ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

তবু অর্জনে কমতি নেই বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ এপ্রিল ২০১৬

তবু অর্জনে কমতি নেই বাংলাদেশের

ক্যারিবীয় রূপকথার মধ্য দিয়ে পর্দা নেমেছে টি২০ বিশ্বকাপের ষষ্ঠ আসরের। আলোচিত এই আসরে সেমিফাইনাল বা ফাইনালে খেলার স্বপ্ন পূরণ না হলেও বাংলাদেশের ভা-ার একেবারে শূন্য না। অনেক অর্জন আর প্রাপ্তি নিয়েই ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। এবারের আসরে ব্যাটিং-বোলিংয়ের সাফল্যের সঙ্গে দলীয় সাফল্য-ব্যর্থতাতেও আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় বিষয়, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান বাংলাদেশ ওপেনার তামিম ইকবালের। যেহেতু টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার হিসেব করা হয় সেমিফাইনাল পর্যন্ত পারফর্মেন্সের ওপর ভিত্তি করে, সেখানে ব্যাটিংয়ে রান হিসেব করে যদি পুরস্কার দেয়া হয়, তাহলে ৬ ম্যাচে ৭৩.৭৫ গড়ে ২৯৫ রান করা তামিম তা পেতেই পারতেন। শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন ভারতের বিরাট কোহলি। আসর সেরা না হলেও তামিম নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকায় সবার উপরে যে আছেন তামিম এমন নয়, এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানটিও তামিমেরই। বিশ্বকাপে দুটি শতক হয়েছে। একটি করেছেন তামিম। আরেকটি করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং দানব ক্রিস গেইল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১০০ রান করেছেন গেইল। বাছাইপর্বে ওমানের বিপক্ষে যে অপরাজিত ১০৩ রান করেছিলেন তামিম, সেই ইনিংসকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি কেউই। শুধু তামিমের সাফল্যেই মোড়ানো নয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে যে এখনও ভাগ বসিয়ে আছে বাংলাদেশ, সেখানে অন্য ক্রিকেটারদেরও আছে ছাপ। বোলিংয়ে মুস্তাফিজুর রহমান তো ইতিহাসই গড়েছেন। টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বোলার হিসেবে ৫ উইকেট নিয়েছেন। এ বিশ্বকাপে ৫ উইকেট শিকারি বোলার দুইজন। ৩ ম্যাচ খেলেই ৯ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজ ও অস্ট্রেলিয়ার জেমস ফকনার (২৭ রানে ৫ উইকেট)। মুস্তাফিজ আছেন এক নম্বরে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে ৫ উইকেট নেন মুস্তাফিজ। টুর্নামেন্টে সেরা দশ উইকেট শিকারির তালিকায় আছেন ৭ ম্যাচে ১০ উইকেট নেয়া বাংলাদেশ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান আছেন ছয় নম্বরে। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৪ উইকেট বা তার বেশি উইকেট নেয়াদের তালিকায় ৯ জন আছেন। এরমধ্যে মুস্তাফিজ ও সাকিব স্থান করে নিয়েছেন। ফিল্ডিংয়ে ক্যাচ ধরার দিক দিয়ে সেরা পাঁচে বাংলাদেশের দুইজন আছেন-মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সাব্বির রহমান রুম্মন। যেখানে নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল ৬টি ক্যাচ ধরেছেন। সেখানে মাহমুদুল্লাহ ও সাব্বির ৪টি করে ক্যাচ ধরেছেন। জুটি গড়াতেও ঝলক দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। ধর্মশালায় ওমানের বিপক্ষে তামিম ও সাব্বির মিলে যে দ্বিতীয় উইকেটে ৯৭ রানের জুটি গড়েছেন, সেটি এখনও এ উইকেটের সেরা জুটি হয়ে আছে। রানের দিক দিয়ে এ জুটি আছে দ্বিতীয় স্থানে। বাছাইপর্বে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আফগানিস্তানের সামিউল্লাহ সেনওয়ারি ও মোহাম্মদ নবী যে পঞ্চম উইকেটে ৯৮ রানের জুটি গড়েছেন, সেটি এখনও সেরার স্থানেই আছে। এর পরই ১ রান কম করে তামিম ও সাব্বিরের জুটিটি আছে দ্বিতীয় স্থানে। এটা যেমন সাফল্য, আছে ব্যর্থতাও। যে ব্যর্থতাগুলো আসলে এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে যে এত প্রশংসা করা হয়েছে, তা কমিয়ে দিয়েছে। সেই ব্যর্থতা ব্যক্তিগত-এর চেয়ে দলীয় নৈপুণ্যেই বেশি ধরা দিয়েছে। বাছাইপর্ব দাপটেই অতিক্রম করে বাংলাদেশ। হল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে হয়নি। এরপর ওমানকে উড়িয়ে দিয়ে ‘সুপার টেনে’ ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই হতাশ করে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লড়াকু হার হয়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে গিয়ে মাত্র ১ রানের হার হয়ে যায়। সবাই বাংলাদেশ দলের এমন পারফর্মেন্সে হতাশ হয়। এরপরও সমর্থন দিয়ে যায়। