ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ নুরুজ্জামান

ক্যারিবীয় শ্রেষ্ঠত্বের পুনর্জাগরণ

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ এপ্রিল ২০১৬

ক্যারিবীয় শ্রেষ্ঠত্বের পুনর্জাগরণ

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে ক্যারিবীয়রা কেবল দ্বিতীয় টি২০ বিশ্বকাপই জেতেনি, গড়েছে অনেক অনেক ইতিহাস। একসঙ্গে এত অর্জন ক্রিকেট আগে কখনও দেখেনি। একই সঙ্গে ছেলে ও মেয়েদের টি২০তে বিশ্বসেরার মুকুট পরার ঘটনা এই প্রথম। ইডেনে দুর্ধর্ষ অসিদের হারিয়ে প্রমীলা ক্রিকেটে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় স্টেফানি টেইলরের দল। একই দিনে সেখানেই দ্বিতীয় সাফল্যে ছন্দের ঝঙ্কার তুলল ড্যারেন সামি-বাহিনী। ২০১২ সালের পর আবারও টি২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলো। তারাই এখন একমাত্র দল, যারা একাধিকবার টি২০ বিশ্বকাপ জিতল। ছোট্ট ফরমেটে ২০০৭ সালে ভারত, ২০০৯ সালে পাকিস্তান, ২০১০ সালে ইংল্যান্ড ও ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেভাবে খেলল, মনে হলো ‘নতুন যুগে’র সূচনা হলো। যে যুগ ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও ইঙ্গিত মিলেছিল। এবার যেন সেই ইঙ্গিত আরও পাকাপোক্ত হলো। প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে দলটি ক্যারিবীয়রা। যুব বিশ্বকাপে এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুবারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মহিলা টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মহিলা ক্রিকেটাররা শিরোপা জিতেছে। এবার জিতল পুরুষ দলও। এটাকে নতুন যুগের সূচনাই তো বলা চলে। এ রকম ইতিহাস আজ পর্যন্ত কোন দলের নেই। একসঙ্গে যুব দল, মহিলা দল ও পুরুষ দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই করে দেখাল। তাতে প্রশংসা তো প্রাপ্যই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ক্রিকেট বিশ্বকাপের বেশিরভাগ ফাইনালই একপেশে, ম্যাড়মেড়ে। সেখানেও ব্যতিক্রম ইডেনের এই ম্যাচ। ২০ ওভারে টেনেটুনে ১৫৫ রানের সম্মানজনক স্কোর ইংল্যান্ডের। জবাবে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে যাওয়া উইন্ডিজের জয়ের জন্য শেষ ওভারে চাই ১৯ রান। ক্যারিবীয়দের পাড় ভক্তও হয়ত আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বেন স্টোকসের প্রথম চার বলে চারটি ছক্কা হাঁকিয়ে দারুণ জয় এনে দেন কার্লোস ব্রেথওয়েট! যথার্থতা পায় ডোয়াইন ব্রাভোর গান ‘চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন’। জয়ের নায়ক অবশ্য মারলন স্যামুয়েলস। ২০১২ ফাইনালের মতো এদিনও ভীষণভাবে জ্বলে ওঠেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ব্যাটিং বিপর্যয়ের মুখে ৬৬ বলে অপরাজিত ৮৫ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন স্যামুয়েলস। ‘চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন’ গানে মাত করে দেয়া ব্রাভোর ২৫ ও ব্রেথওয়েটের ১০ বলে ‘অবিশ্বাস্য’ ৩৪-এর সৌজন্যে ৪ উইকেটের চিত্তাকর্ষক জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১০-৪ ইংল্যান্ড : টি২০তে ১৪ দেখায় এ নিয়ে ইংলিশদের ১০ বারই হারাল ক্যারিবীয়রা। এটাই কোন দলের বিপক্ষে তাদের সর্বাধিক জয়ের রেকর্ড। বিপরীতে আর কোন দলের কাছে এতবার হারেনি ইংল্যান্ড। ২০০৭ থেকে টি২০ বিশ্বকাপে এ নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫ ম্যাচের সবটিতেই হারল ইংল্যান্ড! লর্ডসে ১৯৭৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে, ওভালে ২০০৪ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে এবং এবারÑ একই সঙ্গে আইসিসির তিনটি বড় আসরের ফাইনালে একই প্রতিপক্ষকে কাঁদাল ক্যারিবীয়রা। ব্যতিক্রমের এখানেই শেষ নয়, অধিনায়ক হিসেবে টানা ১০ ম্যাচে টসে জিতেছেন ড্যারেন সামি, আন্তর্জাতিক টি২০তে যা নতুন রেকর্ড। এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের ছয়টি ম্যাচেই টস জিতে তিনি আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন, ১ হারের বিপরীতে জয় ৫টিতে! টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই দেশের পুরুষ ও মহিলা দল ফাইনালে জয় পেল। এর আগে ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার পুরুষ ও নারীরা ফাইনালে খেললেও পুরুষরা হেরেছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের মাটিতে অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে উইন্ডিজ যুবারা, এবার টি২০তে ছেলে ও মেয়েদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। উইন্ডিজের এই সাফল্যের সঙ্গে কতটা আবেগ জড়িয়ে অধিনায়কের বক্তব্যেই সেটি বোঝা যায়। ‘নাস, আপনি কি সত্যি এ ব্যাপারে আমার কাছ থেকে শুনতে চান? আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই জানি, কী পেলাম। মানুষ দুশ্চিন্তায় ছিল, আমরা এই টুর্নামেন্টে খেলতে পারব কিনা। আমাদের অনেক দাবি আছে এবং ক্রিকেট বোর্ড আমাদের অসম্মান করেছে। মার্ক নিকোলস (ইংলিশ কমেন্টেটর) আমাদের দলকে বলেছেন, ‘মস্তিষ্কহীন’। এগুলো হয়েছে বিশ্বকাপের আগে, যা আমাদের একত্র করেছে। জানি না আবার কবে সবাই একসঙ্গে খেলতে পারব!’ ম্যাচ শেষে সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেনের এক প্রশ্নের জবাবে সামি এ কথা বলেন। অধিনায়কের শেষ বাক্যটা খুবই মর্মস্পর্শী। কারণ এই অজুহাতে, সেই অজুহাতে টেস্ট ও ওয়ানডে খেলছেন না বড় তারকা ক্রিস গেইল। আইপিএল, বিগ ব্যাশের মতো বিশ্বব্যাপী ঘরোয়া টি২০ খেলে দেদার টাকা কামাচ্ছেন তিনি। আর্থিক বনিবনা নিয়ে বোর্ডের (ডব্লিউআইসিবি) সঙ্গে সিনিয়র ক্রিকেটারদের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। এমনকি একই কারণে এই বিশ্বকাপেও তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে কোনভাবে সাময়িক একটা রফা-দফা হয়। আছে নির্বাচক ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট ও কোচের দ্বন্দ্ব। ডোয়াইন ব্রাভো-কাইরেন পোলার্ডের মতো তুখোড় খেলোয়াড়ের টেস্ট-ওয়ানডে থেকে সরে যাওয়া। উইন্ডিজ ক্রিকেটে সমস্যার ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে শেষ হবে না! তারই মাঝে ‘অবিশ্বাস্য’ভাবে এলো টানা তিন শিরোপা! ‘আমরা এই জয় ক্যারিবিয়ান ভক্তদের উৎসর্গ করছি। প্রধানমন্ত্রী মিচেল, আমি জানি না, তিনি কী করতে চাইছেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। ফাইনালের আগে সকালেও ফোন করে খোঁজ নেয়ার জন্য।’ অধিনায়কের শেষ কথায় আবেগের সঙ্গে বার্তাও রয়েছে, ‘আজ আমি পনেরো খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফদের সঙ্গে উদ্যাপন করতে যাচ্ছি। জানি না, আবার কবে এদের নিয়ে খেলতে পারব! কারণ আমরা ওয়ানডে দলের জন্য নির্বাচিত হইনি। জানি না কবে টি২০ ম্যাচ খেলব। এটা তাই বিশেষ কিছু। আশা করছি এই একসঙ্গে থাকা, বিশ্বজয় আমাদের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি করবে। শত প্রতিকূলতার মাঝে পাওয়া সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য দারুণ বার্তা বয়ে আনবে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায়।