ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

কুর্দী রাষ্ট্র কত দূরে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৬ এপ্রিল ২০১৬

কুর্দী রাষ্ট্র কত দূরে

ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দীরা এই অঞ্চলের বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে একদিকে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে এবং অন্যদিকে তাদের শত্রু আইএস’এর উপর আঘাত হানা তীব্রতর করে তুলছে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে তাদের মধ্যে এখনও বড় ধরনের বিভাজন রয়ে গেছে। ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দীরা আইএসবিরোধী লড়াইয়ে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। তারা তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার সীমান্ত শহর কোবানে এবং উত্তর ইরাকের সিনজারে বড় ধরনের বিজয় অর্জন করেছে। আর এই প্রক্রিয়ায় তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখ- প্রসারিত ও সুসংহত করে চলেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পেশমারগা নামে পরিচিত ইরাকী কুর্দী বাহিনী নাওয়েরান ফ্রন্টলাইন থেকে আইএস অধিকৃত ইরাকের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় নগরী মসুলের ওপর রকেট হামলা চালাচ্ছে। তারা এতে গ্রান্ড ও কাতিউশা রকেট ব্যবহার করেছে। আইএস সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কুর্দীরা যেভাবে নিজেদের অবস্থান জোরদার করে তুলেছে তাতে উভয় দেশের কুর্দীরা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তথাপি এ অঞ্চলের সীমান্তে এক অভিন্ন ও অখ- কুর্দীস্তান গড়ে উঠার সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। গত মাসে ইরাকের কুর্দীস্তান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি এ বছরের শেষ দিকে স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত একটা রাষ্ট্রসত্তার আবির্ভাব হয়ত বা ঘটবে। তবে সিরিয়ার কুর্দীরা গত ১৭ মার্চ রোজাভা নামে একটা ফেডারেল অঞ্চলের যে ঘোষণা দিয়েছে তা এমনভাবে প্রণীত হয়েছে যাতে দেশটা অখ- থাকতে পারে এবং বিভক্ত না হয়। জেনেভা শান্তি আলোচনার বাইরে থাকলেও কুর্দী নেতারা বলেন যে, রোজাভা এক বিকেন্দ্রীকৃত সিরিয়ার মডেল হিসাবে কাজ করতে পারে। সিরিয়ার কুর্দীরা স্বাধীনতা অর্জনের পথে ইরাকী কুর্দীদের তুলনায় হয়ত এক ধাপ পিছিয়ে পড়ে আছে। তবে একপক্ষের স্বাধীনতা লাভের পথে এগিয়ে যাওয়া আর অন্যপক্ষের পিছিয়ে থাকার মধ্যে এই দুটি দেশের প্রধান কুর্দী দলগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্রটি ফুটে উঠে। বারজানির নেতৃত্বাধীন কুর্দীস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (কেডিপি) অভিযোগ করেছে যে সিরিয়ার ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টির (পিওয়াইডি) কুর্দী জাতীয়তাবাদের প্রতি অঙ্গীকারবোধের অভাব আছে। পিওয়াইডির বরং আবদুল্লাহ ওকালানের নেতৃত্বাধীন তুরস্কভিত্তিক কুর্দীস্তান ওয়াকার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওকালান বর্তমান সীমান্তের মধ্যেই কুর্দীদের কনফেডারেশনের পক্ষপাতী- পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। পিকেকে ও পিওয়াইডি পুঁজিবাদের বিরোধী। অন্যদিকে কেডিপি পুঁজিবাদের দৃঢ় সমর্থকÑ অন্তত তত্ত্বগতভাবে। সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দীদের মধ্যে বেশ টানাপোড়ন আছে। এই টানপোড়ন আরও বেড়েছে তুরস্কের সঙ্গে কেডিপির সহযোগিতার কারণে। তুরস্কে রয়েছে এক বিশাল এবং অশান্ত কুর্দী জনগোষ্ঠী। তুর্কী নেতারা কেডিপিকে পিকেকের একটা গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসাবে দেখেন। তাঁরা মনে করেন তুরস্কের অভ্যন্তরে সম্প্রতি যেসব হামলা হয়েছে তার জন্য পিকেকে-ই দায়ী। ওকালান রয়েছেন কারাগারে। কিন্তু তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সরকারী বাহিনী ও কুর্দীদের মধ্যে লড়াই চরম রক্তক্ষয়ী রূপে পৌঁছেছে। তুর্কী সরকার পিওয়াইডির প্রতিও বৈরীভাব পোষণ করে। পিওয়াইডির অভিযোগ, তুর্কী সরকার কুর্দী জঙ্গীদের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং আইএসকে পরোক্ষ সাহায্য সহায়তা দিয়ে সিরিয়া সীমান্ত বরাবর এক লাগোয়া রাষ্ট্রসত্তা গঠনে বাধা দিয়েছে। পিওয়াইডি রোজাভাকে একটা গণতান্ত্রিক এবং বহুমত ও পক্ষের স্থান হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে থাকে। তবে দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা নিজেরাই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। কোন কোন শহর থেকে তারা আরবদের লাথি মেরে বের করে দিয়েছে। অন্যান্য কুর্দী সংগঠন যেমন কেডিপির স্থানীয় শাখাকে কোণঠাসা অবস্থায় রাখা হয়েছে। সমালোচনাকারীদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারের সঙ্গে এক অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতি বজায় রাখলেও পিওয়াইডি যোদ্ধারা অপরাপর কুর্দীসহ অন্যান্য বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সিরিয়া থেকে তুরস্কে পালিয়ে আসা কুর্দী সাংবাদিক সুলতান জালাবির ভাষায় পিওয়াইডির চোখে প্রত্যেকেই শত্রু। ওদিকে কেডিপি রোজাভার সঙ্গে সীমান্তের ইরাকী অংশে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পিওয়াইডিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। স্বদেশে বারজানিও নানাবিধ সমালোচনার মুখে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আপত্তি অগ্রাহ্য করে আইএসবিরোধী লড়াইয়ের অজুহাত দেখিয়ে প্রেসিডেন্টের কার্যকাল অনির্দিষ্টকাল বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সমালোচকদের মতে গণভোটের যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন তার উদ্দেশ্য অনেক জটিল সমস্যা থেকে কুর্দীদের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। এদিকে কেন্দ্রীয় কোষাগারে তেল রাজস্ব না পাঠানোর জন্য বাগদাদ সরকার এই অঞ্চলটিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তেলের দরপতন, বাজেটের অর্থ না জোটা। প্রায় ২০ লাখ শরণার্থীর আগমন প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে ইরাকী কুর্দীস্তান আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দীরা বিতর্কিত ভূখ- গুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কঠরতর করে তুলেছে। যেমন ইরাকের তেলসমৃদ্ধ কিরকুক। তবে ইরাক ও সিরিয়াকে ভাঙ্গার ব্যাপারে বহির্বিশ্বের ব্যগ্রতা তেমন চোখে পড়ছে না। ফেডারেল রোজাভা ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে আমেরিকা। কুর্দীরা হয়ত একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছে। তবে তাদের মধ্যে শান্তি এখনও প্রহেলিকাই রয়ে গেছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×