ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তক্ষয়ী ঘটনার হোতা বিএনপি নেতা লেয়াকতের ফাঁসি দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৭ এপ্রিল ২০১৬

রক্তক্ষয়ী ঘটনার হোতা বিএনপি নেতা লেয়াকতের ফাঁসি দাবি

চট্টগ্রাম অফিস/জোবাইর চৌধুরী, বাঁশখালী ॥ বাঁশখালীর গ-ামারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে এলাকার সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশসহ তিনটি পক্ষের দায়েরকৃত তিন মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হাজারে হাজারে হওয়ায় দোষী নির্দোষ সকলে একযোগে সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় এক ধরনের গা-ঢাকা দিয়ে চলছে। দু’দফায় ঘটনার পরও বুধবার পর্যন্ত জেলা ও বিভাগের সিভিল প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কেউ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে না যাওয়ায় এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশী মামলায় যে ৫ জনকে আটক করা হয়েছিল বুধবার তাদের পুলিশী মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য, সোমবারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের পক্ষে দায়ের করা মামলায় ৫৭ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ৩ হাজার ২শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে বিএনপি নেতা ও বসতভিটা রক্ষা কমিটির নেতা লেয়াকত অন্যতম। অপরদিকে, নিহত মর্তুজা আলীর ভাই মওলানা বশির আহমদ দায়েরকৃত মামলায় ৬ জন নামীয়সহ ১৫শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায়ও বিএনপি নেতা লেয়াকত আসামী। তৃতীয় মামলাটি করেছেন নিহত জাকের হোসেনের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৫শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উত্তপ্ত পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ঘটনাকে নিয়ে অনেকের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনও কোন গ্রেফতার অভিযান শুরু করেনি। এদিকে গত শনি ও সোমবার পর পর দু’দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহতের প্রতিবাদে স্থানীয় ছাত্রঐক্য ফোরামের ডাকা হরতাল পালনে কেউ সাড়া দেয়নি। বাঁশখালীজুড়ে পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে ছাত্রঐক্য ফোরাম এ হরতালের ডাক দিয়েছিল। উল্লেখ্য, সোমবার রাত পর্যন্ত নিহতের কয়েক দফায় জানাজা হয়েছে। একটি জানাজায় চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নিজেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন বলে অবহিত করেন। অপরদিকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ বিরোধী সংগঠনের আহ্বায়ক বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী তালুকদারের ফাঁসির দাবিতে উপজেলা সদরে মানববন্ধন করেছে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজের পক্ষের লোকজন। কর্মসূচীতে অংশগ্রহণকারীরা লেয়াকতকে এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার নেপথ্য হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। বুধবার বাঁশখালীতে হরতাল আহ্বান করা হলেও তাতে সাধারণ জনগণের কোনই সাড়া মেলেনি। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। সকল ধরনের অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। হরতালে সাড়া নয়, বরং বড় ধরনের একটি উন্নয়নমূলক কর্মকা-কে বাধাগ্রস্ত করায় ক্ষুব্ধ আচরণ ব্যক্ত করেছে বাঁশখালীবাসী। এস আলম গ্রুপ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করে তা মেরে দেয়ার জন্য এই লেয়াকত নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বাঁশখালীর নিরীহ মানুষগুলোকে উত্তেজিত করেছে বলে অভিযোগ করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা। তারা এই বিএনপি নেতাকে সংঘর্ষের নেপথ্যে খলনায়ক হিসেবে উল্লেখ করে অনতিবিলম্বে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ৪ জন সাধারণ মানুষের দায়ভার এই নেতাকেই বহন করতে হবে। তারা আরও বলেন, বিএনপির এই নেতা কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প হতে আগেও আর্থিক সুবিধা নিয়েছিল। কাজ শুরুর পর আরও ১০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিল। চাঁদা না পেয়ে সাধারণ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে আন্দোলনে নামিয়েছে, যার ফলে ঝরেছে ৪টি তাজা প্রাণ। এদিকে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর গ-ামারা এলাকায় নিহতদের জানাজায় অংশ নেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেখানে তিনি নিজকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর ওয়েবসাইট হতে এই ঘটনায় সরকারের নির্মম হত্যাকা- বলে বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে। জানাজা ও ঘটনাস্থলে বিএনপি-জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি এবং জামায়াতের ওয়েবসাইটে এই ঘটনাকে বর্বরোচিত হিসেবে উল্লেখ করে উস্কানিমূলক প্রচারই সংঘর্ষের নেপথ্যে তাদের ইন্ধন রয়েছে বলে প্রমাণ হয় এমনই অভিমত এলাকাবাসীর। বুধবার বাঁশখালীর গ-ামারা এলাকার পরিবেশ ছিল শান্ত। আগের দিন মঙ্গলবার কিছু প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা গেলেও এদিন তা দৃশ্যমান হয়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় এলাকায় এখনও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত পুলিশ অবস্থান করছে। জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (দক্ষিণ) হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, কতিপয় ব্যক্তি তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সংঘর্ষের ঘটনায় ইন্ধন দিয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তে ঘটনার মূল রহস্য ও নেপথ্যে কারা ছিল সবই বেরিয়ে আসবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ নাছির উদ্দিন জানান, কেন্দ্রটি নির্মাণের সকল প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন তখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় সাধারণ জনগণকে আন্দোলনে নামিয়েছে। বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক লেয়াকত আলী তালুকদার এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে অনেক আগেই সুবিধা ভোগ করে নিজের ফায়দা লুটে নিয়েছে। সে আরও চাঁদা দাবি করেছিল। কিন্তু চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় সে এলাকার সাধারণ নিরীহ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়, যার ধারাবাহিকতায় গত সোমবারের এই রক্তক্ষয়ী ঘটনা। এখন এলাকায় এই নেতাকে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ জনগণ। সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার নেপথ্যের লেয়াকতকে অচিরেই গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আরিফউল্লাহর মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনিও এস আলম গ্রুপকে ওই এলাকায় জমি ক্রয় করে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন। বর্তমানে জামায়াতের এ নেতা অনেকটাই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। গত শনিবার ও সোমবার প্রথমে দুপক্ষের ও পরবর্তীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষ ঘটনার পরও বুধবার পর্যন্ত জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কোন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি, যা এলাকাবাসীসহ সকলকে হতবাক করেছে। বাঁশখালী এ ঘটনার পর চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের পর এ ধরনের ঘটনা কারও চিন্তাও আসেনি। উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণের সব অর্থ পরিশোধ করে তারা কাজে নেমেছে। কিন্তু কিছু সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র হয় অতি গোপনে। এলাকার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে এ কাজে হাত দেয়া হয়। এ কাজে জমির পরিমাণ নির্ধারিত করা হয়েছে ৬শ’ একর। পুরো জমিই উদ্যোক্তা গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের ক্রয়কৃত। প্রকল্প নির্মাণ কাজের শুরুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের অনেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দালালী করে মোটা অঙ্কের অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। আরও অর্থের লোভে বিএনপি ও জামায়াতের অসৎ প্রকৃতির নেতারা সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় এই বলে যে, আরও অনেক মানুষ ভিটা-বাড়ি ছাড়া হবে এবং এ ধরনের প্রকল্প প্রতিষ্ঠা হলে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত থাকবে। এমনকি মানুষের জীবন মৃত্যুর হুমকিতেও চলে যেতে পারে। এ জাতীয় বিভিন্ন স্লোগান তুলে গত শনিবার থেকে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। একদিন পর অর্থাৎ সোমবার তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়ে ৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।
×