ব ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন, অবধারিত নিষিদ্ধ হওয়া। এর মাসুল বাংলাদেশ একবার দিয়েছেও। কাজেই সংশ্লিষ্ট সবাই জানে, ফিফা আইন কত কঠোর। বিষয়টা ভালভাবেই জানেন বর্তমান সভাপতি সালাউদ্দিনসহ নির্বাহী কমিটির সব কর্মকর্তারা। তারপরও সালাউদ্দিন তার কথায় প্রমাণ করলেন, ভেসে আসেননি তিনি। যদিও ফিফার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ-যেভাবেই হোক, পর্দার অন্তরালে সরকারের বড় ধরনের প্রভাব কাজ করে। অতিত ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। ২০০৮ সালে প্রথম দফায় কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচিত হয়েছিলেন তার খেলোয়াড়ি জীবনের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে। দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরও দুই খ্যাতিমান সংগঠক, ফুটবলার। তারা হলেনÑ সাবেক সংসদ সদস্য, ফুটবল সংগঠক আব্দুর রহীম ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। পরবর্তীতে দু’জনেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় সালাউদ্দিন। সঙ্গত কারণে বলা যায়, যতই ফিফার তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হোক। সরকারের একটা প্রভাব যে থাকবে এবারও তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ রহীম ও পিন্টু প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন চাপের মুখে। তবে নিশ্চয়ই সরকারের গ্রীন সিগন্যাল সালাউদ্দিনের পক্ষে। আর এ কারণে তার মনের জোরটাও প্রবল। যদিও বিষয়টা প্রমাণ হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। কারণ ইতোমধ্যে দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে নির্বাচন। ফুটবল বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে যাদের হাত তারাও বেশ ক্ষমতাধর। সবচেয়ে বড় কথা তারাও ক্ষমতাসীন সরকারের লোক, খুব কাছের মানুষ। গণেশ উল্টে দেয়ার ক্ষমতা তারাও রাখেন বলেই সম্ভবত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন সালাউদ্দিন তথা বাফুফের বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে। বীরদর্পেই এগোচ্ছেন তারা। ‘ফুটবল বাঁচাও’ আন্দোলনের মূল হোতা শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের সভাপতি মনজুর কাদের। তারা নেতৃত্বে চলছে ‘সালাউদ্দিন হটাও’ আন্দোলন। তার সঙ্গে রয়েছেন দেশবরেণ্য ক্রীড়া সংগঠক ও শেখ মোহাম্মদ আসলামসহ একঝাঁক সাবেক তারকা ফুটবলার। এই ব্যানারে নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে বলে জানা গেছে। স্বাভাবিক কারণে ধরে নেয়া যায়, এবার খালি মাঠে গোল করার সুযোগ সালাউদ্দিন পাবেন কি না সন্দেহ। পরিস্থিতি প্রমাণ করছে নির্বাচন হবে দুই প্যানেলে। একদিকের নেতৃত্বে সালাউদ্দিন। আরেকদিকে মনজুর কাদের। যদিও মনজুর কাদের নিজে নির্বাচন করবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাফুফেতে নতুন কমিটি বসাতে ইস্পাত-কঠিন সংকল্প তার। মনজুর কাদের বলেন, সালাউদ্দিন-সালাম মুর্শেদী (বর্তমান কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি) নির্বাচনে দাঁড়ানো দূরের কথা, পালাবার পথ পাবে না। তাদের সীমাহীন, দুর্নীতি, লুটপাটের ঘটনা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এসব লুটপাটকারীদের সরাতে না পারলে ফুটবল বাঁচবে না। বিগত সাত/আট বছরে ফুটবলের অপূরণীয় ক্ষতি আর দুর্নীতি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি এই কমিটি। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের রুগ্ন চেহারা জলন্ত প্রমাণ। এ অভিযোগর বিপরীতে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, গত মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাফুফের বিশেষ সাধারণ সভার এক মাস আগে প্রত্যেক ক্লাব, ফুটবলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দেয়া হয়। এতে বাফুফের বিগত চার বছরের আয়-ব্যয়ের অডিড রিপোর্ট, ব্যাংক স্টেটম্যান্টেসহ সবার কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ ছিল এ বিষয়ে কারও কোন আপত্তি থাকলে তা জানাতে। এ নিয়ে আমরা ইজিএমএ আলোচনা করব। কিন্তু ১৩০ চিঠির বিপরীতে কেউ কিছু জানায়নি। ইজিএমএ সালাম বাজেট পড়ে শোনানোর পর উপস্থিত ১১২ জনের কেউ আপত্তি না করে, এক মিনিটের মধ্যেই বলে দেন, পাস, পাস, পাস। সালাউদ্দিন বলেন, আমার প্রশ্ন, এখন কেন দুর্নীতি নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে। তখন তারা কোথায় ছিলেন। অতি বিপ্লবী হয়ে যাওয়া শেখ জামাল ধানম-ির সভাপতির কাছেও তো ওই চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কই তখন তো তিনি আপত্তি দূরের কথা কোন কথাও বলেননি। আমি পরিষ্কার বলতে চাই ‘বাঁচাও ফুটবল’ ব্যানারে যা করা হচ্ছে এর কোন ভিত্তি নেই। আসন্ন নির্বাচন কলুষিত করতেই তাদের এই অপপ্রায়াস। জোর দিয়েই মনজুর কাদের বলেন, আমরা প্যানেল তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি কমিটি আমরা উপহার দিতে চাই ফুটবলে। এখন কার কমিটি, কোন প্যানেলে টিকে সেটাই দেখার। ঘটনা যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছে, সেহেতু একটা গ্রহণযোগ্য ফয়সালা নিশ্চয়ই দেখা যাবে। দুইপক্ষই প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের বিধায়, দুইপক্ষকে সামনা সামনি বসিয়ে মিটমাটের সম্ভবনাই বেশি বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কারণ ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী কোন পক্ষকেই পাশ কাটিয়ে এক তরফা সিদ্ধান্ত দেবেন বলে মনে হয় না। ফলে সমঝোতার পথটাই প্রশস্ত হয়েছে বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী অবগত হওয়ায়। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে গত পরশু আলোচনায় বসেছিলেন’ বাঁচাও ফুটবল’ কমিটির কর্তারা। কি কারণে বাফুফেতে নতুন কমিটি বসানো জরুরী তা জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। আর তা বিসিবি সভাপতির মাধ্যমে। এ তথ্য জানান মনজুর কাদের। উল্লেখ্য, সালাউদ্দিন-মনজুর কাদেরকে বলা হতো এক প্লেটে ভাত খাওয়া লোক। বাল্যবন্ধু হিসেবে দু’জনের সঙ্গে, তুই-তাই সম্পর্ক। যুগের এই মধুর সম্পর্ক হঠাৎ ভেঙ্গে গেল কেন? প্রথমত দু’জনের সম্পর্কে ফাটল ধরে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘ট্রেবল’ জয়ী শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবকে খেলার সুযোগ না দেয়া। যদিও এ প্রসঙ্গে কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, টুর্নামেন্টের আয়োজক চট্টগ্রাম আবাহনী আমন্ত্রণ জানায়নি শেখ জামালকে। এখানে আমার করার কিছু নেই। আমার পক্ষ থেকে আয়োজকদের হাতে-পায়ে ধরা বাকি ছিল শেখ জামালকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু কি কারণে তারা করেনি বলতে পারব না। কিন্তু সালাউদ্দিনের এই কথা মানতে রাজি নন শেখ জামালের মনজুর কাদের। তার কথায়, টুর্নামেন্ট যারাই আয়োজন করুক বাফুফের অনুমোদন নিয়েই করেছে। ফলে এই দায় সালাউদ্দিন এড়াতে পারেন না। এটা শেখ জামালের বিরুদ্ধ শুধু অবজ্ঞা নয় ষড়যন্ত্রও বটে। পরবর্তী ঘটনা হচ্ছে, বাফুফে ভবন থেকে শেখ জামালের আট ফুটবলারকে অন্য ক্লাব তুলে নেয়া। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ খেলার জন্য শেখ জামালের আট খেলোয়াড়কে বাফুফে নিয়েছিল জাতীয় দল গঠনে চিঠি দিয়ে। গোল্ডকাপ থেকে বাংলাদেশ দল বিদায় নেয়ার পর সেই আট ফুটবলার ফেরত পায়নি শেখ জামাল। অগ্রিম অর্থ প্রদানের মাধ্যমে যাদের সবার সঙ্গে চুক্তি ছিল চলতি মৌসুমের জন্য। হোটেল থেকে ফুটবলারদের বাফুফে ভবনে আনার পর ঢাকা আবাহনী, চট্টগ্রাম আবাহনী ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র নিয়ে যায় আট ফুটবলারকে। একে শেখ জামালের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে মনজুর কাদের দায়ী করেন বাফুফেকে। যার দায় বর্তায় সালাউদ্দিনের ওপরও। পরবর্তীতে আইনের দ্বারস্থ হয় শেখ জামাল ক্লাব। উচ্চ আদালতে বাফুফের আপীলের বিরুদ্ধে তিনবার রায় শেখ জামালের পক্ষে আসে। আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে আট ফুটবলার চলমান স্বাধীনতা কাপ ফুটবলে দর্শক। এ বিষয়ে মনজুর কাদের বলেন, আদালতের রায় আমাদের পক্ষে। কাজেই আট ফুটবলারকে খেলতে হলে শেখ জামালের জার্সিই গায়ে জড়াতে হবে।
×