ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশখালীতে থেমে নেই জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৮ এপ্রিল ২০১৬

বাঁশখালীতে থেমে নেই জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতি

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে বাঁশখালীর গন্ডামারায় ৬৬০ মেগাওয়াট করে কয়লাভিত্তিক পৃথক দুটি অর্থাৎ মোট ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে উদ্যোক্তাগোষ্ঠী জয়েন্ট ভেঞ্চারের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। দেশী-বিদেশী বেসরকারী তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে এ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মিত হবে। এর মালিকানায় রয়েছে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, চীনের সেফকো থ্রি ও এইচটিজি চায়না নামে অপর দুটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার জের ধরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা ইউনিয়নে প্রায় দুই বছর আগে ৬শ’ একর জমি ক্রয় করে মালিকদের জমির মূল্য পরিশোধ করেছে। পরবর্তীতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সরকারী যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উদ্যোক্তারা এর কাজে হাত দেয়। এলাকার সরকারী-বেসরকারী পর্যায় এবং রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই এমন একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে স্বাগতই জানানো হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে গত শনিবার এবং সোমবার এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের একটি অংশকে মাঠে নামিয়ে পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটল, যা ছিল উদ্যোক্তাগোষ্ঠীসহ প্রশাসনের কাছে রীতিমতো বজ্রাঘাত সমতুল্য। কারণ এমন হওয়ার কথা ছিল না। অথচ হয়েছে। কেন হলো, কারা করল, কেন করল- এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা, গুজব সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ঘটনার পর জামায়াত-বিএনপির পক্ষে ঘটনার প্রতিবাদে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা চলে। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, নিহতদের জানাজায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যোগ দিয়ে এই বলে ঘোষণা দেন যে, তিনি চেয়ারপার্সনের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। বিষয়টি সচেতন মহলকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়েছে। একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এ ধরনের অপতৎপরতা বাঁশখালীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, হরতালসহ বিরোধী কোন কর্মসূচী তেমন গতি পায়নি। এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জনকণ্ঠকে তিনি স্পষ্টভাবে জানান, ‘আমরা শীঘ্রই প্রকল্প এলাকায় পুনরায় কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। জয়েন্ট ভেঞ্চারে অর্থ যোগানদানকারী চীনের অপর দুটি প্রতিষ্ঠানও বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে অটল অবস্থানে রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, উদ্যোক্তাগোষ্ঠী চাইলে এ বিদ্যুত কেন্দ্র অন্যত্র স্থাপনের বিষয়ে সরকার সহযোগিতা দেবে। এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে ন্যায্য অর্থ পরিশোধে ৬শ’ একর জমি ক্রয় করে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নিয়ে এতটুকু এগোনোর পর অন্যত্র নতুনভাবে এ ধরনের প্রকল্প স্থাপনের কোন চিন্তা তাদের নেই। উদ্যোক্তাদের একাধিক সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে, এলাকার বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী ও জামায়াতের বেশ কয়েক নেতার ইন্ধনে স্থানীয় নিরীহ লোকজনকে ভুল বুঝিয়ে ব্যাপকভাবে উত্তেজিত করে এ ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছে। বিএনপির যে লেয়াকত আলী নিরীহ জনসাধারণকে উত্তেজিত করতে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন, তিনি নিজে জমি কেনার সময় দালালী হিসেবে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা পকেটে পুরেছেন। উদ্যোক্তাদের মতে, সাধারণ মানুষকে মাঠে নামিয়ে এসব সুবিধাভোগী আরও অধিক হারে অর্থ হাতানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু যে জমিতে এ প্রকল্প গড়ে উঠবে তা কোন লিজ বা অধিগ্রহণকৃত নয়। উদ্যোক্তাদের নিজস্ব অর্থে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে জমির মালিকদের ইচ্ছায় একে একে উপরোক্ত পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে এদের কোন বিরোধিতা নেই। তবে সাধারণ মানুষকে পরিবেশ দূষণের অজুহাত তুলে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে। ভিটেবাড়ি ছাড়া হবে এমন যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা অবান্তর। কেননা, জমি যেহেতু ওই প্রকল্পের জন্য বিক্রি করা হয়েছে সেক্ষেত্রে সেখানে ভিটাবাড়ি বা অন্য কোন ব্যক্তিগত স্থাপনা থাকার প্রশ্নই থাকে না। