ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাস্তায় চলাচল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী, আধা-সরকারী সংস্থাসহ সর্বত্রই কমবেশি লঙ্ঘিত ;###;হচ্ছে তাদের অধিকার

আইনী সুরক্ষা থাকলেও অবহেলিত প্রতিবন্ধীরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ এপ্রিল ২০১৬

আইনী সুরক্ষা থাকলেও অবহেলিত প্রতিবন্ধীরা

মশিউর রহমান খান ॥ সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও প্রতিনিয়ত সমাজে অবহেলিত হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে, শিক্ষাগ্রহণ, সরকারী ও বেসরকারী সকল চাকরিতে, পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে, অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের ভাতাপ্রাপ্তিতে, সড়ক-মহাসড়কের ফুটপাথে হাঁটতে কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের প্রায় ১৫ লাখ প্রতিবন্ধীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। শারীরিক, মানসিক কিংবা শ্রবণ প্রতিবন্ধী কেউই বাদ পড়ছে না এ অবহেলার হাত থেকে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে সরকারকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনী সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং সুস্থ মানুষের মতো তাদেরও সমানাধিকার প্রদানের কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অনেকেই প্রতিবন্ধীদের সমাজের অভিশাপ বলে মনে করেন। অথচ তারা আমাদের সমাজেরই লোক। তাদেরও রয়েছে এ দেশে সবার মতো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। রাষ্ট্র ও দেশের সংবিধান তাই বলে। বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন নতুন আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ হাতে নিলেও শুধুমাত্র ব্যাপক প্রচার না থাকা ও সকল শ্রেণীর নাগরিকদের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনা তৈরি না হওয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এককভাবে রাস্তায় চলাচলের কোন সুন্দর পরিবেশ নেই। এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার ঘোষিত ও বাধ্যতামূলকভাবে পালনের জন্য নির্দেশিত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারী বা আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে প্রতিনিয়তই লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছ থেকেও এ ধরনের মন্তব্য উঠে আসে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা নয়, সামাজিক এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলার পথের প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানসিকভাবে কোণঠাসা হয়েই সমাজে বসবাস করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা কত সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথক দুটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১০ থেকে ১৬ ভাগ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসাবে দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে সমাজকল্যাণ সংস্থা পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচী অনুযায়ী দেশে এ মুহূর্তে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৭১৬ জন। তবে অন্যান্য সংস্থার দাবি, দেশে প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। অনেক পিতামাতাই সমাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তার সন্তানকে প্রতিবন্ধী হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করতে রাজি হন না। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানের বেলায় তা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১৫.৭ শতাংশ। অথচ এই মানুষগুলোর জন্য ২১ বছর আগে প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) নির্মীয়মাণ ভবনে সবার জন্য প্রবেশগম্যতার বিষয়টি স্থান পায়নি। সংবিধানের ১৯(১) ও ২৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকল ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ২০০৭ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে এর বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। এ হিসেবে বিভিন্ন সরকারী ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতাকে উপেক্ষা করা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক অধিকারের কথা সমান বলা হলেও দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারী নির্দেশ অনুযাযী সড়ক-মহাসড়ক, ফুটপাথ, ফুট ওভারব্রিজসহ গণপরিবহন প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তেমন সাড়া মেলেনি। নির্দেশানুযায়ী প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ থাকার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের জন্য ছোট পাবলিক বাসে কমপক্ষে ৬টি ও বড় বাসের ক্ষেত্রে ৯টি আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি নিয়ে তেমন জনসচেতনতা না থাকায় এখনও এসব আসনে প্রতিবন্ধীরা বসতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৯০ শতাংশ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের সময় বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ওই সব ভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে ভবনগুলো হয়ে পড়েছে প্রতিবন্ধীবিরোধী। এসব ভবনে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস বা চলাচল করতে পারছেন না। