ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

আদর্শ বদল ॥ দুটি উদাহরণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৬ এপ্রিল ২০১৬

আদর্শ বদল ॥ দুটি উদাহরণ

এ উপমহাদেশে যখন নতুন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা চলছে তখন নানা রকম রাজনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি ধর্মকে উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের তাত্ত্বিক আয়োজনও চলছিল। উনিশ শ’ একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারা তাদের আগের ধারাবাহিকতা মেনেই তা করেছিল। ভারত যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে তখন আজকের জামায়াতে ইসলামীর তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা আবু আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আমাদের স্বাধীনতার অর্থও কি এই যে, বিজাতির শাসনমুক্ত হওয়া? স্বজাতির শাসন কিংবা স্বদেশীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি আমাদের লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন?... আমাদের সামনে তো শুধু একটি উদ্দেশ্য রয়েছে আর তা হলো, আল্লাহর বান্দার আল্লাহকে ছাড়া আর কারও অধীন না হওয়া, মানুষের সার্বভৌমত্বের অবসান হওয়া এবং আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া।... যে আজাদী জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য তার সমর্থনে সংগ্রাম করার কোন অর্থ নেই। আমি তো একে ইংরেজের গোলামির চাইতেও ঘৃণ্য মনে করি। আমাদের নিকট (এই আজাদী সংগ্রামের) পতাকাবাহীরা মুসলমানদের জন্য সে পর্যায়ভুক্ত, যে পর্যায়ের ছিল ক্লাইভ, ওয়েলেসলি। এবং তাদের সমর্থক মুসলমানরা কোন অবস্থাতেই মীর জাফর ও মীর সাদেক থেকে ভিন্নতর নয়। যদিও অবস্থা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ধরনে কোন ফারাক নেই।’ [জামাতের আসল চেহারা, মওলানা আবদুল আউয়াল।] অথচ এই মওদুদী এক সময় কংগ্রেসের রাজনীতি সমর্থন করেছেন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা এর বিকৃতি কোনটাই তার চরিত্রে সে সময় ছিল না। কংগ্রেসের রাজনৈতিক আদর্শ সমর্থন করে তিনি এক সময় লিখেছিলেন, ‘এখন দেশের জন্য দুটো পথ রয়েছে। প্রথমটি হলো, নিজেদের আবেগ, অনুভূতির বশবর্তী হয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা এবং যেদিক ইচ্ছে পা বাড়ানো, দ্বিতীয়টি হলো, কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে চলা এবং এক মুহূর্তের জন্যও অন্তরে এর বিরোধিতার ধারণা পোষণ না করা। প্রথম পথ অনুসরণের পরিণাম আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, দ্বিতীয় পথ যদিও আবেগ-অনুভূতিবিরোধী, তবু এটাই হচ্ছে ঐক্য ও সংহতির পথ। আর ঐক্য ও সংহতি সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে উত্তম। একতা সকল অবস্থায় বিভেদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। আর সংহতি সব দিক থেকেই অগ্রগণ্য’ [জামাতের আসল চেহারা]। মওদুদী বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন এক সময়। সে সুবাদে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। সে সম্পর্কে লিখেছেন, ‘১৯১৯ সালে খেলাফত ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে আমি এই দুটো আন্দোলনের পক্ষে কাজ করি। সে সময় আমি গান্ধীজীর জীবনচরিত লিখি, বইটি ছাপা হচ্ছিল। আমার এক বন্ধু পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দেয়। ছাপা অবস্থাতেই বইটি বাজেয়াফত করা হয়... জব্বলপুরের মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগদানে উৎসাহদানকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম [জামাতের আসল চেহারা]। এই মওদুদীর চরম ডিগবাজির নির্মম স্বাক্ষর রেখেছে তার সাঙ্গপাঙ্গ, অনুচররা উনিশ শ’ একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়। অথচ ভিন্ন উদাহরণও আছে। ফরাসী বিপ্লবের আগে জ্যাঁ মেসলিয়ে নামে এক খ্রিস্ট ধর্মযাজক ধর্মের নামে মানুষের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো বিশেষ করে কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা দেখে ধর্মত্যাগ করেছিলেন। সে সময়ের সামন্ততন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের স্বরূপ দেখে আত্মোপলব্ধি হয় তার। এতকাল যিনি ধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন, কৃষকদের