ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন হাজার ব্যক্তির নামে মামলা, প্রতিবাদ বিক্ষোভ

জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনে রক্তাক্ত বাঁশখালী

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৬ এপ্রিল ২০১৬

জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনে রক্তাক্ত বাঁশখালী

চট্টগ্রাম অফিস/জোবাইর চৌধুরী, বাঁশখালী ॥ বাঁশখালীর গ-ামারা ইউনিয়নে বেসরকারী পর্যায়ের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে সোমবার সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সরকারবিরোধী এলাকার জামায়াত-বিএনপির শক্তিশালী একটি চক্র। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল সরকারী দল সমর্থিত এবং গোপন পথে অবৈধ আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত কিছু নেতাকর্মী। যে কারণে বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রকল্প এলাকাটি রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। সোমবার বিকেলে এ ঘটনার পর রাত ৯টা পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিল জেলা পুলিশ। রাত ১২টার দিকে চমেক হাসপাতালে আহত আরেকজনের মৃত্যু ঘটে। ফলে এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৪ জনে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ আনসারসহ অর্ধ শতাধিক আহতদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখনও কোন গ্রেফতার নেই। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ জনকে আটক রাখা হয়েছে। এদিকে, ঘটনার পর সোমবার রাতেই বিক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে আবারও বিক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে মানববন্ধ করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। বাঁশখালীর সচেতন নাগরিক সমাজ, বাঁশখালীর সচেতন নাগরিক পরিষদ ও ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এই মানববন্ধন হয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার গ-ামারায় কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে প্রয়োজনে আরও রক্ত দিয়ে এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ ঠেকানো হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে সমাবেশে বলা হয়েছে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ বাদ দিয়ে অন্য যেকোন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগী হলে এলাকাবাসী স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। এ প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে সচেতন নাগরিক ফোরামের ব্যানারে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গ-ামারা ইউনিয়নে বেসরকারী পর্যায়ে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে মুখোমুখি অবস্থান ও ত্রিমুখী সংঘর্ষের জের ধরে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠছে উপকূলবাসী। দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে ওই এলাকায়। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় মঙ্গলবার পুলিশ ও নিহতের স্বজনের পরিবার বাদী হয়ে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেছে। মামলায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও সাড়ে ৩ হাজার জনকে আসামি দেখানো হয়েছে। এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সুবিধাবঞ্চিত কতিপয় নেতা। তাছাড়া একটি মহল এই ঘটনাকে বৃহৎ আকারে রূপ দেয়ার জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার ও গুজব চালিয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এলাকার পরিবেশ থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ ও নিহতের স্বজনের পরিবারের পক্ষ থেকে ৩টি মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম দক্ষিণ মোঃ হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সোমবার সংঘটিত ঘটনা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে বিপক্ষে দুইটি গ্রুপের মধ্যে ঘটেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করতে গেলে বিদ্যুত কেন্দ্র বিরোধীরা বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। সংঘর্ষের ঘটনায় ৪ জন নিহতের বিষয়টিও তিনি নিশ্চিত করেছেন। তবে কোন পক্ষের গুলিতে তারা নিহত হয়েছেন এই বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে বেরিয়ে আসবে বলে জানান। নিহত ৪ জনের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি। বর্তমানে এলাকায় পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত ॥ গত কিছুদিন যাবত গন্ডামারা এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে দুইটি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। শনিবার একটি পক্ষ এস আলম গ্রুপের মালবাহী গাড়িতে হামলা করে মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। সেই ঘটনায় এস আলম কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করলে পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামি ধরতে এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ৭ জনকে আটক করা হয়। আটকের প্রতিবাদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রবিরোধী একটি পক্ষ সোমবার পশ্চিম গন্ডামারার হাজীর পাড়া এলাকার মুজিব কেল্লার মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। পাশাপাশি একই এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষে স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার সামশুল আলমের নেতৃত্বে একটি পক্ষ পাল্টা প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করে। এতে এলাকায় পক্ষে-বিপক্ষে ২টি গ্রুপে উত্তেজনা বিরাজ করায় উপজেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রবিরোধী সংঘটনটি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঐ স্থানে জমায়েত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন হতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শামসুজ্জামান