ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পানামা পেপার্স এখন সামাজিক প্রতিবাদের হাতিয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৭ এপ্রিল ২০১৬

পানামা পেপার্স এখন সামাজিক প্রতিবাদের হাতিয়ার

কাওসার রহমান ॥ ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ায় এখন উত্তাল বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গন। পানামার আইনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার গোপন নথি প্রকাশ হওয়ায় বহু দেশের ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা এখন চাপের মুখে। ইতোমধ্যে কর ফাঁকির গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদের মুখে পদত্যাগ করেছেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমু-ুর ডেভিড গুনলাগসন। এত বড় তথ্য ফাঁসের ঘটনায় বিশ্বের বৃহত অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কোন রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীর নাম না এলেও সতর্ক হয়ে উঠেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি কর ফাঁকি রোধে আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করতে মার্কিন সিনেটের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এরই মধ্যে নিজের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। ফাঁস হওয়া এ তথ্যে হতবাক হয়েছেন ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা জমানোর খবর তিনি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনার এখানেই সার্থকতা। এই ঘটনা পুরো পৃথিবীকে একটি বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে একটি সম্ভাব্য সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে। জেলখানাই যে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের এক শতাংশের অবস্থান তা-ই উঠে এসেছে এ তথ্য ফাঁসের ঘটনায়। হালে তথ্য ফাঁস এখন একটি সামাজিক প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। প্রতিবাদের এ পথটি দেখিয়েছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকস। সত্যিকার তথ্য ফাঁস যে একটি কার্যকর সামাজিক প্রতিবাদ তা ইউকিলিকসই প্রমাণ দিয়েছে। জুলিয়াস এ্যাসাঞ্জ, চেলসিয়া ম্যানিং এবং এডওয়ার্ড সেøাডেনের তথ্য ফাঁস প্রতিবাদী সামাজকে উজ্জীবিত করেছে। এবারের তথ্য ফাঁসের ঘটনাটি অনেক বড়। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম আইনী প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত তথ্য এবার ফাঁস করা হয়েছে। ফাঁস করা হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ফাইল এবং ২.৬ টেরাবাইটস ডাটা। যা আগামী দিনে একটি নতুন যুগের আভাস দিচ্ছে। এই যুগটি হচ্ছে পেশাদারিত্বের সঙ্গে তথ্য ফাঁস। কারণ এবারের তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকরা। ফলে উইকিলিকসের শখের বসে তথ্য ফাঁসের যুগ এখন আর নেই। ভবিষ্যতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে তথ্য ফাঁসের ঘটনা যে ঘটবে তাই ইঙ্গিত করছে এবারের ঘটনা। একটি জার্মান সংবাদপত্রের হাতে মোসাক ফনসেকার গোপন দলিল আসার পর তারা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট’ নামের একটি সংস্থার কাছে সেসব তথ্য দেয়। এক বছরের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তবে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক কোটি পনের লাখ গোপন নথি ‘ফাঁস’ নয় বাইরে থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ল’ ফার্ম মোস্যাক ফনসেকা। পানামাভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার ও প্রতিষ্ঠাতা র‌্যামন ফনসেকা বলেছেন, আমাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বৈধ। আমরা কোন গোপন কাজ করি না। এটা ফাঁস নয়, হ্যাক।’ এ ঘটনায় এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান ৬৩ বছর বয়সী র‌্যামন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের কাছে থাকা কোন তথ্য নষ্ট করা হয়নি এবং প্রতিষ্ঠানটি কাউকে কর ফাঁকি বা মুদ্রা পাচারে সহায়তা করেনি বলেও দাবি ল’ ফার্মটির এ শীর্ষ কর্মকর্তার। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের মধ্যে এক অস্বত্বিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনায় আগামী দিনে অনেক ক্ষমতাবান রাজনীতিকই তার পদ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যেমনটি হারিয়েছেন আইস্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। যদিও অনেকেই অস্বীকার করছেন তাদের যোগসাজশের কথা। ভেতরে ভেতরে পরবর্তী করণীয় নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন। অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দুই ছেলে ও এক মেয়ের বিরুদ্ধেও। