ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একতারা

বাদল-বাউল বাজায়রে একতারা... সূক্ষ্ম সাধনযন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ এপ্রিল ২০১৬

বাদল-বাউল বাজায়রে একতারা... সূক্ষ্ম সাধনযন্ত্র

মোরসালিন মিজান ॥ একটিমাত্র তার। আঙ্গুল ছোঁয়ালেই বাজে। আশ্চর্য সে বেজে ওঠা। সুর বাজে না শুধু, ভেতরটাও বাজে! আর কেউ নয়- এমন করে বাজে একতারা। এমন করে বাজায় একতারাই কেবল। লোকজ বাদ্যযন্ত্র বাঙালীর প্রাণের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতিগুলোকে সযতেœ ধারণ করে। গীতিকবির ভাষায়- আমার বাউল মনের একতারাটা/ হাজার নদীর বাংলাদেশে/ সুরের খেয়ায় ভেসে ভেসে/ দুঃখ-সুখের ঘাটে ঘাটে/ সে দেখে কতই জোয়ার ভাটা...। বাংলাদেশের একেবারেই নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র একতারা। বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে এটি দেখা যায়। বাউল সাধকরা এমনকি ঘর ছাড়েন, সংসারত্যাগী হন। কিন্তু একতারা ছাড়েন না। একে আশ্রয় করে সকল বিয়োগ ব্যথা ভুলেন। সারাদেশ ঘুরে বেড়ান। গানে গানে বললে- একতারা তুই দেশের কথা/ বলরে এবার বল/ আমাকে তুই বাউল করে/ সঙ্গে নিয়ে চল...। একতারার ধ্বনি যেমন কোমল, তেমনি মিষ্টি। বাংলার বাউলদের সাধনযন্ত্র একতারা। এর সুরে শাশ্বত সত্য অন্বেষণ করেন বাউলরা। পরমাত্মার সন্ধানে ব্যাকুল হন। যন্ত্রটি ছাড়া বাংলার বাউল যেন অপূর্ণ। সবটুকু প্রকাশ হতে পারেন না। একইভাবে বাংলা সঙ্গীত ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ একতারা। লোক গবেষক ও শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটিমাত্র তার থাকে বলে একতারা নাম। এক সময় একতন্ত্রী বীণা নামেও পরিচিতি ছিল। উপকরণ ও আকৃতিভেদে যন্ত্রটি লাউ, গোপীযন্ত্র, বসমতি, থুনথুনে ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান এ বাদ্যযন্ত্রকে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্রের উৎসরূপে বিবেচনা করা হয়। একতারায় একটি মাত্র স্বর ধ্বনিত হয়। এর সুর খুব সহজ সরল ও নিরাভরণ। বাউলসহ বিভিন্ন লোকগানে একতারা ব্যবহৃত হয়। একতারা বাউল গানের অপরিহার্য ও একান্ত সহযোগী। এটি বাজিয়ে বাউলরা গান করেন, নৃত্য করেন। এটি ততযন্ত্র। গান গাওয়ার সময় স্কেল ও ছন্দ ঠিক রাখতে একতারার সাহায্য নেন বাউলরা। এত কাজ যে যন্ত্রের সেটি আবার তৈরি হয় অতি নগণ্য উপকরণে। কারও অজানা নয়, একতারা তৈরির প্রধান উপকরণ লাউ। আর প্রয়োজন হয় বেল নারিকেল ইত্যাদি নির্মিত বস, কাঠ বা পিতলের খোল, সরু একখ- বাঁশ, একগাছি তার এবং এক টুকরা চামড়া। লোক গবেষক লেখক ড. আবদুল ওয়াহাব দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করেছেন। একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। একতারার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, লাউ বা কুমড়োর খোল ও গিঁটযুক্ত সরু বাঁশের দ-ের সাহায্যে একতারা তৈরি করা হয়। এজন্য প্রথমে গোলাকৃত লাউ বা কুমড়োর খোলের উপরিভাগটি বৃত্তাকারে কাটা হয়। এই উন্মুক্ত মুখের ব্যাস সাধারণত ছয় থেকে সাত ইঞ্চি হয়ে থাকে। প্রায় তিন ফুট লম্বা বাঁশ দ-ের একপ্রান্তের গিঁটকে অটুট রেখে অন্যপ্রান্ত চিড়ে সেটিকে একরূপ লম্বা চিমটা আকারে পরিণত করা হয়। এই চিমটার দুই ফলককে খোলের উভয় পাশে তার বা সুতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। খোলের তলায় ক্ষুদ্র ফুটো করে একটি পিতল বা লোহার তার ঢুকিয়ে তারের অন্য প্রান্তটি বাঁশের গিঁট অংশে অবস্থিত একটা কানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। লাউয়ের উপরিভাগের বৃত্তাকারে কাটা অংশে চামড়ার ছাউনি দেয়া হয়। এর ওপর সওয়ারি সংযুক্ত থাকে। সওয়ারিটি হাড় বা কাঠের তৈরি। একতারা বাজানোর সময় একটি মিজরাব দরকার হয়। এটি তৈরি করা হয় ইস্পাতের তার দিয়ে। হাতের চার আঙ্গুলে একতারাটি ধরে তর্জনী বা মধ্যমা দিয়ে বাজানো হয়। মিজরাব সহযোগে অথবা খালি আঙ্গুলে তারে আঘাত করলে স্বর সৃষ্টি হয়। এভাবেই কাজ করে বাদ্যযন্ত্রটি। তবে একতারা ঠিক কবে থেকে সুর তুলতে শুরু করে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয়, ইতিহাসটি বহু পুরনো। প্রায় এক হাজার বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। কারও কারও মতে, লালন শাহ’র সময় একতারার জন্ম। মরমি সাধক নিজের ভাব ও দর্শন প্রকাশে একতারাকে ভীষণভাবে আশ্রয় করেছিলেন। সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে একতারাকে লাউ বলা হয়। ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’ ওই অঞ্চলের একটি বিখ্যাত গান। লাউ বাজিয়ে যে বৈষ্ণবেরা গান করেন তাদের লাউয়া বৈরাগী বলা হয়। একই কারণে মুসলমান ফকিরদের বলা হয় লাউয়া ফকির। সুর তোলার পাশাপাশি বহু গান, কবিতা রচিত হয়েছে একতারা নিয়ে। বাদ্যযন্ত্রটির কথা উল্লেখ করে কবিগুরু লিখেছেন- ‘বাদল-বাউল বাজায়রে একতারা/ সারাবেলা ধরে ঝরো ঝরো ঝরো ধারা/ জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে/ নেচে নেচে হলো সারা...।’ অন্য জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘সাহিত্যের ঐকতান সঙ্গীতসভায় একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়।’ অবশ্য যত দিন গেছে, বাউল তত কমেছে। হারিয়েছে একতারা। এরই মাঝে জায়গা হয়েছে জাদুঘরে। জাতীয় জাদুঘরের কাঁচের বাক্সে বন্দী লোক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে দেখা যায় একতারাকেও। একতারার এমন হারিয়ে যাওয়া বেদনার বৈকী। প্রসঙ্গটি তুলতেই বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পী ও সংগ্রাহক ইন্দ্রমোহন রাজবংশী বলেছিলেন, বাংলা, বাংলার বাউল আর একতারা মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল বহুকাল। গ্রামের পথে হাঁটে-মাঠে একতারা হাতে গান গাইতে দেখা যেত বাউলদের। কিন্তু এখন সে দৃশ্য দুর্লভ। দেশাত্মবোধের অভাব, অন্যের অনুকরণসহ বিভিন্ন কারণে বিলুপ্তির পথে এই দেশী বাদ্যযন্ত্র। এভাবে চলতে থাকলে বাঙালী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষঙ্গ চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আগামী প্রজন্মকে নিজের শেকড় সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিতে একতারাসহ সকল দেশী বাদ্যযন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানান তিনি।
×