ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জড়িত কেউ শনাক্ত হয়নি;###;দায় স্বীকার করেনি কেউ ;###;রবিবার থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক

নাজিম হত্যার প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ বিক্ষোভ জবি শিক্ষার্থীদের

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ এপ্রিল ২০১৬

নাজিম হত্যার প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ বিক্ষোভ জবি শিক্ষার্থীদের

গাফফার খান চৌধুরী/হাসান ইমাম সাগর ॥ জঙ্গীদের হাতে খুন হওয়া মুক্তমনা লেখকদের কাতারে যোগ হলো আরেকটি নাম। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নাজিম উদ্দিন সামাদ। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে চলছে শোকের মাতম। নাজিম হত্যায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে ঘটনার সময় নাজিমের সঙ্গে থাকা বন্ধু সোহেলকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ব্যক্তিগত বা প্রেমঘটিত কারণ ছাড়াও হত্যাকা-ের সঙ্গে কোন উগ্র মৌলবাদী বা জঙ্গী সংগঠন বা জামায়াত-শিবির জড়িত থাকতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা। পহেলা বৈশাখ ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে নাজিমকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে। যদিও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নাজিম হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এবারই প্রথম কোন অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টকে হত্যার পর দায় স্বীকারের ঘটনা ঘটেনি। এটি হত্যাকারী বা হত্যাকারী সংগঠনের নতুন কৌশল কি-না, সে বিষয়ে বিস্তর পর্যালোচনা চলছে। নাজিমকে হত্যার প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে আগুন জ্বেলে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে শনিবার রাত বারোটার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে না পারলে রবিবার থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ। যেভাবে হত্যা করা হয় ॥ গত ৬ এপ্রিল বুধবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর সূত্রাপুর থানাধীন একরামপুর মোড়ে পৌঁছে নাজিম উদ্দিন ও তার বন্ধু সোহেল এবং রাজীব। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে চোখের পলকে সেখানে হাজির হয় ৪-৫ জন। পেছন থেকে তিনজন নেমে যায়। নেমেই দুইজন নাজিমের মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নাজিমের মাথার মগজ বেরিয়ে পড়ে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় গুলি চালায়। মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই নাজিমকে হত্যার পর দ্রুত মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। হত্যার সময় হত্যাকারীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে নাজিমকে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে। সোহেল ও রাজীব এ সময় কৌশলে পালিয়ে যায়। তাদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নাজিমের পরিচিতি ॥ নিহতের ভাতিজা সুমন জনকণ্ঠকে বলেন, নাজিম (২৬) বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিলেট জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া নাজিম সিলেটে গণজাগরণ আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টোকাভড়াউট গ্রামের মরহুম আব্দুস সামাদের ছেলে ছিলেন তিনি। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে নাজিম পঞ্চম ছিলেন। আর ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। বড়ভাই জুলহাস উদ্দিন মারা গেছেন। ভাইদের মধ্যে শামীম আহমদ ও সবার ছোট জসিম উদ্দিন যুক্তরাজ্য এবং সুনাম উদ্দিন ফ্রান্স প্রবাসী। নিহতের মায়ের নাম তৈরনেচ্ছা। বোন পারুল বেগম ও নাসিমা বেগম বিয়ানীবাজারে নিজবাড়িতে বসবাস করেন। বড় বোন পারুল বেগমের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। মা ও বোন বিয়ানীবাজারে থাকলেও লেখাপড়া করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নাজিম সিলেট নগরীতে বসবাস করেছেন। নাজিমের লেখাপড়া ॥ সিলেটের বিয়ানীবাজারের আসিরগঞ্জ দিশারী প্রিক্যাডেট স্কুল থেকে প্রাইমারি, আসিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেটের স্কলার্স হোম স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন নাজিম। পরে তিনি সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি অনার্স পাস করেন। সিলেটে পড়াশোনাকালীন নগরীর মজুমদারপাড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। পরবর্তীতে তিনি একাধিক মেস পরিবর্তন করেছেন। এরপর ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম-এ ভর্তি হন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের সান্ধ্যকালীন সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। নাজিম পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছেন। তার একাডেমিক রেজাল্ট ভাল। নাজিমের গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। শত শত মানুষ ভিড় করেছেন নাজিমদের বাড়িতে। সবাই হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। নাজিমের আশঙ্কাই সত্যি হলো ॥ গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকায় হামলার আশঙ্কা করেছিলেন নাজিম উদ্দিন সামাদ। শিক্ষক, বন্ধু ও প্রিয়জনদের কাছে আশঙ্কার কথা জানালেও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি নাজিম। আজহারুল ইসলাম নামে নাজিমের এক স্যার ফেসবুকে লিখেছেনÑ ‘তোমার জন্য ভয় হয় নাজিম। একটু সাবধানে থাকো। দেখতেই তো পাচ্ছ কি হচ্ছে। সাবধানে থেকো।’ জবাবে নাজিম লিখেছিলÑ ‘ভয় আমার নিজেরও হয় স্যার। অকালে মরে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কি করবো স্যার। মাথা নত করে চুপ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এ মরণই বোধ হয় ভালো।’ ফেসবুকে আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই খুন হতে হলো নাজিমকে। তার খুন হওয়ার খবর শুনে স্ট্যাটাসে অগ্নিসারথি নামে একজন ফেসবুক বন্ধু লিখেছেনÑ ‘নাজিম উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে গত কয়েক দিন আগে চ্যাটিং হলো। উনার আশঙ্কাই আজ নির্মমভাবে সত্যি হলো।’ থানা পুলিশের বক্তব্য ॥ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সূত্রাপুর থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, নাজিমের লাশ তার ভাতিজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। লাশটি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রয়েছে। এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। তবে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ঘটনার সময় নাজিমের সঙ্গে সোহেল ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সাউথ ইস্টের শিক্ষার্থী নাজিব ছিলেন বলে জানা গেছে। তাদের খোঁজা হচ্ছে। সড়ক অবরোধ করে ছাত্রদের বিক্ষোভ ॥ নাজিম হত্যার প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় আগুন জ্বেলে বিক্ষোভ করেছে ছাত্ররা। সকাল দশটা থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ ও বিক্ষোভ চলে। এ সময় প্রায় চার ঘণ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা বন্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি ক্যাম্পাস ঘুরে প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে অবস্থান নেয়। সমাবেশ থেকে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানানো হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ধারণা ॥ পুলিশের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পূর্ব বিভাগ নাজিম হত্যার ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নাজিম আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় আসার পর পরই নাজিমকে খুন হতে হলো। ডিবির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নাজিম হত্যার ঘটনায় নানা বিষয় সামনে রেখে তদন্ত চলছে। তদন্তে ব্যক্তিগত শত্রুতার বিষয়টিও প্রাধান্য পাচ্ছে। সিলেটে বসবাসকালে নাজিমের কোন শত্রু সৃষ্টি হয়েছিল কি-না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত তদন্তে সেরকম কোন সম্ভাবনার তথ্য জানা যায়নি। কারণ সিলেটে শত্রুতা হলে নাজিমকে সিলেটেই হত্যা করার কথা। হত্যা করা সম্ভব না হলেও অন্তত নাজিম এক বা একাধিকবার আক্রমণের শিকার হতে পারত। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এ কারণে ব্যক্তিগত শত্রুতার তেমন কোন আলামত মিলছে না। নাজিম ফেসবুকে খুবই সক্রিয় ছিলেন। ফেসবুকে তার একজন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বিশেষ সখ্যতার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও সেই ফেসবুক বন্ধু নিয়েও বির্তক আছে। কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে নাজিমকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ওই মেয়েকে কাজে লাগাতে পারে। আবার ওই মেয়ের ছবি বা ফেসবুকের তথ্য সঠিক কি-না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে নাজিমের অবস্থান ও তার সার্বিক কর্মকা- জানার জন্য মেয়ে বন্ধুকে কাজে লাগানো হতে পারে। ফেসবুকের ওই মেয়ে বন্ধুরও সন্ধান চলছে। তবে নাজিমকে যে মুহূর্তে হত্যা করা হয়েছে, তা বিশেষ ইঙ্গিত বহন করছে। কারণ নাজিম যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। সামনে যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরের কথা রয়েছে। এছাড়া আগামী ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ। নববর্ষে জঙ্গী সংগঠনগুলো নানাভাবেই নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছে। এজন্য পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান পালনে বিশেষ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ঠিক এমন একটি সময়ে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে চোরাগোপ্তা হামলা করে নাজিমকে হত্যা করা হলো। নাজিম হত্যার ধরনের সঙ্গে আগে ব্লগার ও মুক্তমনা লেখক হত্যার ধরনের হুবহু মিল রয়েছে। এজন্য নাজিম হত্যার সঙ্গে উগ্র মৌলবাদী বা জঙ্গী সংগঠন জড়িত বলে ধারণা জোরালো হচ্ছে। সাধারণত এ ধরনের হত্যাকা- নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম করে থাকে। জঙ্গী সংগঠনটির সিøপার সেলের সদস্যদের এ ধরনের হত্যাকা-ের নজির আছে। সিøপার সেলের কর্মকা-ের সঙ্গে নাজিম হত্যার ধরণ মিলে যাচ্ছে।
×