ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

... ‘আজি একাকী শুধু আমারে/ বাসিতে হবে ভালো’ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৭ এপ্রিল ২০১৬

... ‘আজি একাকী শুধু আমারে/ বাসিতে হবে ভালো’ -স্বদেশ রায়

পরমবন্ধু- জীবনবন্ধু মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন নৈবদ্য। এই নৈবদ্যের নায়ককে আমরা প্রতিদিনের জীবনে বারবার দেখি এবং তাঁর সারাশরীর মন দিয়ে বলতে শুনি- ‘ আজিকে তুমি ঘুমাও -আমি জাগিয়া রব দুয়ারে,/রাখিব জ্বালি আলো।/তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে/ বাসিতে হবে ভালো।’ বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর বইয়ে ঠাসা ছোট্ট ড্রয়িংরুমে একটি সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন ৪ তারিখ আছরের নামাজের কিছু আগে। বাদবাকি দুটি সোফায় বসে আছেন তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। ঘরে ঢোকার পরে ওনার পাশেই আরেকটা কুসনে বসলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, তাঁর পাশে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। সামনাসামনি একটা চেয়ারে বসে মানুষটির দিকে এক পলক তাকিয়েই আর তাকাতে পারিনি। সমস্ত শরীরের লোমগুলো কেমন যেন খাড়া হয়ে উঠল। মনে হলো নৈবদ্য’র নায়কের সামনাসামনি বসে আছি আমি। ন্যায়, সততা ও জ্ঞানে ঋজু একজন মানুষ আজ কেমন যেন বিকেলের শ্বেতজবার পাপড়ির মতো এলিয়ে পড়েছেন। তার শরীর দিয়ে যেন নৈবদ্য’র একাকীর নায়ক বলছেন-‘ তুমি তো ভালো বেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে/ বাসিতে হবে ভালো।’ সকাল দশটার দিকে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফোন করে বলেছিলেন, আপনাদের ভাবী না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তারপর যে কথাগুলো তিনি বলেছিলেন, তাতে চোখের জল কোন মতেই আটকে রাখতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, আমি যেন সাংবাদিক হিসেবে খালেদা জিয়ার কাছে একটি সংবাদ পৌঁছে দেই, খালেদা জিয়ার কোন এ্যাকাউন্টে তিনি টাকাগুলো পৌঁছে দিলে খালেদা জিয়া খুশি হবেন। তিনি বলেন, সাত বছর প্রতিদিন আপনাদের ভাবী আমাকে বলেছেন, আমার জন্য তোমার এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। আমি চাই না এই অপমান তুমি সহ্য করো। আজ তিনি সকল অপমানের ওপারে। মিসেস হকের শরীরে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে, তিনি বিচারপতি হিসেবে যে চিকিৎসা ভাতা পান সেই ভাতা নিয়ে তিনি তার স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ও তার লোকেরা গত সাত বছর যাবৎ বারবার বলেছেন, শেখ হাসিনা তাকে ওই টাকা ঘুষ দিয়েছেন। আর সেজন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায় লিখেছেন। জীবনের পরমবন্ধু হিসেবে, সারাক্ষণ পাশে থেকে মিসেস হক দেখেছিলেন, কী অপ্রতিরোধ্য সততাকে নিষ্ঠার সঙ্গে আটকে ধরে ওকালতি ও জজিয়তি জীবন যাপন করেছেন তাঁর কাছের মানুষটি। তাই এই চরম মিথ্যা অপবাদ ওই রুগ্ন শরীর নিয়ে সহ্য করতে পারতেন না মিসেস হক। রুগ্্ণ কেন, খালেদা বা তার লোকেরা কোন ভদ্রলোক সম্পর্কে যে ভাষায় কথা বলেন তা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষেও সহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু শুদ্ধ কালচার যার জীবন দেবতাকে গড়ে তুলেছেন, তার ভেতর তো ক্ষোভও থাকে না। তাই সকালে মিসেস হকের চিরবিদায়ের পরে, শোকাতুর এই বিচারপতি যতটুকুু ক্ষোভ আপন মানুষ মনে করে আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন। বিকেলের আগেই তিনি সকলের সামনে বললেন, সকালবেলায় তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আমাকে যা বলেছিলেন আমি যেন তাতে কিছু মনে না করি। মনে মনে শুধু ভাবলাম, শুধু ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে মারা যাওয়া মানুষদের স্বজনেরা নয়, কত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদের আঘাত খালেদার প্রতি। হয়ত তার এ নিয়ে কিছু হয় না। কারণ, যিনি ঠোঁটে লিপস্টিক মাখতে মাখতে মানুষ হত্যার নির্দেশ দিতে পারেন, তার