ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডা. অরূপরতন চৌধুরী

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৮ এপ্রিল ২০১৬

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত

তামাক ও ধূমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান তা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সকল আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র ইতোমধ্যে আমাদের সতর্ক করেছে। যার ফলে ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (ঋঈঞঈ) জাতিসংঘে সকল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের নিয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয় যে, সকল রাষ্ট্রই তামাকের মতো ক্ষতিকর পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ২০০৫ সালে মহান জাতীয় সংসদে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি পাস হয়, কিন্তু তখন সেই আইনে ধোঁয়াহীন তামাকের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কোন বিধিনিষেধ দেয়া হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৩ সালে সেই ধোঁয়াহীন তামাক অর্থাৎ জর্দা, তামাক, গুল ও দোক্তার মতো পদার্থকেও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ঋঈঞঈ -এর শর্ত অনুযায়ী সিগারেটের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী গত ১৯ মার্চ ২০১৬, বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন উন্নত বিশ্বেও অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের সিগারেটের প্যাকেটে ছবিসহ সতর্কবাণী অর্থাৎ মানুষের ক্যান্সারের ছবি, হৃদরোগের ছবি, ব্রেন স্ট্রোকের ছবি এমনকি ধূমপানের কারণে মৃত শিশুর ছবিও সন্নিবেশিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ব্যবহারকারী একজন ধূমপায়ী সিগারেট কেনা ও ব্যবহার করার সময় দিনে কমপক্ষে ২০ বার, বছরে ৭,০০০ বার সিগারেট প্যাকেটে ছাপানো ছবি দেখে থাকেন। ২০০১ সালে কানাডা প্রথম সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রথা প্রবর্তন করে। বর্তমান বিশ্বের ৭৭টিরও বেশি দেশে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী চালু আছে। এখন থেকে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ায় এই সংখ্যা দাঁড়াল ৭৮-এ। এতে ধূমপায়ীর সংখ্যা অবশ্যই কমবে বলে সবাই আশা করেছে। দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সমে¥লনে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) আইন শীর্ষক সমাপন অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন ঋঈঞঈ ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেকেশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল বাস্তবায়ন দু’টি সুনির্দিষ্ট কারণে অপরিহার্য, প্রথমত ঋঈঞঈ ছাড়া এমডিজির তৃতীয় উদ্দেশ্য সুস্থ জীবন যাপন এবং সব বয়সের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তামাক একটি বড় বাধা। বর্তমানে তামাকের ব্যবহার মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায় তামাক-গ্রহণকারীর মোট সংখ্যা প্রায় ৩৮৩ মিলিয়ন। এটা বিশ্বের মোট ১.১ বিলিয়ন তামাক গ্রহণকারীর সংখ্যার ৩৪.৮% অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এসব দেশে তামাকজনিত আর্থিক এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। শুধু ভারত এবং বাংলাদেশে তামাক গ্রহণজনিত কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ১.১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। ঋঈঞঈ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১৩ সালে ধূমপান এবং তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ আইন) সংশোধন করেছেন এবং ২০১৫ সালে সংশ্লিষ্ট বিধি পাস করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঋঈঞঈ সত্যিকারভাবে বাস্তবায়িত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও উল্লেখ করেছেন ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানাই। তামাক ও ধূমপান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের আইন কানুন থাকলেও মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন জরুরী। তবে এ ব্যাপারে ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু কালজয়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এদের মধ্যে দু’জনের নাম আজ প্রকাশ না করলে অন্যায় হবে বলে মনে করি। তাদের একজন হচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোঃ নাসিম। যিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় বারবার উল্লেখ করেছেন যে, মেডিকেল ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা ধূমপায়ী হলে তাদের ভর্তি করা হবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই ধরনের সিদ্ধান্ত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধূমপান নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনসহ অনুষদ, ইনস্টিটিউট, অফিস-ক্লাস, গবেষণাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে ধূমপান নিষিদ্ধ হলো। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকীসহ সকল সিন্ডিকেট মহোদয়কে আমি ধন্যবাদ জানাই। আশা করি তারা এ ব্যাপারে একটি মনিটরিং সেল গঠন করে বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন। তবে এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনেই আছে যে পাবলিক প্লেস ধূমপানমুক্ত। এই পাবলিক প্লেস বলতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, রেলওয়ে, স্টিমার ও বাস স্টেশনসহ সকল শপিংমল, পার্ক ও রেস্টুরেন্টকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, সঙ্গত কারণেই এসব এলাকায় কেউ ধূমপান করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক সেই ধূমপায়ীকে ৩০০ টাকা জরিমানা করতে পারে এবং দ্বিতীয়বার করলে দ্বিগুণ অর্থ দ-ে দ-িত হবেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে প্রায় এক লাখ মানুষ মারা যায় এবং সিগারেট ক্রয়ে দেশের জিডিপির এক শতাংশ ব্যয় করা হয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে তামাক সেবনের ফলে জনগণ যে সমস্ত রোগে আক্রান্ত হয় তার ফলে ১০০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা বাবদ (সরকারের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এবং রোগীর নিজস্ব ব্যয়) বছরে প্রায় ৯,৯০০৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে তামাক খাতে সরকার বছরে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা আয় করে। সেই হিসেবে তামাকের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৭, ৪০০ কোটি টাকা যা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষতি। অতএব, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে আমাদের এখন গণজাগরণ তৈরি করতে হবে নতুবা শুধু মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- মানস [email protected]
×