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমাজের মূল ধারা থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে। বাস বা যে কোন গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের ওঠার সুযোগ থাকলেও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোন গণপরিবহনেই ওঠার সুযোগ নেই। বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বেলায় তা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া লাইন ধরে বাসে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীদের কোন প্রকার অগ্রাধিকার পর্যন্ত দিতে দেখা যায় না। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরে বসবাসকারী নাগরিকদের পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে যে কোন সুস্থ মানুষ ও প্রতিবন্ধীদের মাঝে বাসে বা পরিবহনের ওঠা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এক্ষেত্রে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বা শারীরিকভাবে দুর্বল বা প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বাধ্যতামূলক কোন আইন না থাকায় ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবহনে চলাচল করতে অপেক্ষা করতে হয়। বেশিরভাগ সময় অত্যধিক ভিড়ের চাপে নির্দিষ্ট পরিবহনে উঠতে না পারার কারণে প্রতিবন্ধীদের যাত্রা বাতিল করে বাসায় ফিরতে হয়। নির্ধারিত আসনে বসার জন্য নারীদেরই যেখানে তর্কযুদ্ধ চালাতে হয়, প্রতিবন্ধীদের আসনের নিশ্চয়তা তো নেই বললেই চলে। মূলত স্থাপনা ও ভবন অথবা ফুটপাথের পাশে ঢালু পথ বা র‌্যাম্প, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ব্রেইল ব্লক, লিফটে ফ্লোর এ্যানাউন্সমেন্ট, ব্রেইল বাটন, স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কিছু ছবির ব্যবহার বা ভবনের ম্যাপ তৈরি, কিছু বিশেষ রঙের ব্যবহার এসব প্রতিবন্ধী মানুষের চলার পথকে আরও সহজ করে। এসব পদ্ধতির কোন ব্যবহার না থাকায় প্রতিবন্ধী মানুষগণ চলাচলে ও সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর ৩২ ধারায় বলা আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার কর্তৃক সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সকল গণপরিবহনে মালিক বা কর্তৃপক্ষ তৎপরিবহনের মোট আসন সংখ্যার শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখিবেন। অপরদিকে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩-তেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ আইনের ধারা ২ (সংজ্ঞা)-এর উপধারা ১৩-এ বলা হয়েছে, ‘প্রবেশগম্যতা’ অর্থ ভৌত অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সকল সুবিধা ও সেবাসমূহে অন্যদের মতো প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণপ্রাপ্তির অধিকার।’ এছাড়া ‘জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা-২০১৩-এর ৪.৪-এ মহিলা, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য পরিবহন, ৪.৪.১-এ পথচারীদের জন্য পায়ে চলার পরিবেশ মানোন্নয়ন, বিশেষত শিশু, মহিলা, বয়স্ক এবং শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের (ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ) ব্যববহার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, ৪.৪.৪-এ রেলস্টেশন ও বাস স্টপে র‌্যাম্প ব্যবহার এবং নৌপথে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত সহজীকরণ, ৫.১.৫-এ শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পথচারীদের ফুটপাথে ওঠানামা সহজতর করার লক্ষ্যে ঢালু পথের (র‌্যাম্প) সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে ১ ইঞ্চি অনুপাত ১২ ইঞ্চি লম্বা র‌্যাম্প নির্মাণের কথা বলা হলেও কোন কোন জায়গায় ১ ইঞ্চি অনুপাতে ৩ ইঞ্চি র‌্যাম্প রয়েছে, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সর্বজনীন প্রবেশগম্যতায় শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদাগুলো সম্পূর্ণরূপেই উপেক্ষিত। কোথাও ইশারা ভাষার কোন ধরনের সহযোগিতা লক্ষ্য করা যায় না। তথ্য অনুসন্ধান নোটিসবোর্ড বা সিটিজেন চার্টার লোকেশন ম্যাপ নেই বললেই চলে। প্রবেশগম্যতা বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বুয়েট ও চুয়েটের প্রকৌশলী, ইশারা ভাষার দোভাষী ও স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল নিয়ে ওই নিরীক্ষায় এ তথ্য উঠে আসে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্রতিবন্ধী মানুষের সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা সম্পর্কিত বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। বিধিমালায় আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদ-ের বিধান যোগ করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আইনটি প্রয়োগ করবেন। তবে আজ পর্যন্ত এ আইনটির কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩তে বিভিন্ন স্থাপনায় প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর আলোকে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে অবহেলিতই রয়ে গেছে সকল আইন। প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে চলমান সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতে হুইলচেয়ারে ওঠার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য টেকটাইল এবং বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সঙ্কেত ভাষার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরদিকে সব ধরনের গণপরিবহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রেলের বগিতে হুইলচেয়ারে উঠতে রেলস্টেশনের প্লাটফর্মগুলো বগির সমান করা ও বগিতে হুইলচেয়ার সহজে ঢুকতে বগির প্রবেশ মুখগুলো বড় করতে হবে। