ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে আয় শত কোটি টাকা ;###;২৩ জেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ;###;পরিবহন বড় সমস্যা ;###;স্থায়ী মার্কেট প্লেস চাই

ফুল রফতানি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ এপ্রিল ২০১৬

ফুল রফতানি

এমদাদুল হক তুহিন ॥ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই ফুল কেড়ে নিচ্ছে রমণীর হৃদয়। কেবল রমণীই নন, যে কোন প্রিয়জনকে উপহার হিসেবেও ফুল সর্বজন সমাদৃত। উপহারই নয়, ফুলের ব্যবহার বেড়েছে সাজসজ্জায়। আর এভাবেই অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে ফুল। বর্তমানে দেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ খাতটির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। ২৩টি জেলার ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ১৬ হাজার কৃষক। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে ফুল রফতানি হচ্ছে বিশ্ববাজারেও। গত অর্থবছরে ফুল রফতানিতে দেশের আয় হয়েছে ৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে দিন দিন বাড়ছে ফুলের অবদান। তবে উদ্বেগজনক হলেও সত্য- সম্প্রসারিত ফুলের বাজারে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় ফুল! নানা রঙের ফুলের ভিড়ে ‘দেশীয় গন্ধরাজ’ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিজ্ঞানীদের তাই গন্ধযুক্ত ফুল উদ্ভাবনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। শাহবাগের ফুলের বাজারই দেশের সবচেয়ে বড় বাজার। সেখানকার প্রায় ৫২টি পাইকারি ও শতাধিক খুচরা ফুলের দোকানে ব্যতিব্যস্ততা প্রতিমুহূর্তেই কর্মব্যস্ততা। রাজধানীতে অবস্থিত দ্বিতীয় বড় ফুলের বাজার আগারগাঁওয়ে। এছাড়া ফার্মগেট, মিরপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় ফুলের বাজার রয়েছে। শাহবাগের ফুলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে- রজনীগন্ধা, গাঁদা, জারবেরা, কেলোনজরা, চন্দ্রমল্লিকা, লাল ও সাদা গোলাপ, ভুট্টা, বেলি, কামিনী, সূর্যমুখী, ডায়ম-, গরম ফেনিয়া, রতপুসুটি, টুনটুনি, জিপসি, স্টারকলি, ডালিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল বিক্রি হচ্ছে। এমনকি বেশ কয়েকটি ফুলের একাধিক রং রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের সর্বত্রই কমবেশি ফুল উৎপাদন হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হয় যশোরে। জেলাটিতে উৎপাদিত গাঁদা ও সাদা রজনীগন্ধার মান বেশ ভাল। সাভারে উৎপাদিত গোলাপের মান বেশ উন্নত। এছাড়া ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ঢাকার আশপাশের জেলায়ও ফুল চাষ হয়। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ফুলের ব্যবসার ওপর নির্ভর করেই তাদের পরিবার চলছে। সাধারণ যে কোন ফুল ব্যবসায়ীর প্রতিমাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। আর শাহবাগ বটতলা ক্ষুদ্র ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির উপদেষ্টা লুকমান হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ফুলের ব্যবসায় তেমন লাভ নেই। ৫ হাজার টাকার ফুলে ২ থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি লাভ হয় না। ফুল ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে তিনি জানান, ফুল মজুদ করার জন্য দেশে কোন ক্লোড স্টোরেজ নেই। ফলে দীর্ঘ সময় ফুল সংরক্ষণ করা যায় না। এ ব্যবসার ক্ষেত্রে এটিই মূল প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া ফুল ব্যবসার সঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী খাতটি এগিয়ে যেতে পারছে না। এদিকে রাজধানীর খামারবাড়ি সংলগ্ন ফুটপাথে তিন বছর ধরে ফুলের ব্যবসা করেন দিপু দেব। তিনি বলেন, দুই ভাই ফুলের ব্যবসা দেখাশোনা করি, এর ওপর নির্ভর করেই আমাদের পরিবার চলছে। আয় খারাপ নয়, দিন চলে যাচ্ছে। এ ব্যবসায় আয় কেমনÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণত ৫ হাজার টাকার ফুলে ২ হাজার টাকা লাভ হয়। তবে কাটতি সময়ে ৫ হাজার টাকায় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। লাভ মূলত অর্ডার প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে। যখন অর্ডার বেশি তখন লাভ বেশি। নবেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এই চার মাস ফুলের খুব কাটতি সময় জানান তিনি। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির (বিএফএস) তথ্যমতে, ১৯৮৩ সালে ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষের মধ্য দিয়ে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে ২৩টি জেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১৬ হাজার কৃষক সরাসরি বিভিন্ন জাতের ফুল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। সব মিলিয়ে ২০ লাখ মানুষ এই সেক্টরের সঙ্গে জীবন জীবিকায় নিয়োজিত। দেশে উৎপাদিত ফুল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ফুল দেশে উৎপাদিত হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফুল রফতানিতে দেশের আয় হয় ৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। তবে ফুলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে নিজস্ব চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৮৮ কোটি টাকা। ফুল আমদানি রফতানিতে দেশ সাম্যাবস্থায় আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির (বিএফএস) সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, বর্তমানে ফুলের আমদানি-রফতানি প্রায় সমান সমান। সম্ভাবনাময় খাতটির উন্নয়নের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বাজারে আসতে আসতেই উৎপাদিত ফুলের ২২ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ড. গয়নাথ সরকার ‘ফুল চাষের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে ফুলের যথেষ্ট অবদান থাকা সত্ত্বেও উৎপাদিত ফুলের বড় একটি অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে বাজারে নিয়ে আসতে আসতেই ২২ শতাংশ ফুল নষ্ট হয়ে যায়।’ দেশে ফুলের স্থায়ী কোন বাজার নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ফুল চাষীদের কথা বিবেচনা করে খুব শীঘ্রই দেশে একটি ফুলের বাজার গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির (বিএফএস) সভাপতি আব্দুর রহিম জনকণ্ঠকে বলেন, একাধিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এগিয়ে চলছে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন। ফুলের বীজ সংরক্ষণ ও ফুল মজুদ করে রাখার জন্য দেশে কোন কোল্ড স্টোরেজ নেই। এমনকি দেশে ফুল আমদানি-রফতানির কোন নীতিমালা তৈরি হয়নি। এছাড়া ফুলের স্থায়ী কোন বাজার নেই। তবে সরকার ইতোমধ্যে স্থায়ী বাজার নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। আশা করা যায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দ্রুত সময়েই তা পূরণ হবে। জানা গেছে, ফুলের বাজার প্রসারিত হলেও হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় ফুল। নানা রঙের ফুলের ভিড়ে ‘দেশীয় গন্ধরাজ’ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশ ফুল সমিতি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গন্ধযুক্ত ফুল হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গন্ধযুক্ত ফুল উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
×