ওপর ধর্মের নামে যাজক ও সামন্ত প্রভুদের বহুমাত্রিক অত্যাচারের কূটকৌশল তাকে পুরো উল্টো অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে উদ্ধত ও স্বৈরাচারী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিরোধিতা করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘অসমতা প্রকৃতির বিধানের পরিপন্থী। প্রকৃতি সবাইকে সমান করে সৃষ্টি করেছে; বাঁচার এবং চলার সবার সমান অধিকার রয়েছে, অধিকার রয়েছে সমভাবে স্বাভাবিক স্বাধীনতা উপভোগ করার, বিশ্বের মঙ্গলকর সবকিছুর সমান অংশভাগী হওয়ার অধিকারও রয়েছে সব মানুষের...। প্রচলিত ব্যবস্থার সবখানেই যা প্রকট হয়ে চোখে পড়ে তা হলো পৃথিবীর সব ধনসম্পদ যৌথ মালিকানা ও উপভোগের বদলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরিত হয়ে চলছে। প্যারিসের প্রতিটি জনগণের নিজেদের একই পরিবারের ভাইবোন বলে বিবেচনা করা উচিত; লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে সবাই কাজ করে এবং কাজের মাধ্যমে সবার জীবনের প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর উৎপাদন অব্যাহত রাখে। পৃথিবীর মালসামগ্রী ও ধনসম্পদ বিলি-বণ্টন থেকে, সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা থেকে উদ্ভূত হয় ধনী-গরিব, পরিতৃপ্ত ও ভুখা, উচ্চ ও নিচের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ... প্রচলিত অন্যায়-অবিচার, একের বিলাসিতা অন্যের দারিদ্র্য, প্রাচুর্যের পাশাপাশি অভাব, শ্রেণী বিভাজন সৃষ্ট নৈতিকতা আর পাপ এ সবের দিকে তাকালে ভাবতে অবাক লাগে কি করে ঈশ্বর ন্যায়-অন্যায়ের এ অভাবনীয় বৈপরীত্য সহ্য করেন। [দর্শন ও তত্ত্ব : রাজনীতি, ড. আবুল কালাম] জ্যাঁ মেসলিয়ে এবং তাঁর মতো আরও অনেকে শুধু নিজস্ব যুক্তি দিয়ে সমাজে মানুষের বৈষম্যের উৎস খুঁজে বের করেছিলেন। ধর্মের অপব্যবহার করে চার্চ ও যাজকতন্ত্র কিভাবে নির্যাতনের হাতিয়ার হয়েছে তা আবিষ্কার করেছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। যাজক জ্যাঁ মেসলিয়ে মানুষের কল্যাণে যা করেছিলেন মওদুদী ঠিক তার উল্টোটা করেছেন, যদিও তুলনাটা হয়ত বেমানান। মেসলিয়ের সময় ও সে সময়ের ফ্রান্সের সঙ্গে উপনিবেশ ভারতের তুলনা চলে না। ফ্রান্সের সমাজের বিকাশ ঘটেছে ধারাবাহিকতা মেনে স্বাভাবিকভাবে, বিকাশের প্রতিটি স্তর পরিপুষ্ট হয়েছে দার্শনিক মতাদর্শের ভিত্তিতে। একটি ঔপনিবেশিক দেশে সে রকম হওয়ার সুযোগ কম। এখানে সমাজের বিকাশ হয় অস্বাভাবিক বা কৃত্রিমভাবে। ঔপনিবেশিক প্রভু নিজের প্রয়োজনে কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বা শ্রেণী তৈরি করে, যাদের বেশিরভাগের পক্ষে দেশের জন্য বড় কিছু করা সম্ভব হয় না। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে মওদুদী তেমন কোন ফ্যাক্টর না হলেও তার রাজনৈতিক আদর্শ বদল পরবর্তীতে সমাজে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলেছে। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি বলেছেন ‘পাকিস্তানের শত্রু ও দুষ্কৃতকারী’। সত্তরের নির্বাচনে তার দল জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অংশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাত্র চারটি আসনে জয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে তারা শুধু হারেইনি, জামানত বাজেয়াফত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তখন মওদুদী ও তার রাজনৈতিক দলের আসল চেহারা এদেশের প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাদের কর্মকা- এ দেশের মানুষ দেখেছে। কিন্তু এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যত বিভেদ-বিভাজন থাক, যতই ডান-বামের দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা থাক জামায়াত-শিবির প্রশ্নে দুটো স্পষ্ট ভাগ হয়ে যায় এখনও। এ আবদ্ধ অবস্থা থেকে বেরোতে চায় সবাই। সারা পৃথিবীতেই চলছে এক ধরনের আবদ্ধ অবস্থা। বিশ্ব অর্থনীতি বার বার চড়ায় আটকাচ্ছে। বিক্ষোভ করছে বেকার ও শ্রমিকরা। যেসব দেশে আগে শ্রমিক বিক্ষোভের কথা তেমন শোনা যেত না সেসব দেশে ঘনঘন রাস্তায় নামছে মানুষ। আমেরিকার অর্থনীতিও সঙ্কটে। গোটা পৃথিবীতেই সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামও চলছে। তবে এটা এখন পরিষ্কার, পরিবর্তনটা হতে হবে মৌলিক। প্রচলিত পদ্ধতিতে জোড়াতালি দিয়ে চলা আর সম্ভব হচ্ছে না।
×