ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সাদাসিধে কথা ॥ পদ্মা ব্রিজ থেকে বড়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৮ এপ্রিল ২০১৬

সাদাসিধে কথা ॥ পদ্মা ব্রিজ থেকে বড়

এপ্রিলের ২ তারিখ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশেও বিশ্ব অটিজম দিবস পালন করা হয়েছে। সেই দিনটিতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে অটিস্টিক শিশুদের একটা অসাধারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এবং আমি সেখানে খুব চমৎকার একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে এসেছিলাম। একটা সময় ছিল যখন এই দেশের মানুষ অটিজম বা অটিস্টিক শব্দটার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। দুটি কারণে এখন এই দেশের কম বেশি সব মানুষই এই শব্দটার সঙ্গে পরিচিত। প্রথমত অটিজম নিয়ে দেশে একটা জনসচেতনতার জন্য অনেক কাজ হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত তার চাইতেও মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সবাই এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করছি যে আমাদের পরিচিত এবং আত্মীয়স্বজনদের ভেতর অটিস্টিক শিশুরা জন্ম নিতে শুরু করেছে। মনোবিজ্ঞানের একটা বইয়ে আমি পড়েছিলাম কোনো একটি হাসপাতালের একজন ডাক্তার যখন প্রথমবার একটি অটিস্টিক শিশুকে দেখেছিলেন তখন তিনি এত অবাক হয়েছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তার সব ছাত্রছাত্রী এবং গৃহকর্মীকে শিশুটিকে দেখার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাদেরকে বলেছিলেন এরকম বিস্ময়কর একটা শিশু দেখায় সুযোগ তারা হয়তো জীবনে আর কখনো নাও পেতে পারে। সেই ডাক্তার সুনজরেও কল্পনা করেননি মাত্র কয়েক দশকের ভেতরেই অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় এক শতাংশ মানুষ অটিস্টিক আমেরিকার সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রতি ৬৮ জনে একজন। পৃথিবীর অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা কী ভাবে বাড়ছে সেটি দেখলে এক ধরনের আতঙ্ক হয় অথচ সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না এর কারণ কী! আমরা যারা অটিস্টিক শিশু দেখেছি তারা সবাই জানি এরা একা একা থাকতে চায়, সত্যি কথা বলতে কী অটিস্টিক শব্দটা যে গ্রীক শব্দটা থেকে এসেছে তার অর্থ ‘নিজ অর্থাৎ তারা নিজেদের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কারো দিকে তাকাতে চায় না, কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না, বন্ধুত্ব করতে চায় না। এখন অটিস্টিক শব্দটার সঙ্গে স্পেকট্রাম শব্দটা যোগ করা হয়েছে, এটা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে বন্ধ এর ব্যাপ্তিটি অনেক বড়। খুবই মৃদুভাবে অটিস্টিক থেকে শুরু করে খুবই প্রবলভাবে অটিস্টিক হওয়া সম্ভব। অটিস্টিক শিশুদের মস্তিষ্কের মাঝে কোনো রহস্যময় বিষয়টি ঘটে আমরা জানি না কিন্তু মাঝে মাঝেই আমরা দেখি কোনো একজন অটিস্টিক শিশু একটা বিশেষ দিকে অবিশ্বাস্য রকম পারদর্শী! হয়তো অস্বাভাবিক গণিত করতে পারে, বিস্ময়কর ছবি আঁকতে পারে কিংবা অকল্পনীয়ভাবে সঙ্গীতের সুর মনে রাখতে পারে। এরা কী ভাবে এটি করে, কেউ জানে না। সারা পৃথিবীর অসংখ্য বিজ্ঞানী মিলে এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন, হয়তো একদিন আমরা এর কারণটি জানতে পারব। কোন কিছুর সত্যিকার কারণটি জানা না থাকলে সেটা নিয়ে হাজারো রকম জল্পনা কল্পনা হয়, অটিজমের জন্যেও সেটা সত্যি। প্রথম প্রথম অটিজমের জন্যে ঢালাওভাবে আমাদের দোষ দেয়া শুরু হয়েছিল। এক সময় শোনা যেতো মায়েরা সন্তানদের অবহেলা করেছেন বলে তাদের অটিজম হয়েছে। বিজ্ঞানীরা রীতিমতো গবেষণা করে এই হৃদয়হীন ধারণাটাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আমি