ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অসমাপ্ত রেখেই ১শ’ ২১ প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা

বরাদ্দ থাকলেও ১শ’ প্রকল্পে কোন অর্থ ব্যয় হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৭ এপ্রিল ২০১৬

বরাদ্দ থাকলেও ১শ’ প্রকল্পে কোন অর্থ ব্যয় হয়নি

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১২১টি প্রকল্প। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসব প্রকল্পের কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকলেও সমাপ্ত ঘোষণা করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। সেই সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ থাকলেও পুরো এক বছরে ১০০ প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন অর্থই ব্যয় হয়নি। তা ছাড়া কিছু অর্থ ব্যয় হলেও মাঠ পর্যায়ে ১০৩টি প্রকল্পে কোন কাজই হয়নি। এর ফলে প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তার আগের অর্থবছরেও (২০১৩-১৪) ১৮১টি প্রকল্প পুরোপুরি সমাপ্ত না করেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প গ্রহণের সময় বাস্তবতা বিবেচনা না করেই গ্রহণ করা হয়েছে, এ জন্য কিছু কম্পোনেন্ট বাদ দিয়েই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হতে পারে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের অর্থ ব্যয় করে উন্নয়নের নামে অপচয় করা হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় জীবনে এর সুফল প্রতিফলিত হচ্ছে না। এ জন্য উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ বাড়লেও কাক্সিক্ষত প্রভাব পড়ছে না। এ বিষয়টিকে সমগ্র উন্নয়ন প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির অনত্যম একটি দুর্বলতা হিসেবে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বড়সংখ্যক প্রকল্প অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করা হয়েছে। এখানে দুটি বিষয় থাকতে পারে। একটি হচ্ছে হয়ত ওইসব কম্পোনেন্টের প্রয়োজন ছিল না। দ্বিতীয়টি প্রয়োজন থাকলেও নানা কারণে সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। যদি প্রথমটি ঠিক হয় তাহলে বলব প্রকল্প গ্রহণের যে প্রস্তাব সেখানে বড় দুর্বলতা ছিল। কেননা এসব কম্পোনেটের পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করা হলে তা হবে অপচয়। দ্বিতীয়টি ঠিক হলে বলব প্রকল্প গ্রহণের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এর ফলে প্রকল্পটি যে কারণে নেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট বাদ দিয়ে সমাপ্ত ঘোষণা করায় সেই বেনিফিট থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশের মানুষ। অতএব বলা যায় এ রকম কর্মকা- অর্থনীতির জন্য ভাল ফল বয়ে আনে না। তিনি বলেন, এ বিষয়ে খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট ২৫৩টি প্রকল্প সমাপ্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে ২২০টি। সেই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার বাইরে সমাপ্ত হয়েছে আরও ২০টি প্রকল্প। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় ২৪০টি। শেষ হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে শতভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যা ১১৯টি। আর কিছু কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১২১টি প্রকল্প। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সমাপ্ত করতে না পারা ৩৩টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের এ অবস্থা হওয়ার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। এগুলোর বিষয়ে আইএমইডির সচিব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী প্রতিবেদনে বলেছেন, প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদন পর্যায়ে যেসব সমস্যা হয় সেগুলোর মধ্য অন্যতম হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই সরকারী তহবিলে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া কোন কোন প্রকল্পের দলিলে অঙ্গভিত্তিক ব্যয় প্রাক্কলন বা কর্মপরিকল্পনা থাকে না। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে অনেক প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক যথাযথভাবে প্রণয়ন করা হয় না, বেশিরভাগ প্রস্তাবিত প্রকল্প দলিলের লক্ষ্যমাত্রা এমটিবিএফ এ বরাদ্দ থাকে না, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব ইত্যাদি কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হয় এবং এ রকম অবস্থা হয়। সূত্র জানায়, অর্থ বরাদ্দ থাকলেও পুরো এক বছরে প্রকল্পের অনুকূলে কোন অর্থ ব্যয় হয়নি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ১০০ প্রকল্পে এমন অবস্থা ছিল। তা ছাড়া কিছু অর্থ ব্যয় হলেও মাঠ পর্যায়ে ১০৩টি প্রকল্পে কোন কাজই হয়নি। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প নাম মাত্র বরাদ্দ দিয়ে জিইয়ে রাখা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক ও কর্মীদের বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে সরকারী তহবিলের অর্থ। আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেয়া যায়, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পে গত অর্থবছর ব্যয় দেখা হয়েছে ৫৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা, কিন্তু এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ছিল না। স্কুল প্রোগ্রামে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪১৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন কোন অগ্রগতি পায়নি আইএমইডি। বঙ্গবন্ধু সেতুর ফাটল মেরামতে নেয়া প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ২৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য অর্থছাড় হয় মোট ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে এক টাকাও ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) অবকাঠামো ও বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ঢাকার উত্তরা তৃতীয় পর্যায়, আফতাবনগর, পূর্বাচল, বসুন্ধরায় এবং গুলশান-বনানীতে ৫টি গ্রিড সাব-স্টেশন নির্মাণে কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের জুনে। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরেই ঝুলে আছে বাস্তবায়ন কাজ। ডেসকো এলাকায় ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ এবং লোডশেডিং কমানো, বিদ্যুত অপচয় রোধ করা এবং ভবিষ্যতে চাহিদা পূরণে ১৩২/৩৩/১১ কেভি গ্রিড স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রকল্পের ৫টি গ্রিড স্টেশন নির্মাণ কাজে ৬০ শতাংশই শেষ হওয়ার কথা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। কিন্তু স্টেশন নির্মাণে এখনও পর্যন্ত কোন অর্থই খরচ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অন্যদিকে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এডিপির ২৯৮টি প্রকল্পে সমাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে মাত্র ১৫১টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট ১৪৭ প্রকল্পের কাজ শেষ না করে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ লক্ষ্যমাত্রার বাইরে আরও ৮২টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করেছে। এ হিসেবে ওই অর্থবছরে ২৩৩টি প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। আইএমইডিএর আগের এক প্রতিবেদনে বলছে সমাপ্ত ঘোষণাকৃত এ প্রকল্পের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু কাজ অসমাপ্ত রেখে কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যার সংখ্যা ১৮১টি । এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি এর আগে বলেন, এটা এক ধরনের প্রবঞ্চনা। উন্নয়নের নামে অর্থ অপচয়। তিনি বলেন, যদি প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় কোন কম্পোনেন্ট যুক্ত থাকে তবে তার অনুকূলে বরাদ্দ থাকা অর্থ ফেরত দিতে হবে। যদি অর্থ ফেরত দেয়া না হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
×