কাছে ভদ্রলোককে অপমান করা তো অতি স্বাভাবিক কাজ। তাছাড়া সমস্ত অসংস্কৃত মানুষের ভেতর একটা বিষয় দেখা যায় তারা কোন ক্ষমতা পেলে মানুষকে অসম্মান করে, মানুষকে পীড়া দিয়ে আনন্দ পায়। কেন তারা এ কাজটি করে তা কিন্তু অজানা কোন বিষয় নয়। বাস্তবে জৈবিক প্রক্রিয়ায় মানুষ ও পশুতে কোন পার্থক্য নেই। মানুষ বাস্তবে মানুষ হয়ে ওঠে শুদ্ধ জীবনচর্যার ভেতর দিয়ে। যারা পারিবারিকভাবে ও সামাজিকভাবে এই শুদ্ধ জীবনচর্যার সুযোগ পায় না, তারা মানুষের মতো দেখতে হলেও তাদের ভেতরে পশুত্বই জাগ্রত থাকে। তারা পাশবিক আচরণই করে। তারা শক্তির জোরে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আনন্দ পায়। এ রকম আরেকটি আচরণ আরেকজনের পক্ষ থেকে করা হয় বিচারপতি খায়রুল হকের ওপর। এ খবর একজন সাংবাদিক হিসেবে নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমেই আমি পাই। এ নিয়ে আমি কোনদিন বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে কথা বলিনি। এমনকি সরকার বিষয়টি নিয়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তাও আমি জানি না। বাস্তবে জানার চেষ্টা করতেও কেমন খারাপ লেগেছিল। তবে মনে মনে কষ্ট পেয়েছি, আর ভরসা রেখেছি শেখ হাসিনার প্রতি। মনের সমস্ত জোর দিয়ে বলতে পারি, শেখ হাসিনাকে আমি জানি, আমি তাকে বুঝতে পারি। তাই ভরসা করেছি, উনি যদি জানতে পারেন তাহলে নিশ্চয়ই ওই পাশবিক আচরণটির সমাধান উনি তার অপার মানবিক গুণ (যা আমাদের অনেকের ভেতরও নেই) দিয়ে সমাধান করবেন মুহূর্তেই। ভরসা রেখেছিলাম মাননীয় আইনমন্ত্রীর ওপর। কারণ তিনি অনেক বড় মানুষের সন্তান। বিচারপতি খায়রুল হক বর্তমানে ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান। ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পারিবারিক চিকিৎসা ভাতা তার প্রাপ্য। কিছুদিন আগে মিসেস হককে নিয়ে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। বিলটি নিয়ে জটিলতা হয়। সাংবাদিক হিসেবে এ খবর পাবার পরে শুধু লজ্জিত হয়নি, ভাবতে কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, একথা যদি কোন সীতার ক্ষেত্রে নতুন কোন বাল্মীকির মতো কবি শুনতেন, তিনি নিশ্চয়ই উচ্চারণ করতে পারতেন, ধরণী দ্বিধা হও। অসুস্থতার পরে, মিসেস হক আর সাত বছর মাত্র বেঁচেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোন ধারণা নেই। তবে সাংবাদিকের যা স্বভাব, সব কিছু পড়তে ইচ্ছে করে। আমেরিকার মায়ো ক্লিনিকের ওয়েব সাইটে পড়েছি, ক্যান্সারের রোগীদের জন্য সব থেকে বেশি দরকার হয় মানসিক প্রশান্তি। তার বদলে সমাজ থেকে, রাজনীতি থেকে, রাষ্ট্রের একটি উঁচু অবস্থান থেকে মিসেস হককে করা হয়েছিল বারবার অপমান, যা তার জীবনের পরমবন্ধু, জীবনের বন্ধু খায়রুল হক বলছেন, তিনি প্রতিদিন বলতেন, ‘আমার জন্য তুমি আর কত অপমান সহ্য করবে?’ এই একটি বাক্য কতবড় গুরুভার, কী বিশাল শিলাখ- একটি মানুষের বুকের ওপর তা কি কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায়! ব্যাস, রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়ার হলে হয়ত প্রকাশ করতে পারতেন। আমার পক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে এই সমাজের একজন মানুষ হিসেবে করজোড়ে ক্ষমা চাইব বিচারপতি খায়রুল হকের কাছে, ক্ষমা চাইব জীবনের ওপারে চলে যাওয়া মিসেস হকের কাছে। যারা তাঁদের জীবনের বায়ু বিষিয়ে তুলেছিলেন, নিভিয়ে দিয়েছেন মিসেস হকের জীবনের আলো- ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করবেন কিনা জানি না- তবে বিচারপতি খায়রুল হক ও পরপারে চলে যাওয়া মিসেস হক, আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমরা আমাদের সমাজ বদলাতে পারিনি। সমাজে এখনও এই কালো কীটরা আছে। তারা অনেক শক্তি নিয়ে আছে এ সমাজে। যার ফলে জীবনের সময়টিকে দ্রুত সংক্ষিপ্ত করে চলে যেতে হয়েছে মিসেস হককে। বিচারপতি খায়রুল হক অনেক বড় বিচারক, তবে এ বিচার তাঁকে করতে বলব না, আমাদের আগামী প্রজন্মের যে বিচারকরা আসবেন তাঁরা যেন বিচার করে রায় দেন, মিসেস হক কি মারা গেছেন না তাঁকে হত্যা করা হয়েছে? [email protected]
×