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে আজ শুক্রবার সংশ্লিষ্ট সকল জমির মালিককে ডেকে সমাবেশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলাকায় তাদের জমি নিয়ে বিরোধ বা ন্যায্যমূল্য না পাওয়াসহ যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ জানান, আমরা সামগ্রিকভাবে আবার ব্যক্তিগত পর্যায়েও কথা বলেছি। যারা জমি বিক্রি করেছে তাদের কোন আপত্তি নেই। আপত্তি যারা তুলেছে তারা সুযোগসন্ধানী এবং দালাল ও টাউট শ্রেণীর। এরা সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উত্তেজিত করে এমন একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। তবে এরা বর্তমানে ভুল বুঝতে পারছে বলে তাদের ধারণা। তাই তাদের পক্ষ থেকে খুব শীঘ্রই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, বেসরকারী পর্যায়ে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরুতে বেশ উচ্ছ্বাসই ছিল। কেননা, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর সঙ্গে উন্নয়ন সাধিত হবে সড়ক যোগাযোগসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে। তাছাড়া শিল্পায়নের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয় সমুদ্রতীরবর্তী এই উপজেলায়। বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য মাটি ভরাটকাজ অতিসম্প্রতি শুরু হলেও এই স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সম্পাদিত হয় প্রায় দুই বছর আগে। মূলত তখন থেকেই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি চলতে থাকে। শুরু হয়ে যায় জমি কেনার কাজ। সুতরাং বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্যই যে এস আলম গ্রুপ জায়গা কিনছে তা এলাকাবাসী জানত না এমন অভিযোগ অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু হঠাৎ করে কেনইবা এলাকার লোকজন এভাবে ফুঁসে উঠল তা নিয়ে রয়েছে নানা বিশ্লেষণ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি করে বলে বিশেষজ্ঞদের মত রয়েছে। কারণ, এর ফ্লাইএ্যাশ ও সালফার উন্মুক্ত বাতাসে ছড়াতে দিলে তা জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু এই ক্ষুব্ধ পরিস্থিতির নেপথ্যে প্রধানত যে গোষ্ঠী দায়ী বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তা হলোÑ কিছু মধ্যস্বত্বভোগী, স্থানীয় পর্যায়ের টাউট-বাটপার এবং জামায়াত-বিএনপির ইন্ধন। বাঁশখালী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার রহমাননগর আবাসিক এলাকার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০১২ সাল থেকেই বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারায় পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তৎকালীন এমপি বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের নিয়ে গন্ডামারা এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি বাঁশখালীতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করেন এই শিল্প গ্রুপকে। শুধু তাই নয়, সেখানে জমি কিনতে উদ্বুদ্ধ করেন। বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় ভূমি ক্রয়ের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সাল থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে থাকে। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নিজস্ব লোক দিয়ে এস আলম গ্রুপ জায়গা কিনতে উদ্যোগী হয়। বাঁশখালীর সংসদ সদস্য বলেন, কর্মসংস্থান ও দেশের উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে আমিও সহযোগিতা দিই। তবে এ প্রকল্পের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাঁশখালীতে বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, এলাকার কিছু লোক এ নিয়ে রাজনীতি করছে। অনেকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে লিপ্ত হয়েছে। তারা জনগণকে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে এবং গুজব ছড়িয়ে উত্তেজিত করেছে। কিন্তু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, পরিবেশের দিকটি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য এর জন্য ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক বিএনপি নেতা লেয়াকত আলীকে দায়ী করেন। তিনি নিহত চারজনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ও আহতদের এক লাখ টাকা হারে চিকিৎসা সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়া প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়কারী বাহাদুর আলম হিরণ নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোকে মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদানের কথা জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর। উল্লেখ্য, শুরুতে উদ্যোক্তাগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ বাঁশখালীতে