যেহেতু এই বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ নই তাই এর খুঁটিনাটি জানি না, কিন্তু অটিজমের যে একটি জিনেটিক অংশ আছে সেটি সবাই স্বীকার করে নিয়েছেনÑ দেখা গেছে সারা পৃথিবীতে মেয়ে অটিস্টিক শিশু থেকে ছেলে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা চারগুণ বেশি। হুবহু এক রকম যমজ শিশুদের নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে অটিজম পুরোপুরি জিনেটিক নয়, আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে সেটাও কোনো না কোনোভাবে দায়ী। আমরা এখনো জানি না। সেটি কী এই পৃথিবীর শিশুদের অটিস্টিক করে দেয়ার জন্য দায়ী সেই অভিশাপটি খুঁজে বের করার জন্য বিজ্ঞানীরা দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন। ॥ দুই ॥ আমি অনেক অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার সাথে কথা বলে জেনেছি তাদের সন্তানরা পরোপুরি স্বাভাবিক শিশু হয়ে বড় হচ্ছিল। দুই বছরের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর হঠাৎ করে তাদের সন্তানদের মাঝে অটিস্টিক শিশুর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দিতে শুরু করেছে। তাদের কথা শুনে মনে হয় তখন যেন কিছু একটা ঘটে যায় যেটা হঠাৎ করে সুস্থ এবং স্বাভাবিক একটা শিশুর মস্তিষ্কের গঠনের সাথে এক ধরনের ভিন্ন কাজ শুরু করে দেয়। সেটি কী? আমার পরিচিত যারা তাদের অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সব মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়েছেন তাদের সবাইকে উপদেশ দেয়া হয়েছে শিশুদের যেন টেলিভিশন থেকে দূরে রাখা হয়। অটিজমের সাথে টেলিভিশনের সম্পর্ক নিয়ে আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন আমেরিকার যে সব স্টেটে হঠাৎ করে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেছে সেই সব স্টেটে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যাও হঠাৎ করে বেড়ে উঠেছে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপক মনোরোগের বিশেষজ্ঞ ছিলেন না এবং বিজ্ঞানীরা তার সেই গবেষণা পত্রটিকে গ্রহণ করেননি, বরং এটি লেখার জন্যে তাকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আমি ও বিশেষজ্ঞদের, গালমন্দ শোনার ঝুঁকি নিয়ে টেলিভিশনের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ছোট শিশুদের টেলিভিশন দেখার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলি। আমরা সবাই ‘ভিডিও গেমের সাথে পরিচিত। এক সময়ে এটা টেলিভিশনে খেলা হতো, এখন কম্পিউটার, ল্যাপটপ স্মার্ট ফোনেও খেলা হয়। আমরা সবাই দেখেছি ছোট বাচ্চারা এই খেলা খুব পছন্দ করে। কিন্তু সবাই কী জানে কম্পিউটারের এই গেমের ম্যানুয়েলের শেষে খুব ছোট ছোট অক্ষরের একটা সতর্কবাণী লেখা থাকে, যেখানে বলা হয় এই ভিডিও গেম দেখে কারও কারও এপিলেপসি বা মৃগীরোগ শুরু হয়ে যেতে পারে? আমি প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন আতংকে শিউরে উঠেছিলাম। আমাদের মস্তিষ্ক খুবই রহস্যময় একটা বিষয়। এটা কী ভাবে কাজ করে আমরা জানি না, আমার ধারণা মতে আমরা সেটা বুঝতে শুরু করেছি। মৃগী বা এপিলেপসি মস্তিষ্কের এক ধরনের বিপর্যয়, যারা ভিডিও গেম বিক্রয় করেন তারা ছোট ছোট অক্ষরে লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে এই গেমটি খেলতে গিয়ে মস্তিষ্কে একটা বিপর্যয় ঘটতে পারে। এটা কী ভাবে হয় জানা নেই কিন্তু ভিডিও স্ক্রীনের আলোর বিচ্ছুরণের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে বলে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিয়েছেন। যার অর্থ টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের স্ক্রীনে আলোর বিচ্ছুরণ আমাদের চোখ দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে সেখানে একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে। সবার জন্যে এটা সত্যি নয়, কারো কারো জন্যে এটা সত্যি। একটা ছোট শিশুর বেলায় কোন শিশুর জন্যে এটা সত্যি হবে আমরা জানি না, তাহলে কেন আমরা না জেনে আমাদের শিশুদের জন্যে এই ঝুঁকি নেব। তাই আমি পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিকের মতো আমার পরিচিত সব মা’দের বলি, খবরদার আপনার ছোট শিশুটিকে একটা টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখবেন না। তাকে শান্ত রাখার জন্যে তার হাতে একটা স্মার্ট ফোন তুলে দেবেন না। তাকে বই পড়ে শোনান। তাকে হাত দিয়ে ধরা যায় ছোঁয়া যায়, ভেঙ্গে ফেলা যায় তৈরি করা যায় এরকম খেলনা দিয়ে খেলতে দিন। অন্য বাচ্চাদের সাথে ছোটাছুটি করতে দিন। অযাচিতভাবে মা’দের এরকম উপদেশ দেয়ার আমার কোনো অধিকার আছে কী না জানি না, কিন্তু দীর্ঘ জীবনে অসংখ্য শিশুদের গড়ে উঠতে দেখে আমার মনে হয়েছে একটা শিশুকে শিশুর মতো বড় হতে দেয়াটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কমন সেন্স। টেলিভিশন ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট ফোন নিয়ে বড় হওয়া শিশুদের কাজ নয়। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর স্মার্টফোন থেকে শিশুদের সরিয়ে রেখে তাদেরকে বই পড়ে শোনালে খুবই বিস্ময়কর একটা ঘটনা ঘটে। শিশুরা নিজে থেকেই পড়তে শিখে যায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যখন একজন মা কিংবা বাবা দেখবেন তাদের শিশুদের বর্ণ পরিচয় হয়নি, সে অ, আ, ক, খ, চিনে না কিন্তু একটা বই গড় গড় করে পড়তে পারে, তখন সেই দৃশ্য দেখে তারা যেটুকু আনন্দ পাবেন এবং অবাক হবেন তার কোনো তুলনা নেই? আমি নিজে সেই বিস্ময়কর আনন্দটি পেয়েছি এবং আমার কথা বিশ্বাস করে আমার পরিচিত যেসব বাবা-মা তাদের খুব ছোটবেলা থেকে বই পড়িয়ে শুনিয়েছেন তারাও এই বিস্ময়কর আনন্দটি পেয়েছেন। ॥ তিন ॥ আমি আগেই বলেছি আজকাল অটিজম শব্দটির সাথে শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে যার অর্থ অত্যন্ত মৃদুভাবে অটিস্টিক থেকে শুরু করে অত্যন্ত প্রবলভাবে অটিস্টিক হওয়া সম্ভব। অত্যন্ত প্রবলভাবে অটিস্টিক এক শিশু সারাটি জীবনই নিজেদের ভিতরে এমনভাবে গুটিয়ে থাকতে পারে যে সে হয়তো কোনোদিন মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ না করে জীবন কাটিয়ে দেবে কিংবা একেবারে দৈনন্দিন কাজগুলো পর্যন্ত নিজে করতে পারবে না। সে জন্যে কাউকে তাদের সাহায্য করতে হবে। এরকম শিশুদের বাবা-মায়েরা একধরনের অসহায় আতংক নিয়ে দিন কাটান- তারা ভাবেন যখন তারা থাকবেন না তখন তাদের অটিস্টিক শিশুদের কে দেখে শুনে রাখবে? আন্তর্জাতিক অটিস্টিক দিবসে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের সব অটিস্টিক শিশুদের বাবা-মায়ের বুকের ভেতর এক ধরনের স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে আমাদের রাষ্ট্র অভিভাবকহীন সকল অটিস্টিক শিশু কিংবা প্রতিবন্ধীদের দায়িত্ব নেবে। সে জন্যে একটা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে এই অসহায় শিশুদের একটি সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা দেবে। নিজেদের অর্থে পদ্মা ব্রিজ তৈরি করার ঘোষণাটি থেকেও এই ঘোষণাটিকে আমার বড় ঘোষণা বলে মনে হয়েছে! এর বাস্তবায়ন দেখার জন্যে আমি অনেক আগ্রহে অপেক্ষা করতে শুরু করেছি। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন পৃথিবীর মানুষ বলবে, ‘যদি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিতেই হয় তাহলে তুমি বাংলাদেশে জন্ম নাও- কারণ এই দেশটি সকল রকম প্রতিবন্ধী মানুষকে বুক আগলে রক্ষা করে।’ সুন্দর একটা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে দোষ কী? ৫ এপ্রিল ২০১৬
×