ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মসমর্পণের পর ৫ মামলায় জামিন পেলেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ এপ্রিল ২০১৬

আত্মসমর্পণের পর ৫ মামলায় জামিন পেলেন খালেদা জিয়া

কোর্ট রিপোর্টার ॥ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার পাঁচটি মামলায় ঢাকার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন। পাঁচজন বিচারক পৃথকভাবে শুনানি গ্রহণ করেন। খালেদা জিয়া প্রথমে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে যাত্রাবাড়ী থানার এক মামলায় আত্মসমর্পণের উদ্দেশে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের দ্বিতীয় তলার এজলাসে পৌঁছান। পৌনে ১১টায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোঃ কামরুল হোসেন মোল্লা এজলাসে ওঠার পর শুনানি শুরু হয়। বিচারক এজলাসে ওঠার পর আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার বসার অনুমতি চাইলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। এরপর কাঠগড়ার পাশে আগে রাখা একটি চেয়ারে খালেদা জিয়া বসেন। যাত্রাবাড়ী থানার পেট্রোলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার বিশেষ ক্ষমতা আইনের এই মামলায় গত ৩০ মার্চ একই বিচারক খালেদা জিয়াসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। মামলাটিতে বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের পক্ষে আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিনের আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন এবং সাবেক এটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মাদ আলী জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করেন। শুনানিতে তারা বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের এই মামলায় কাউকে আসামি করতে হলে তাকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে। যাত্রাবাড়ীর ওই ঘটনার দিন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। তাই এই মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশীট হওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। আইনজীবীরা আরও বলেন, তাদের মক্কেল একজন মহিলা এবং তিনি ৩ বারের প্রধানমন্ত্রী। তাই পালাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এই পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, খালেদা জিয়া সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না এ কথা সত্য। তবে তার ডাকা কর্মসূচীর কারণে তারই নির্দেশে সেদিন এই ঘটনা ঘটে। তাই আমি তার জামিনের বিরোধিতা করছি। শুনানি শেষে বিচারক সোয়া ১১টার দিকে খালেদা জিয়া এবং মাহবুব হোসেনের জামিন মঞ্জুর করেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর খালেদা জিয়া একই ভবনের ৬ তলায় অবস্থিত ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার শুনানির জন্য সাড়ে ১১টার পৌঁছান। ওই আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জামিন আবেদনের ওপর শুনানিতে বলেন, উচ্চ আদালত থেকে তিনি এই মামলায় জামিনে ছিলেন। উচ্চ আদালত তাকে মামলাটিতে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। আদালতে নির্দেশনা রয়েছে জামিন বিবেচনা করার জন্য। তাই আমরা তার জামিন প্রার্থনা করছি। এরপর দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল মামলায় খালেদা জিয়ার দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠলে দুই পক্ষে মৃদু বাগ্্বিত-া হয়। দুই পক্ষেরই আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর বিচারক আবু আহমেদ জমাদার বলেন, আমি আসমি খালেদা জিয়ার ১ লাখ টাকা মুচলেকায় জামিন মঞ্জুর করছি। তবে এ মামলায় তার সন্তান কোকো আসামি রয়েছেন। তিনি মারা গেলেও তার মৃত্যুর কোন সনদ আদালতে এখনও দাখিল হয়নি। তাই আগামী ১৪ এপ্রিল ধার্য তারিখে মৃত্যুর সনদ আপনারা দাখিল করে দেবেন। দুই মামলায় জামিন হওয়ার পর আরও ৪টি মামলায় জামিন আবেদনের শুনানির জন্য খালেদা জিয়া বেলা ১২টার ১০ মিনিটে ঢাকা সিএমএম আদালতের দ্বিতীয় তলার ২৮ নম্বর এজলাসে পৌঁছেন। ওই আদালতে প্রথমে ঢাকা মহানগর হাকিম জাকির হোসেন টিপু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জামিন আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, বেগম খালেদা জিয়া সেদিন যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কোন উপাদান ছিল না। একজন ব্যক্তিকে সরকার অনুমতি দিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এই মামলা দায়ের করিয়েছেন। সমন জারি হওয়ায় সম্মান দেখিয়ে তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করছেন। এই মামলায়ও জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মীমাংসিত বিষয় শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সেদিন খালেদা জিয়া বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগে কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই। এ কারণে আমরা তার জামিনের বিরোধিতা করছি। শুনানি শেষে বিচারক ৫ হাজার টাকা মুচলেকায় এই মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর গুলশান থানার একটি নাশকতার মামলায় জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলাম। এই মামলায় আসামি এবং রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি শেষে বিচারক ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর যাত্রাবাড়ীতে পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যা ও বিস্ফারক আইনের মামলায় জামিন আবেদনের শুনানি গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন। মামলাটিতে খালেদা জিয়া ছাড়াও এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের পক্ষে জামিনের আবেদন করা হয়। এই মামলাটিতে আসামিপক্ষে এ্যাডভোকেট জায়নুল আবেদীন এবং এজে মোহাম্মাদ আলী ও সানাউল্লাহ মিয়ার বক্তব্যের পর বিচারক বলেন, মামলাটিতে চারজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রয়েছে। এ সম্পর্কে বলুন। এ সময় উক্ত আইনজীবীরা বলেন, মামলাটিতে চার্জশীট হলেও চার্জশীট এখনও গ্রহণ হয়নি। তাই আমরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পড়তে পারিনি। আর তিনি (খালেদা জিয়া) হুকুম দিয়েছিলেন কিনা তা ট্রায়ালের সময় দেখা যাবে। শুনানি শেষে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নুর গুলশান থানার জামিন হওয়া মামলায় তার ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতির আবেদন মঞ্জুর করেন। বেলা ১টার দিকে সকল মামলায় জামিন হওয়ার পর খালেদা জিয়া আদালত অঙ্গন ছেড়ে যান। জামিন আবেদনের শুনানির সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, এ্যাডভোকেট সামসুর রহমান শিমুল বিশ^াস, শাহজাহান ওমর, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, এজেড এম জাহিদ হোসেন, সেলিমা রহমান, সঙ্গীত শিল্পী বেবি নাজনীন প্রমুখ। খালেদা জিয়া আদালতে আসা উপলক্ষে আদালত চত্বর ও তার বাইরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। যেসব মামলায় জামিন ॥ ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। এ ঘটনায় যাত্রী হত্যার অভিযোগে পরদিন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কেএম নুরুজ্জামান। ২০১৫ সালের ৬ মে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) বশির উদ্দিন খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। যাত্রাবাড়ীর ওই একই ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৫ সালের ১৯ মে খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই মামলায় গত ৩০ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামি পরস্পর যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যাটকোকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি ও চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পাইয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি করেন। এ ঘটনায় ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী তেজগাঁও থানায় এ মামলা করেন। সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় ঘেরাওয়ের পথে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে বোমা হামলা হয়। এ জন্য দায়ী করে গুলশান থানায় বেগম খালেদা জিয়াসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ঈসমাইল হোসেন বাচ্চু। এছাড়া ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজকে বলা হয় এত লক্ষ শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।’ ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদী এই মামলা করেন। মামলায় বেগম জিয়াকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়া হয়।
×