ও থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার শতাধিক আনসার ও পুলিশ সদস্য নিয়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে চতুর্দিক হতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রবিরোধী সংগঠনের কর্মী ও সাধারণ জনগণ তাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। পরবর্তীতে অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পাল্টা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতবিরোধী সংঘটনের কর্মীরা। সংঘর্ষ একপর্যায়ে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ত্রিমুখী সংঘর্ষে রূপ নেয়। সংঘর্ষের ঘটনাস্থলে ৪ জন গুরুতর গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ ৪ জনের মধ্যে ২ জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। বাকি ২ জন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। নিহতরা হলেন- মরতুজ আলী (৫২), আনোয়ারুল ইসলাম (৪২), জাকের হোছেন (৪৪), জাকেরুল ইসলাম (৩৮)। সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় উপকূলীয় এলাকা গন্ডামারায় চলছে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ। পাশাপাশি এই ঘটনায় শোকের পরিবেশ বিরাজ করছে বাঁশখালীর সর্বত্র। এ ঘটনায় যেসব পুলিশ সদস্য আহত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তারা হলেন- এসআই বেলাল হোসেন, মোঃ বাহার, মজিবুল ইসলাম, এএসআই আনোয়ার হোসেন, কনস্টেবল মোঃ ওয়াসিম, কনক চন্দ্র সিংহ, নুরুল কবির, খোরশেদ আলম, মিনহাজুল ইসলাম, মিরাজ উদ্দিন, চংমুং মারমা, রূপবন্ধু মারমা, নায়েক এলএম হোসেন, শহীদুল ইসলাম ও আনসার সদস্য আবদুল মোতালেব। এলাকাবাসীর অভিযোগ ॥ এস আলম গ্রুপ জমি অধিগ্রহণের সময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা জামায়াতের সহকারী আমির আরিফ উল্লাহর মাধ্যমে জমিদাতাদের কাছ থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান করবে মর্মে জমি অধিগ্রহণ করেছে। জমি অধিগ্রহণের সময় তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কোন ধরনের নাম উল্লেখ করেনি। এখন এই চেয়ারম্যান নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এলাকার সাধারণ জনগণকে ফেলে আত্মগোপনে চলে গেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। নেপথ্যের ইন্ধনদাতা ॥ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে এস আলম গ্রুপ বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে এস আলমের সাইট অফিস। সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরা গন্ডামারা এলাকা হতে জমির মালিকগণের নিকট হতে জমি অধিগ্রহণে সহায়তা করে। জমি অধিগ্রহণে সহায়তা করে এস আলম গ্রুপ থেকে লাখ লাখ টাকা সুবিধা ভোগ করে ঐ নেতাকর্মীরা আজ কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। অপরদিকে সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা এই প্রকল্প নস্যাত করতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা এই এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হলে বসতি স্থাপন সম্ভব নয় বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মিত হলে ঐ এলাকা ছাড়াও পার্শ¦বর্তী এলাকাতেও এর প্রভাব পড়বে বলে প্রচার চালায়। তারাই এলাকার সাধারণ জনগণের মাঝে মিথ্যাচার ও গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনে নামিয়েছে, যার পরিণতি ৪ নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণ বিসর্জন। তাছাড়া এই মহল তাদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ফেসবুক আইডিতে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার ও গুজবসংবলিত স্ট্যাটাস চালিয়ে যাচ্ছে, যা গন্ডামারা এলাকা ছাড়াও বাঁশখালীর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ৭০ শতাংশ ও চায়না কোম্পানির ৩০ শতাংশ ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগে বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত গন্ডামারা বড়ঘোনা এলাকায় ন্যায্য মূল্যে ৬০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় ন্যায্যমূল্য নিয়ে এই জমি এস আলম গ্রুপকে হস্তান্তর করে। জমি অধিগ্রহণের পর এস আলম গ্রুপ সীমানা খুঁটি দিয়ে তাদের অংশ বুঝে নেয়। এপ্রিল মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা ছিল। এদিকে, কয়লা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের প্রকল্প সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন মঙ্গলবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করে জায়গা কিনে নিয়েছি। এক্ষেত্রে কাউকে ঠকানো হয়নি। সোমবারের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষ-বিপক্ষ এবং পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সকল প্রক্রিয়া যখন সম্পন্ন তখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল চাঁদার দাবিতে সাধারণ জনগণকে আন্দোলনে নামিয়েছে। তিনি জানান, বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক লেয়াকত আলী তালুকদার এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে অনেক আগেই সুবিধা ভোগ করে নিজের ফায়দা লুটে নিয়েছে। এখন তার অতিমাত্রায় লোভ সৃষ্টি হওয়ায় আবারও এই প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সে এলাকার সাধারণ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছে। বসতভিটা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক লেয়াকত আলী তালুকদার জানান, আমাদের আন্দোলন বাঁচার আন্দোলন। পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত করার কথা ছিল না এস আলম গ্রুপের। তারা শিল্প প্রতিষ্ঠান করবে বলে জমির মালিকগণের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করেছে। মিথ্যাচারের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ জমি অধিগ্রহণ করে এখন সেই জমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত স্থাপন করলে গন্ডামারা তথা দক্ষিণ বাঁশখালীর বসতি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই নিজেদের জানমাল ও বসতভিটা রক্ষায় আন্দোলনে নেমেছে এলাকাবাসী। এলাকাবাসী রক্ত দেবে তবুও এই এলাকায় কখনও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র হতে দেবে না মর্মে এখনও রাজপথ দখলে রেখেছে বলে দাবি এই নেতার। পুলিশের বক্তব্য ॥ অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) হাবিবুর রহমান জানান, এ ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখসহ সাড়ে ৩ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এখনও কোন গ্রেফতার নেই। তবে ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির ইন্ধন ॥ বাঁশখালীর গন্ডামারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের এ প্রকল্পটি বেসরকারী উদ্যোগে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এ ধরনের একটি প্রকল্পকে বাঁশখালীর মানুষ শুরুতে স্বাগতই জানিয়েছিল। কেননা, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থান যেমন হবে, তেমনিভাবে বিদ্যুত কেন্দ্রকে ঘিরে সড়ক যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নও সাধিত হবে। শুরুতে শুধু সহযোগিতাই নয়, অনেকে আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটিও স্বার্থগত বলে মনে করছেন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পক্ষের লোকজন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার নেপথ্যে জামায়াত-বিএনপির ইন্ধন রয়েছে বলে ধারণা তাদের। চট্টগ্রামের বাঁশখালীকে টার্গেট করে বেশ কয়েক বছর ধরেই জামায়াতের ব্যাপক সাংগঠনিক কর্মকা- রয়েছে। গত বছরের প্রথম দিকে বাঁশখালীতে আন্দোলনের নামে ব্যাপক নাশকতা ও জ্বালাও পোড়াও করেছিল জামায়াত-শিবির। সড়কের বেইলি ব্রিজ খুলে নিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল পুরো উপজেলাকে। এছাড়া বাঁশখালীতে রয়েছে জলদস্যুদের উৎপাতও। সাগরে জলযান আটক করে মাঝিমাল্লা ও জেলেদের লাশ ফেলে দেয়া সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাছাড়া জঙ্গীদের তৎপরতাও রয়েছে বাঁশখালীতে। এ উপজেলারই সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ে সন্ধান মিলেছে জঙ্গী আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। র‌্যাবের অভিযানে পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম। সে ঘটনার সূত্র ধরে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে একটি বাড়ি থেকেও উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ হাতবোমা, গ্রেনেড ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফ উল্লাহ উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির। এস আলম গ্রুপকে জায়গা কিনে দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি সহযোগিতা করেছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে লাভবানও হয়েছেন। বর্তমানে তিনি অনেকটাই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। আর ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’ নামের যে সংগঠনটির ব্যানারে আন্দোলন চলছে সে সংগঠনের আহ্বায়ক লেয়াকত আলী তালুকদার একজন বিএনপি নেতা। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য। পুরো ঘটনার পেছনে এবং এলাকাবাসীকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে উস্কে দিতে তারা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এদিকে, এত বড় ঘটনার পর সরকারী পর্যায়ের কোন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারা মঙ্গলবার পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এমনকি পুলিশ সুপারও যাননি। তবে মঙ্গলবার রাতের মধ্যে পুলিশ সুপারের যাওয়ার কথা রয়েছে বলে বাঁশখালী পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে। এদিকে, প্রশ্ন উঠেছে, সরকারী একটি ভাল উদ্যোগের প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে বেসরকারী গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতের ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারী পর্যায়ের বড় কর্তাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা ছিল। সাধারণ মানুষকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি অবগত করানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তৎপরতা আবশ্যক ছিল। এক্ষেত্রে তা হয়নি। এমনকি এলাকার সরকারদলীয় নির্বাচিত এমপিও মঙ্গলবার পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশপাশে যাননি। ফলে গত শনিবার প্রথম দফায় সহিংস ঘটনা না ঘটলেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পরদিন ঘটল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যাতে ঝরে গেল ৪টি তরতাজা প্রাণ। যারা এ ঘটনার নেপথ্যে ইন্ধন যুগিয়েছে অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির মদদদাতারা এখন ঘটনাস্থলে নেই এবং এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে প্রচার করছে। কিন্তু এলাকার প্রায় সব সূত্রই নিশ্চিত করেছে জামায়াত-বিএনপি পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য অপচেষ্টা চালিয়েছে। বাঁশখালীতে আজ হরতাল ॥ বাঁশখালীর গন্ডামারায় গ্রামবাসীসহ ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে আজ বুধবার এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে বাঁশখালী ছাত্র ঐক্য ফোরাম নামের একটি সংগঠন। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন পরবর্তী সমাবেশ থেকে হরতালের ডাক দেন ফোরামে আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ চৌধুরী। বিকেলে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাঁশখালী ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাঁশখালী স্বপ্নতরী সংঘ, গণসংহতি সমিতি চট্টগ্রাম যৌথ উদ্যোগে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শাহ আলম, মৃণাল চৌধুরী, গণমুক্তি ইউনিয়নের নাসির উদ্দিন আহমদ, বাসদের মহিনউদ্দিন, রাজা মিয়া, মাওলানা ভাসানী ফাউন্ডেশনের সিদ্দিকুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী হাসান মারুফ রুমি, চৌধুরী জসিম উদ্দিন প্রমুখ।
×