ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য দিবস ভাবনা;###;উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য চাই সরকারী বেসরকারী উদ্যোগের সমন্বয়

স্বল্পব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা শুধু সরকারী হাসপাতালেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৭ এপ্রিল ২০১৬

স্বল্পব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা শুধু সরকারী হাসপাতালেই

নিখিল মানখিন ॥ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। তার চাপ গিয়ে পড়ছে বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর। বিশেজ্ঞরা বলছেন, সরকারী হাসপাতালের তুলনায় অনেক গুণ বেশি চিকিৎসা খরচ হয়ে থাকে বেসরকারী হাসপাতালে। আর্থিক সঙ্কটে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর অকালে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। সরকারী উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগ কেন্দ্রিক। জটিল জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের মাত্রাও অনেকগুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ জটিল ধরনের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে পারে না। তবে জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম ইত্যাদি উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সফলতা পেয়েছে সরকার। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ঘটলে দেশের প্রত্যেক মানুষ স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পাবে। হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফিন্যান্সিং রিসার্চ দলের প্রধান জাহাঙ্গীর এ এম খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে চার শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা রবার্ট ইয়েটস বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারী বরাদ্দ বেশি হবে, না কম হবে তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি বলেন, যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে অগ্রসর হয়েছে বা কিছু সাফল্য অর্জন করেছে তা মূলত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ফলে। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাব্যয় ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারী হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারী ফি বেসরকারী হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ ॥ বেসরকারী হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা। দেশে ফার্মেসির সংখ্যা ও অবস্থা ॥ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে ফার্মেসির অনেক সম্পর্ক রয়েছে। ভেজাল ও ভুয়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে ঝুঁকিতে পড়তে পারে রোগীর জীবন। দেশে অনুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা মাত্র ৯৫ হাজার। তার মধ্যে আবার প্রায় ৬০ হাজার ফার্মেসির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। ওই সব ফার্মেসির মালিকরা গত দু’ থেকে ৫ বছর ধরে লাইসেন্স রিনিউ না করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশে মাত্র ৩৫ হাজার ফার্মেসি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর অননুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা হবে প্রায় সোয়া এক লাখ। সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই ওষুধের দোকান। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে অনুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা ৯৫ হাজার ১৯৬টি। বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা নেই ॥ বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে-এতে বয়স্ক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দেশে এখনও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। বয়স্ক ও অন্য বয়সী রোগীর রোগ ও রোগের চিকিৎসার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বয়স্ক হলে রোগই দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে না বা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করেন না বা ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগী সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। এমন ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও নজর দেয়া হয় না, এমনকি অনেক চিকিৎসকও যথার্থ মনোযোগ দেন না, হয়ত বার্ধক্যজনিত বলে মনে করেন। এভাবে অবহেলার ফলে অনেক রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ বৃদ্ধদের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার অভাব। স্বাস্থ্যসহ সেবা খাতগুলোও এ মুহূর্তে এই চাপ টানতে সেভাবে প্রস্তুত নয়, সরকার অবশ্য ইতোমধ্যেই বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষ করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ দিতে সন্তানদের বাধ্য করা হচ্ছে- চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ যা বলেন ॥ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো ও উন্নয়ন অতুলনীয় এবং বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র থেকে মফস্বল পর্যন্ত তথ্য প্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার এমন অবকাঠামো বিশ্বের কোথাও নেই। বিশ্বের অনেক দেশের চিকিৎসাসেবা অত্যাধুনিক হতে পারে। কিন্তু ওই সব দেশে স্বাস্থ্যসেবার ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী নয়। ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বিদ্যমান জনস্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্টি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ। চলমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওই অবস্থার জন্য থাকতে হবে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু ওই ধরনের প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বর্তমান জনস্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। যেখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন রশিদী-ই মাহবুব। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিক নির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ।
×