ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ, বাস ভাড়া কমবে কি?

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ এপ্রিল ২০১৬

তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ, বাস ভাড়া কমবে কি?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিনধাপে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু পরিবহন ভাড়া কমানোর কোন উদ্যোগ নেই মালিকদের। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এ বিষয়ে এখনই কিছু ভাবতে নারাজ। পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২৬ বছরে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় প্রায় পাঁচ গুণ। মূলত ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণেই বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ে ডিজেলের দামও বেড়েছে চার গুণ। ১৯৯০ সালে ডিজেলের দাম ছিল প্রতিলিটার ১৭ টাকা। ওই সময় বাসভাড়া প্রতিকিলোমিটারে ছিল ৩২ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম প্রতিলিটার ৬৫ টাকার বেশি। আর বাসভাড়া হয়েছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এছাড়া পাঁচ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে ১০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়। আর পাঁচ টাকা তেলের দাম কমানো হলে ভাড়া কমে দুই টাকা। গেল ২৬ বছরে যতবার ভাড়া কমানো হয়েছে এর একবারও যাত্রীরা সুফল পাননি। প্রকৃত অর্থে ভাড়া কমানোর বিষয়টি ছিল কাগজে-কলমে। এতে লাভবান হয়েছে পরিবহন মালিকরাই। নীরবে পকেট কাটা গেছে যাত্রীদের। তাছাড়া ভাড়া কমানোর পর তা কার্যকর করতে কখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আন্তরিক ভূমিকা পালন করেনি। ২০০১ সালে নেত্রকোনা থেকে ঢাকার বাস ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৭০ টাকা। গেল ১৬ বছরে তা দাঁড়িয়েছে ২৫০ টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ে ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় চারগুণ। এই সময়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার বাস ভাড়া ছিল ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত। এখন ২২০ টাকা। যমুনা সেতু হওয়ার পর ঢাকা থেকে রাজশাহীর বাস ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। একই সময়ে ঢাকা থেকে পাবনার ভাড়া ছিল ২৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৩৭০ টাকা হয়েছে। ২০০১ সালের দিকে ঢাকা থেকে হালুয়াঘাটের বাস ভাড়া ছিল ১৫০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। একই সময়ে ঢাকা থেকে দিনাজপুরের বাস ভাড়া ছিল ১৭০ টাকা। এখন কোন কোন বাসে ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। জ্বালানির দাম কমলেও এবার বাস-মিনিবাসের ভাড়া কমানোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন মালিকরা। তাদের দাবি, বাস ভাড়া কেবল তেলের দামের কারণে বাড়ে না। এর সঙ্গে অনেক কিছু যুক্ত আছে। সেগুলোর দাম তো কমছে না। যদিও ১৯৯০ সাল থেকে যতবার তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, ততবারই বাস ভাড়া বেড়েছে। তখন অন্য কোনকিছুর দাম কমা বা বাড়ার হিসাব করা হয়নি। বাস ভাড়া কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠ’কে বলেন, তেলের দাম কমানোর পর ভাড়া কমানো নিয়ে ভাবব। এখন পর্যন্ত আমাদের এ নিয়ে কোন প্রস্তুতি বা আলোচনা নেই। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আমাদের কিছু বলা হয়নি। তিনি বলেন, যদি সবাই চায় তাহলে ভাড়া কমবে। তবে এখন মোটরপার্সের দাম বেড়েছে অনেক। ভাড়া কমানোর আগে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ইচ্ছে করলেই ভাড়া কমানো কঠিন। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, ভাড়া কমানোর বিষয়টি নির্ভর করবে কতটুকু দাম কমল, তার ওপর। আর ভাড়া তো শুধু তেলের দামের ওপর নির্ভর করে না। এ ক্ষেত্রে ২৪টি উপাদান বিবেচনা করা হয়। আজ থেকে কয়েক বছর আগে এই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে। যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে যদি কমানো যায়, তবেই ভাড়া কমানো হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, তেলের দাম কমলেও অন্য সবকিছুর দাম অনেক বেড়েছে। তাই দাম কমলে ভাড়া কমবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। তিনি জনকণ্ঠ’কে বলেন, ২৪টি বিষয়ের ওপর আলোচনা করে ভাড়া কমানো ও বাড়ানোর বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের সংশ্লিষ্টতাই বেশি। কারণ বাস চালানোর জন্য তেল খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয়। এখন তেলের দাম কমলে বাকি ২৩টি বিষয় আগের মতোই। অর্থাৎ বাড়তি। সেই সঙ্গে স্টাফদের বেতনও বেড়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সবকিছুর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিবছর দূরপাল্লার বাস ভাড়া নির্ধারণের কথা আছে। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমরা চিন্তা করেছিলাম মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাব। এখন তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়ায় তা এখন হচ্ছে না। তেলের দাম কমানো হলে মালিকরা আশা করি অন্যান্য ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারবেন। তেলের দাম কমানোর পর আমরা আলোচনা করে ভাড়া কমানো বাড়ানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেব। তবে ট্রাকের ভাড়া কমবে কিনা এ বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পরিবহন সেক্টর নিয়ে কাজ করছে এ রকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, ডিজেল বাসের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ জ্বালানির চাহিদা রয়েছে, তার শতকরা ৪৫ ভাগই পরিবহন খাতের। বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বাস ভাড়া প্রতিকিলোমিটারের জন্য ৩২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় ডিজেলের দাম ছিল প্রতিলিটার ১৭ টাকা। তেলের দাম বাড়ার কারণে এরপর নয়বার বাস ভাড়া বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি সর্বশেষ প্রতিকিলোমিটারের ভাড়া ১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়। এ সময় তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ টাকায়। ডিজেলেরে মূল্য লিটারপ্রতি ২০ টাকা হওয়ার পর ২০০৩ সালের ৯ মার্চ কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ পয়সা। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২৬ টাকা হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাস ভাড়া বাড়িয়ে কিলোমিটারপ্রতি ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালে জুলাই মাসে জ্বালানি তেলের লিটারপ্রতি দাম হয় ৫৫ টাকা। তখন ফেরি ভাড়া বাদে কিলোমিটার প্রতি বাস ভাড়া হয় এক টাকা পাঁচ পয়সা। একই বছরে তেলের দাম কমে লিটারপ্রতি হয় ৪৮ টাকা। তখন কোন ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই লিটারপ্রতি সাত টাকা তেলের দাম কম হওয়ায় কিলোমিটারপ্রতি সাত পয়সা ভাড়া কমানো হয়। যা যথাযথ কার্যকর হয়নি। ২০০৯ সালের জ্বালানি তেলের দাম আরেকদফা কমে লিটারপ্রতি দাঁড়ায় ৪৪ টাকা। তখন চার পয়সা ভাড়া কমানো হয়। ২০১১ সালে লিটারপ্রতি তেলের দাম ৪৬ টাকা হওয়ায় প্রতিকিলোমিটারে বাস ভাড়া এক টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে আরেক দফা বাড়ে তেলের দাম। ২০১২ সালে ফের তেলের দাম বেড়ে লিটারপ্রতি হয় ৬১ টাকা। তখন কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া হয় এক টাকা ৩৫ পয়সা। এরপর ২০১৩ সালে তেলের দাম বৃদ্ধির পর আন্তঃজেলায় কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠ’কে বলেন, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশিরভাগ রুটে বাড়তি অর্থ যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। মানুষের পকেট কেটে টাকা নিয়ে যাচ্ছে পরিবহন মালিকরা। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামে ২৬০ কিলোমিটার রাস্তার জন্য ৩৩০ টাকা ভাড়ার স্থলে নেয়া হচ্ছে ৪৮০ টাকা। ঢাকা-সিলেট রুটে ২৯০ টাকা সর্বোচ্চ ভাড়ার স্থলে যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৪৮০ টাকা। ময়মনসিংহ রুটে নেয়া হচ্ছে ২২০ টাকা। এটা মোটেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, তেলের মূল্য কমানোর সুবিধা বাসমালিকরাই শুধু পাবেন। সাধারণ মানুষ যদি এই সুবিধা না পায়, তাহলে দাম কমানোর প্রয়োজন নেই। তিনি অভিযোগ করেন, এর আগে তেলের দাম কমার পর মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে মালিকরা বলেছেন ভাড়া কমাবে, কিন্তু আদতে ভাড়া কমেনি অথচ তেলের দাম বাড়লে ওই বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে নতুন ভাড়া যোগ করে সরকার-নির্ধারিত হারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া হয়ে যায়। তিনি বলেন, অতীতে যতবার বাস ভাড়া কমানো হয়েছে এর সুফল যাত্রীরা পাননি। এবারও তেলের দাম কমানোর পর বাস ভাড়া কমানো জরুরী। কিন্তু ভাড়া কমানো হলে যাত্রীরা এর সুফল কতটুকু ভোগ করবেন এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তেলের দাম কমানোর পর ভাড়া কমানোর বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে কোন প্রস্তুতিও নেই। তবে সরকার চাইলে মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে কমানো যেতে পারে। এ সংক্রান্ত একটি কমিটিও রয়েছে। যারা ব্যয় বিশ্লেষণ করে ভাড়া কমানো ও বাড়ানোর বিষয়টি নির্ধারণ করে থাকেন।
×