জায়গা কেনার জন্য নিয়োগ করে কিছু এজেন্ট। একসঙ্গে অনেক জায়গা কেনা হচ্ছে বিধায় তাদের সঙ্গে যোগ হয় সাব-এজেন্ট, উপ-এজেন্টসহ সেখানে সৃষ্টি হয় কয়েক শ’ জমির দালাল। এ জমির দালালরা একদা খুবই দরিদ্র এবং অতিসাধারণ থাকলেও রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ হন গাড়ি-বাড়ির মালিক। এলাকায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও অনেক বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, তাদের চলাফেরা এবং আচরণ এলাকার মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। জমি বেচাকেনার দালালরা প্রভাবশালী হয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া এস আলম গ্রুপ অনেক বেশি মূল্য পরিশোধ করেছে বলে দাবি করলেও তাতে মোটা অঙ্কের লাভবান হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এ বিষয়গুলোও জমি বিক্রি করা মানুষগুলোর মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাঁশখালীতে উন্নয়নকাজ শুরু হওয়ায় হু হু করে বেড়ে যায় জমির মূল্য। এতে স্বল্পমূল্যে জমি হাতছাড়া করা পরিবারগুলোর মনের বেদনা বাড়ছে, যা অনেকটাই স্বাভাবিক। এলাকাটি দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষ অধ্যুষিত। ফলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারি টাউট-বাটপার ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য বেশ সুবিধা। মাটি ভরাটকাজ শুরু করতে প্রকল্প এলাকায় স্কেভেটর ও যন্ত্রপাতি নেয়ার পর এলাকার টাউটরা আরও চাঁদা দাবি করে। না পেয়ে তারা নানাভাবে উস্কাতে শুরু করে এলাকাবাসীকে। অপরদিকে, একটি পক্ষ দাঁড়ায় বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র তথা উন্নয়নের পক্ষে। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চেষ্টায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে গত ৪ এপ্রিল সোমবার ঝরে পড়ে চার তাজা প্রাণ, যাদের পরিবারই জানায় যে, প্রকল্প এলাকায় তাদের মালিকানার কোন জমি নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কেন্দ্র করে বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের মুজিবের টিলা এলাকায় যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটি ঘটে গেল তাতে এ প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এর রেশ ধরে দেশে আরও যে কয়েকটি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে সেগুলো নিয়েও কিছুটা শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারের এ ধরনের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এমন লঙ্কাকা-ের পর বাঁশখালীর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উন্নয়ন প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত সফল হবে কি-না তা নিয়েও অনেকের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এমনই এক প্রশ্নের জবাবে বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের জন্য কি উন্নয়ন কাজ বন্ধ থাকবে?’ এস আলম গ্রুপ দাবি করেছে, যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারের পরিবেশ বিভাগকে সবকিছু নিশ্চিত করে ছাড়পত্র গ্রহণের মাধ্যমে কাজ শুরু হবে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। বর্তমান যুগে ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে রাখার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। উদ্যোক্তা এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বাঁশখালীতে ঘটে যাওয়া এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্য আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতা লেয়াকত আলীকে দায়ী করা হয়। তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে গত বুধবার রাতে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য এলাকায় জনমত গঠনের প্রয়োজন হয়। সকলকে সমন্বিত করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। সংগঠনটির চট্টগ্রাম শাখার আহ্বায়ক আবুল মোমেন ও সদস্য সচিব প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার স্বাক্ষরিত এ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রক্রিয়া শুরুর পূর্বে উচিত ছিল বিনিয়োগকারী, প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করা। নেতৃবৃন্দ পরিবেশ ও জনগণের ওপর প্রভাবসহ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন প্রস্তুতের আহ্বান জানান। এদিকে, ৬শ’ একর জমি এস আলম গ্রুপের নিজের কেনা নাকি অধিগ্রহণ করা জমিতেই প্রকল্পটি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। কোন কোন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয় যে, ভূমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে ঘটেছে এ সংঘর্ষ। কিন্তু এস আলম গ্রুপ বলছে, তারা ব্যক্তিপর্যায়ে উচিত মূল্য পরিশোধ করে কেনা নিজের জমিতেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ কালেক্টর রুহুল আমিন এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার বাঁশখালীতে কোন ভূমি অধিগ্রহণ করেনি। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান নিজের কেনা জমিতে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিজের কেনা জমির বাইরে কিছু খাস জায়গাও উদ্যোক্তারা দখলে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ওই সকল জায়গায় চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষ হয়ে থাকে। তাছাড়া সমুদ্রতীরবর্তী বিশাল এলাকা ওই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে মৎস্য আহরণকারীদের জীবিকার ওপর আঘাত আসবে। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে অন্যতম উদ্যোক্তা এস আলম গ্রুপ। বাঁশখালীতে আলোচিত এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি রয়েছে বলে অভিযোগ বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের পক্ষের লোকজনের। এ এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত। ’৭৫-এর পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সুলতানুল কবির চৌধুরী এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ছাড়া পুরো সময়ে ছিল বিএনপির সংসদ সদস্য। বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেশ শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করেছে জামায়াতে ইসলামী। বর্তমানে এ উপজেলায় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের হলেও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জামায়াত নেতা। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা বদরুল হকও জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়া বেগমও জামায়াত সমর্থিত। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানদের অধিকাংশই জামায়াতের। যে গন্ডামারা ইউনিয়নে এ সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফ উল্লাহও স্থানীয় জামায়াতের নায়েবে আমির। আর আন্দোলনকারী সংগঠনের প্রধান নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা। এই বাঁশখালীতে রয়েছে সশস্ত্র জলদস্যুদের তৎপরতা। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া অধিককতর জামায়াত অধ্যুষিত হলেও মারামারি ও নাশকতার ঘটনা বেশি হয় বাঁশখালীতে। ২০০৩ সালের ১৮ নবেম্বর বাঁশখালীর সাধনপুর শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু তেজেন্দ্রলাল শীলের বাড়িতে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল গৃহকর্তা তেজেন্দ্র ও চার দিন বয়সী শিশু কার্তিক শীলসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে। সে হত্যাকা-ের বিচার এখনও হয়নি। ওই ঘটনার নেপথ্যে বাঁশখালীর তৎকালীন এমপি ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাত ভাই আমিনুর রহমান ওরফে আমিন চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলায় তিনি আসামি। বছর দুয়েক আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়কে কেন্দ্র করে এই বাঁশখালীতে হয়েছিল ব্যাপক নাশকতা। থানা ও আদালত ভবনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার নথি। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাও সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাঁশখালী থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জোবাইর চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রশাসনের উর্ধতন কোন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি। অপরদিকে, নির্মিতব্য এ কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রকে নিয়ে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিতদের ফেসবুক আইডি থেকে বিভ্রান্তিকর স্ট্যাটাস দিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে সোমবারের সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনায় জামায়াত-বিএনপি নিয়ন্ত্রিত ‘ফেসবুক আইডি’ বাঁশখালী উপজেলা, বাঁশখালীর আর্তনাদ, বাঁশখালী নিউজ, বাঁশেরকেল্লা, ৯নং গন্ডামারা উপকূলবাসী, রক্তাক্ত জনপদ, বাঁশখালীর কণ্ঠস্বরসহ শতাধিক পেজ বিভিন্ন উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে এলাকায় উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এই আইডিগুলো হতে রেহাই পাচ্ছে না সরকারপক্ষ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাংবাদিকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। প্রতিনিয়ত এই আইডিগুলো মানহানিকর ছবিসংবলিত স্ট্যাটাস দেয়া অব্যাহত রেখেছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। অচিরেই এসব ফেসবুক আইডি বন্ধ করা না হলে সাধারণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে অভিজ্ঞ মহলের মন্তব্য। সোমবার ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ও আহতদের পরিবারকে চিকিৎসা-ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করবে বলে এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
×