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নওয়াজ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেছেন, ‘খুব শীঘ্রই ঘটনা তদন্তে সুপ্রীমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছি আমরা। তাদের তদন্তেই সবকিছু প্রমাণ হবে। আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার ছেলেমেয়েরা নির্দোষ। সমস্ত আইন মেনেই তারা যুক্তরাজ্যে ব্যবসা করছে।’ গণমাধ্যমে ‘পানামা পেপারস’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরী বৈঠক করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। কর ফাঁকির কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে পুতিনের দুই ঘনিষ্ঠজনের নামও। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থকরা এ ঘটনাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন। ক্রেমলিনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, যে সাংবাদিকরা এই গোপন দলিল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে তাদের অনেকেই সিআইএ বা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা। ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা জমানোর খবর অস্বীকার করেছেন। খবরের বলা হয়েছে, মিস্টার বচ্চন ১৯৯৩ সালে অন্তত চারটি কোম্পানিতে নিযুক্ত হয়েছিলেন যেগুলো ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামায় নিবন্ধিত। সম্প্রতি পানামা পেপার্স নামে পরিচিতি পাওয়া যে গোপন দলিলপত্র ফাঁস হয়েছে, সেখানে ৫০০ ভারতীয়র নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে অমিতাভ বচ্চন এবং তার পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নামও রয়েছে। ক্ষমতাধর রাজনীতিক থেকে শুরু করে নামকরা সেলিব্রেটি- অনেকের কর ফাঁকির গোপন তথ্য বেরিয়ে এসেছে এসব দলিলপত্রে। ঐশ্বরিয়ার রাইর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এমন খবর সম্পূর্ণ অসত্য। খবরে বলা হয়, ২০০৫ সালে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানে ঐশ্বরিয়া রাই এবং তার পরিবারের সদস্যরা পরিচালক পদে ছিলেন। পরে ২০০৮ সালে ওই প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যায়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান ও সাবেক আটজন প্রভাবশালী নেতাও কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠে। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন। এ ঘটনার ব্যাপারে বেইজিং এখনও কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বাবা ইয়ান ডোনাল্ড ক্যামেরন। তার কোম্পানি ত্রিশ বছর ব্রিটেনে কোন কর দেয়নি বলে অভিযোগ। তবে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের দফতর থেকে জানানো হয়েছে, এই কোম্পানিতে মিস্টার ক্যামেরনের কোন শেয়ার নেই। কিন্তু কর ফাঁকির এই প্রবণতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রভাবশালী রাজনীতিকরা জড়িত আছেন কি নেই তা হয়ত তদন্তে প্রমাণিত হবে। তবে এই ঘটনা যে পুঁজিবাদ ব্যবস্থাকেই সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য এই সঙ্কট ও সমাজ পরিবর্তনের মধ্য মৌলিক পার্থক্য অনেক। সঙ্কট শব্দটিকে পুঁজিবাদেরই একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু এটা বড় কোন বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো এই ঘটনায় আগামী দিনে অনেক বড় রাজনীতিকের পদত্যাগ সমাজে স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু এটা মূল সমস্যার সমাধান নয়। কারণ পৃথিবীর শাসনভার মাত্র এক শতাংশ ভ-দের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এখনও ৯৯ শতাংশ রাজনীতিকের তথ্য অজানা। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের প্রাপ্তিও কম নয়। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের মানুষ অন্তত এ ধরনের বৈশ্বিক শক্রদের চিনতে পেরেছে। আপনি যে দেশেই বসবাস করুন না কেন, মূল সমস্যা হলো বৈশ্বিস সুশাসন। পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনা সেই প্রশ্নটিকেই তুলে এনেছে। ফোকাস করা হয়েছে, প্রভাবশালী রাজনীতিকরা যে বিশ্ব শাসন করছে তাদের এক শতাংশ ভ-। প্রশ্ন হলো এই ভ-দের হাত থেকে পরিত্রান।কেবল ৯৯ শতাংশ রাজনীতিকই এই গভীর সমস্যার সমাধান করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। নির্বাচনকে আন্দোলিত করার সঠিক লোকদের ক্ষমতায় নিয়ে এসে তাদের দিয়ে বিশ্ব শাসন করা। এক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি হলেও পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁস সার্থক হবে।
×