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গিয়ে সব হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। ৭০ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। টি২০ ক্রিকেটে নিজেদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন রানে অলআউট হয়ে যায়। শেষবেলায় এসে লজ্জা পায় মাশরাফিরা। যা এবারের বিশ্বকাপে অলআউট হওয়া দলগুলোর মধ্যে সর্বম্নি রানও। এই ম্যাচেই যে ৭৫ রানে হারে বাংলাদেশ, তা আবার এ বিশ্বকাপে রানের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় হারও। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীমের জন্য লজ্জা আছে। বিশ্বকাপে যে তিনজন সবচেয়ে বেশি দুইবার করে শূন্য রানে আউট হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন মুশফিক। কিছু ব্যর্থতা বাদ দিলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্জন কম নেই। যে কারণে ক্রিকেটবিশ্বের প্রশংসায় ভেসেছেন টাইগাররা। ভারতের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার কপিল দেব তো গোটা আসরেই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। সুপার টেনে ভারতের বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচ নাটকীয়ভাবে হেরে যায় বাংলাদেশ। এটি অনন্তকাল আক্ষেপ হয়ে থাকবে টাইগার ভক্তদের। এ জ্বালা কখনই জুড়ানোর নয়। মনের কোণে স্মৃতিটা উঁকি দিলেই আক্ষেপে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হবে হৃদয়-মন। ঠিক উল্টো অবস্থা ভারতীয়দের। তাদের জন্য ম্যাচটি শুধু স্মরণীয়ই নয়, স্বস্তিকরও বটে। কেননা ওইদিন মাশরাফি, সাকিবদের কাছে হারলে সেমিফাইনালেল আগেই বিদায়ঘণ্টা বেজে যেতে পারত ‘টিম ইন্ডিয়া’র। আর তাই, কপিল দেব বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দেয়ার অনুরোধ জানান মনেন্দ্র সিং ধোনির দলকে। ভারতের এই জীবন্ত কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের ধারণা, ২৩ মার্চ বেঙ্গালুরুতে হেরে গেলে সেমির আগেই হয়ত দর্শকের ভূমিকাই থাকতে হতো টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়নদের। ১৯৮৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব তার এক কলামে লিখেছেন, টি২০ বিশ্বকাপে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত ভারতের। বাংলাদেশ আর অবশ্যই বিরাট কোহলির সৌজন্যে দলটা সেমিফাইনালের টিকেট পায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জয় দলটাকে প্রয়োজনীয় প্রেরণা দিয়েছে। এর পর থেকে দলটার মনোভাবে যে পরিবর্তন এসেছে, তা যে কেউ বুঝতে পারবে। লাল-সবুজের দেশের বিরুদ্ধে ভারত যে চাপে পড়েছিল তা অবলীলায় স্বীকার করেছেন তারকা এই অলরাউন্ডার। সে সব স্মরণ করিয়ে দিয়ে কপিল বলেন, বাংলাদেশ হেরে গেলেও এ ধরনের ম্যাচে ১০টার মধ্যে ৯টা দলই জিতবে। তিন বলে ২ রানের সময় ভারত একেবারে হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে ছিল। তবে স্বাগতিক দল কোনোরকমে হলেও একটা দুর্দান্ত জয় পেয়েছে। সেই রাতে হেরে গেলে ভারত হয়ত চটজলদি বিদায় নিত টুর্নামেন্ট থেকে। তাদের মনোবল ভেঙে যেত বলেই মনে হয়। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন কপিল। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ধোনিদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভয়ঙ্কর দল। যে কোন প্রতিপক্ষকেই হারানোর সামর্থ্য রাখে তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্য টাইগারদের, বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই লড়াই করে হারতে হয়েছে। তবে পেসার তাসকিন আহমেদ ও স্পিনার আরাফাত সানিকে অবৈধ বোলিং এ্যাকশনের দোহাই দিয়ে আইসিসি নিষিদ্ধ করলে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। এর নেতিবাচক প্রভাব ভালই পড়ে টাইগারদের পারফর্মেন্সে। এরপরও বাংলাদেশ যেভাবে লড়াই করেছে তা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাইতো ভারতের কাছে অপ্রত্যাশিত হারের পরও কপিল বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘হেরেও হৃদয় জয় করেছে বাংলাদেশ’।
×