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধীবান্ধব ফুটপাথ তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া সরকার এক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শহর ও গ্রামের সকল বাস স্টপেজকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। বাসগুলোতে অডিও সিস্টেম রাখতে হবে যাতে করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শুনে গন্তব্য এবং বাস সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। এছাড়া গণপরিবহন আমদানির লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সেগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব কিনা তাও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলাচল অনেকটা নিশ্চিত হবে। কিছুটা হলেও ফিরে পাবে তাদের অধিকার। এজন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে সরব হতে হবে ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মোঃ নুরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বা তাদের সুরক্ষা নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় ২৮ বছরেও কোন সরকার তেমন একটা ভাবেনি। বর্তমান সরকার ১৯৯৯ সালে প্রতিবন্ধীদের সুবিধা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসুবিধার কথা চিন্তা করে দেশে প্রথমবারের মতো প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফান্ড গঠন করে। এরপর প্রতিবন্ধীদের সুবিধার জন্য সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ২০০১ সালে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন প্রণয়ন করে। এরপর ২০১৩ সালে আবার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করতে ও একইসঙ্গে তাদের সুরক্ষা করতে যুগোপযোগী নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে। এছাড়াও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীসহ ৪ ধরনের প্রতিবন্ধীকে সুরক্ষায় ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। পূর্বে বাংলাদেশে সকল স্তরে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কোন ক্ষেত্র প্রস্তুত না থাকলেও বর্তমানে সরকার তাদের অধিকার ও সুরক্ষায় যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের সকল প্রকার তথ্য নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিবন্ধীকে আমরা পরিচয়পত্র প্রদান করেছি। ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্মার্টকার্ড দেয়ারও চিন্তা করা হচ্ছে। যার কাজ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলমান রয়েছে। এছাড়া দেশের সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের সময় র‌্যাম্প তৈরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে প্রায় ১০ হাজার বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের চলাচলে সহজগম্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবন্ধীর অধিকার রক্ষার বৈশ্বিক আন্দোলনে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রধান নেতৃত্বে রয়েছে। এছাড়া কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে বিদ্যালয়ে পড়তে না দেয়া হলে উক্ত ব্যক্তিকে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দিয়ে আইন করা হয়েছে। এ আইনে দোষী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত শাস্তি ও অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালের পর সকল সরকারী ভবন ও বেসরকারী অথচ সবার জন্য উন্মুক্ত এসব ভবনেও আলাদা র‌্যাম্প তৈরি বা লিফট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাস্তায় চলাচলে প্রতিবন্ধীদের সহজগম্যতা সম্পর্কে মহাপরিচালক বলেন, বর্তমানে চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এজন্য আমরা প্রতিবন্ধীদের রাস্তার ফুটপাথে হাঁটার সুবিধা করতে বিশেষভাবে ফুটপাথ তৈরির জন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। এছাড়া আগামী ৬ মাসের মধ্যে রাজধানীর রাস্তায় বিআরটিসির ১০০টি বাস নামানো হবে। যাতে বাসের দরজা ফুটপাথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হবে। ফলে কোন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বা শারীরিক প্রতিবন্ধীর বাসে উঠতে কোন সমস্যা না হয়। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এছাড়া ট্রেনে চলাচলের জন্য কোচের দরজাও ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে তৈরির কথা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তবে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় তাই সমাজের সকল স্তরের লোজনের সহায়তায়ই কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সুরক্ষা করা সম্ভব। এজন্য সমাজের সকল বিবেকবান মানুষের এগিয়ে আসা উচিত।
×