ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষবরণ

প্রাচীনতম লোকশিল্পের অনুষঙ্গ চিত্রিত শখের হাঁড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ এপ্রিল ২০১৬

প্রাচীনতম লোকশিল্পের অনুষঙ্গ চিত্রিত শখের হাঁড়ি

মোরসালিন মিজান ॥ মাটির নরম স্বভাবটি কাজে লাগিয়েই মৃৎপাত্র। গ্রামীণ জীবনে এর বহুবিধ ব্যবহার। গৃহস্থালি কাজে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়। তবে শখের হাঁড়ি আর সব হাঁড়ি থেকে আলাদা। এটি বিশেষ ধরনের। চিত্রিত হাঁড়ি। উজ্জ্বল রঙে আঁকা। খুব সহজেই নজর কাড়ে। নিত্য ব্যবহার্য নয় বরং আনন্দঘন উপলক্ষে, উৎসব পার্বণে ব্যবহার করে আসছে বাঙালী। রেওয়াজটি বহুকালের। এখনও আবেদন ফুরোয়নি বরং ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে শখের হাঁড়ি। শখের হাঁড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা চলে এর সৌন্দর্য। আকার-আকৃতির দিক থেকে সাধারণ হাঁড়ির মতোই। পার্থক্য যা, গায়ে। এর গায়ে দৃষ্টি নন্দন চিত্র আঁকা হয়। প্রাধান্য পায় উজ্জ্বল রং। ফলে আর সব মৃৎপাত্র থেকে আলাদা হয়ে ধরা দেয়। প্রাকৃতিক রঙে আঁকা লোকচিত্র স্বতন্ত্র মর্যাদার। গায়ে লাল-হলুদ-সাদাসহ বিভিন্ন রঙের আলপনা আঁকা থাকে। ফুল, লতা-পাতা, পাখি, মাছÑ কত কী যে দৃশ্যমান হয় হাঁড়ির গায়ে! এই কারুকৃতি ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ জীবনাচার, উৎসব, সংস্কার, ধর্মসহ নানা কিছু। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। লোকশিল্পের সার্থক প্রকাশ ঘটে এই ধারার কাজে। একইভাবে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কারগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে আজকের শহুরে প্রজন্ম। কোন হাঁড়ি এত সুন্দর করে গড়ে নেয়ার মূল কারণ, এর বিশেষ ব্যবহার। বিয়েসহ সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে শখের হাঁড়ি ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। শৌখিন মানুষ শখের হাঁড়িতে করে মিষ্টি বহন করতেন। তিলা, কদমা, নাড়ু, মুড়কি, মোয়া ও অন্যান্য মিষ্টি খাবার শখের হাঁড়িতে পুরে উপহার হিসেবে কুটুম বাড়িতে পাঠানো হতো। জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে মেয়ে বিদায়ের সময় তাঁর সঙ্গে শখের হাঁড়ি দেয়ার রেওয়াজ ছিল। প্রথম সন্তান প্রসবের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে এই হাঁড়ি নিয়ে যেতেন। এই হাঁড়ি শখের চুকাই ও ঝাঁপি নামেও পরিচিত। এর সঙ্গে সিকরা হাঁড়ি ও বাটা নামে আরও দুটি হাঁড়ি দেয়া হতো। এখন শহুরে শৌখিন মানুষ ড্রইংরুম সাজায় কারুকাজম-িত হাঁড়ি দিয়ে। ১৪০৬ খ্রীস্টাব্দে চীনা পর্যটক মা-হুয়ানের ভ্রমণসাহিত্যে শখের হাঁড়ির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। লোকজ শিল্প নিয়ে এক সময় কাজ করেছেন জাদুঘরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, শখের হাঁড়ির দুটি ধারা রয়েছে। বিশেষ এক ধরনের কাজ হয় রাজশাহীর বাঁয়া, বসন্তপুর ও নবাবগঞ্জের বারোঘরিয়ায়। এসব হাঁড়ির হলদে জমিন। সে জমিনের ওপর লাল, নীল, সবুজ ও কালো রঙে আঁকা হয় হাতি, ঘোড়া, মাছ, শাপলা, পদ্ম, দলদাম, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, পেঁচা, কবুতর ইত্যাদি। ভিন্ন রীতি অনুসরণ করেন নওগাঁর বাঙ্গালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তাঁদের হাঁড়িগুলোর গায়ের রং লাল। তার ওপর সাদা কালো ও সরষে ফুলের রঙে আঁকা হয় মাছ, চিরুনি, পাখি, পদ্মফুলের মোটিফ। ৮ থেকে ৯টি পরিবার এসব হাঁড়ি তৈরির কাজ করেন। ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকায়ও শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। নয়ারহাট, ধামরাই, রায়েরবাজারে কুমোররা যতেœর সঙ্গে এ কাজ করে থাকেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শখের হাঁড়ি তৈরির কাজ হয়। অঞ্চল ভেদে শখের হাঁড়ির আকার ও স্টাইলে পার্থক্য লক্ষণীয়। কোন কোন শখের হাঁড়িতে হাতল থাকে। কোনটি হাতলবিহীন। কোন অঞ্চলের হাঁড়িতে ঢাকনা থাকে। কোনটির আবার হাঁ করা মুখ। সব হাঁড়ি-ই গ্রামীণ মানুষের রুচি ও শৌখিন মানসের পরিচয় বহন করে। বাংলার কৃষ্টিকে তুলে ধরে। লোকশিল্পের গৌরব প্রচার করে। এখানেই বিশেষত্ব শখের হাঁড়ির।
×