ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ

উদ্বাস্তু সঙ্কট ও সন্ত্রাসের ছোবলে তুরস্ক

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৬ এপ্রিল ২০১৬

উদ্বাস্তু সঙ্কট ও সন্ত্রাসের ছোবলে তুরস্ক

মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে উদ্বাস্তুর ঢল ঠেকানোর চেষ্টায় গত ১৮ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করে। ঠিক হয় যেসব উদ্বাস্তু ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে বেআইনীভাবে ইউরোপে ঢুকবে তাদের তুরস্কে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এর বিনিময়ে তুরস্ককে সাহায্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরদিনেই এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ইস্তাম্বুলের অতি জনপ্রিয় বিপণি কেন্দ্রের রাস্তায় বোমাবাজ ও চার বিদেশী নিহত হয়। গত অক্টোবর থেকে তুরস্কে এনিয়ে ৫টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হলো। এতে প্রায় দুশ’ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। তাছাড়া জঙ্গী কুর্দীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও কয়েকশ’ মারা গেছে। সর্বশেষ বোমাবাজির দায়-দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে না এলেও পরদিন পুলিশ কর্মকর্তারা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) এক তুর্কী সদস্যকে হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছে। জাকার্তা থেকে সান বার্নারডিনো পর্যন্ত যেখানেই যত নৃশংস ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে তার কৃতিত্ব ও দায়-দায়িত্ব নিতে আইএস কখনই বিলম্ব করেনি। কিন্তু তুরস্কে এ পর্যন্ত যত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তার কোনটিরই এমনকি অক্টোবরে দুই বোমাবাজিতে ১০২ জনের প্রাণহানির ঘটনারও দায় আইএস নেয়নি। গত বছর সন্ত্রাসী হামলার জন্য সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের তালিকা বেশ দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। তুর্কী কর্মকর্তারা সেই তালিকায় অন্তর্গত সকলকে সন্দেহের আওতায় এনেছিল। যেমন তুরস্কের সমর্থনপুষ্ট প্রক্সি যোদ্ধারা যারা প্রেসিডেন্ট বাশার ও তার মিত্র রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিল, কুর্দীস্তান ও ওয়াকার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে যুক্ত যোদ্ধারা যাদের সঙ্গে তুরস্ক আবার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। এইভাবে যে তুরস্ক একদা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল সেই আগুন আজ ধীরে ধীরে তুরস্ককেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। তথাপি তুরস্কের নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকিটা স্বদেশজাত। দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে পিকেকের পরিচালিত সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি চলছে তুর্কী নিরাপত্তা বাহিনীর নির্মম দমন অভিযান যার পরিণতিতে প্রায় ৩শ’ অসামরিক ব্যক্তিসহ এক হাজারেরও বেশি নিহত হয়েছে। রকেটচালিত গ্রেনেড ও মেশিনগান সজ্জিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি নিয়ে অভিযান চালালে আশপাশের গোটা তল্লাট গোলাগুলির আওয়াজে প্রকল্পিত হয়। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে পরাজয়ের মুখে হটে গিয়ে পিকেকে এখন দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিভিলিয়ানসহ নমনীয় টার্গেটগুলোকে আঘাত হানার জন্য বেছে নিয়েছে। পিকেকের একটি দলছুট অংশ দাবি করেছে যে, গত দু’মাসে তারা আংকরায় ৬৬ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। পিকেকের এক কমান্ডারের ভাষায় সংগ্রামের এই পর্যায়ে তার যোদ্ধারা প্রয়োজনে যে কোন পন্থায় লড়াই চালাতে উদ্যত হয়েছে। সিরিয়ার দিক থেকে পাল্টা আঘাত, কুর্দী বিদ্রোহীদের উত্তরোত্তর র‌্যাডিকেল রূপ ধারণ এবং অন্যদিকে পিকেকের সমর্থক হিসাবে সন্দেহভাজন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দমন নিপীড়ন চালিয়ে তুরস্ক ধীরে ধীরে নির্যাতন ও সহিংসতার পাকচক্রে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা উপায় হয়ত বা ইইউর সঙ্গে সম্পাদিত নতুন চুক্তির মধ্যে রয়েছে। গ্রীস থেকে ফেরত পাঠানো উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে এবং চোরাচালানের রুট বন্ধ করতে রাজি হওয়ার বিনিময়ে তুরস্ক ইইউর কাছ থেকে বেশকিছু ছাড় আদায় করেছে। তার একটা হলো ইইউর সদস্যপদ লাভের প্রশ্নে সংস্থার সঙ্গে যে আলোচনা এতদিন স্থবির হয়ে ছিল তাতে নতুন করে গতি সঞ্চারের প্রতিশ্রুতি আদায়। আরেকটি হলো তুরস্কের, আশ্রয় দেয়া উদ্বাস্তুদের জন্য ৬৮০ কোটি ডলারের সাহায্যের অঙ্গীকার। যে দেশটির চলতি এ্যাকাউন্টের ঘাটতি ২০১৫ সালে ছিল ৩৩০০ কোটি ডলার সেখানে ঐ সাহায্যপ্রাপ্তি দেশটিকে বড় ধরনের স্বস্তি এনে দেবে। তবে অন্ততপক্ষে রাজনৈতিক বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রাপ্তিটা হলো জুন মাসের মধ্যে তুর্কীদের ভিসা ছাড়াই ইউরোপে যাওয়ার ব্যবস্থা। এটা তুর্কীদের কাছে একটা জাতীয় অহঙ্কারের বিষয়। আশাবাদীরা মনে করে ভিসা উদারিকরণের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে যেসব কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তাতে করে তুরস্ক আবার ইউরোপের কাতারে ফিরে আসবে এবং দেশটা যেভাবে স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের পথে নেমে যাচ্ছে সেই পতন রুদ্ধ হবে। ইউরোপের সঙ্গে নতুন করে সেতুবন্ধন রচিত হলে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের স্বৈরাচারী প্রবণতার রাশ টেনে ধরা যাবে এবং তার সরকারের ভেতরে মুষ্টিমেয় যেসব সংস্কারবাদী রয়েছে তাদের হাত শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু তারপরও এতে করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় তুরস্কের যা ক্ষতি হয়ে গেছে তার কোন প্রতিকার করা যাবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। সহিংসতা তুরস্কের পর্যটন শিল্পের ওপর মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় ইউরোপীয় ট্যুরিস্টরা তুরস্কে যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এতে পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হবে দেশটি। অর্থনীতিও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×