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বারবাডোজ, কিউবা, জ্যামাইকা, হাইতি, গায়ানা, ত্রিনিদাদ এ্যান্ড টোবাগোতে আনন্দের র‌্যালি বের হয়। উৎসব হয়। জ্যামাইকান গতি মানব উসাইন বোল্ট তো পেছনে টিভি ছেড়ে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের সঙ্গে নাচের তালে যেন একাকিত্ব হয়ে যান। গাইতে থাকেন, ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’। সঙ্গে নাচতেও থাকেন। আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও ব্রায়েন তো টুইট করেন, ‘গ্রেট টুর্নামেন্টের শেষটাও কী গ্রেটভাবে হলো। বোঝা যাচ্ছে, পার্টি লং টাইম ধরেই হবে।’ ভারতের হরভজন সিং টুইট করেন, ‘হাহাহা...!!! সুপার ডিজে ব্রাভো, গেইল। তোমরা সবার ভেতরই চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন তাল তুলে দিয়েছ।’ শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়সুরিয়া যেমন বিশদভাবেই টুইট করেছেন, ‘অকল্পনীয় কাজ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পুরো ফলই বদলে দিয়েছে। গ্রেট নক মারলন। তোমরা সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য।’ পাকিস্তানের সাঈদ আজমল যেমন টুইট করেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে। ক্রিকেটে সেরা ম্যাচগুলোর একটি।’ ভারতের বীরেন্দর শেবাগ তার টুইটে কিছু বলেননি। তবে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। যেটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়নে’র তালে নাচছেন। ভারতের আজিঙ্কেয়া রাহানে লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলকে। কী দারুণ জয়!’ অস্ট্রেলিয়ার জেসন গিলেস্পিতো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন সামির আবেগপ্রবণ কথাগুলো শুনে মুগ্ধ। লিখেছেন, ‘গ্রেট ভালবাসা ড্যারেন সামি। আমি যে পোস্ট ম্যাচগুলো দেখেছি, এর মধ্যে সামির পোস্ট ম্যাচটি নিঃসন্দেহে সেরা।’ কী বলেছিলেন সামি? দেশের বোর্ডের কর্মকর্তাদের ধুয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তারা আমাদের কোন খেয়াল রাখেনি। এমনকি আমরা জার্সি থেকে শুরু করে সবকিছু নিজেরাই ব্যবস্থা করেছি।’ আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়েছেন সামি। পরে ক্রিকেট বোর্ডও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকর লিখেছেন, ‘তোমরা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কর্টনি ওয়ালস লিখেছেন, ‘টিম আসলেই চ্যাম্পিয়নের মতোই খেলেছে।’ অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন যেমন লিখেছেন, ‘অসাধারণ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছে মারলন আর ব্রাথওয়েটের তো তুলনাই হয় না।’ ভারতের বিরাট কোহলি লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমকে। অবিশ্বাস্য জয়!’ বাংলাদেশের মুশফিকুর রহীম টুইট করেছেন, ‘হোয়াট আ টিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাস্ট অসাধারণ। তোমরা এটার যোগ্য।’ শহীদ আফ্রিদি টুইট করেছেন, ‘ক্রিকেটের জয় হয়েছে আসলে।’ সত্যিই ক্রিকেটের জয় হয়েছে। ইংল্যান্ড হেরেছে। তবে দুর্দান্ত খেলেছে তারাও। শেষ ওভারে ব্রাথওয়েটের ব্যাটিং ভেল্কিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে গেছে। সেই জেতার পর যে আনন্দ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সবার মনকে ছুঁয়ে গেছে।
×