ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

খবরের কাগজের দিন কি ফুরিয়ে আসছে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৬ এপ্রিল ২০১৬

খবরের কাগজের দিন কি ফুরিয়ে আসছে?

ব্রিটেনের ৩০ বছরের পুরনো সংবাদপত্র দি ইন্ডিপেনডেন্টের সবশেষ প্রিন্ট সংস্করণ ২৭ মার্চ বাজারে এসেছে। এখন থেকে আর কাগজে নয়, শুধু অনলাইনেই প্রকাশিত হবে পত্রিকাটি। বলা হচ্ছে, পত্রিকার কাটতি না থাকায় শুধু বিজ্ঞাপন বেচেই টিকে আছে অনেক কাগজ। এটিই ব্রিটেনে মূলধারার প্রথম কোন পত্রিকা যেটি ছাপা সংস্করণ থেকে অনলাইনে রূপান্তরিত হলো। আমরা দেখছি, যুগের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিশ্বের শতাব্দী প্রাচীন ও বড় পত্রিকাগুলো অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় লিয়োডস লিস্টের কথা। ১৭৩৪ সালে লন্ডনে পত্রিকাটি যাত্রা শুরু করে। একটানা ২৮০ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছিল এটি। কিন্তু সম্প্রতি এর মুদ্রণ ভার্সন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। অনলাইনে তাদের পাঠকসংখ্যাও বেশ ভাল। লিয়োডস লিস্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিকে সংবাদপত্রের জন্য অশনি সঙ্কেতই বলতে হবে। কয়েক বছর আগে সিয়েটল পোস্ট-ইন্টেলিজেন্সারের ছাপাখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি এখন অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটরও তাদের কাগুজে সংস্করণ বন্ধ করে দিয়ে অনলাইনে আত্মপ্রকাশ করেছে। একদা মার্কিন পত্রিকা নিউজ উইক ৮০ বছর দাপটের সঙ্গে চলে তার মুদ্রণ মাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। নিউজ উইক বলতে এখন কেবল অনলাইন ভার্সনই বোঝাবে। ব্রিটেনের ইন্ডিপেডেন্টের অবস্থাও তা-ই হয়েছে। কাগজ বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বন্ধ হওয়ার আগে কাগজের পাঠকসংখ্যা চার লাখ থেকে ৩০ হাজারে নেমে এসেছিল। ফলে পত্রিকাটি খবরের কাগজ থেকে রাজস্ব তুলতে পারছিল না। যে কারণে তিন দশকের পুরনো ওই সংবাদপত্রটিকে এই কঠিন সিদ্ধান্তে যেতে হয়েছে। তবে তাদের কাগজের সংস্করণের তুলনায় অনলাইনে পাঠকসংখ্যাও অনেক বেশি। পত্রিকাটির ডিজিটাল সংস্করণ ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। ওখান থেকে আয়ও অনেক বেশি পত্রিকার। এ কারণেই ছাপা বন্ধ করে দিয়ে শুধু অনলাইনের পথে পা বাড়িয়েছে পত্রিকাটি। ইউএস নিউজ এবং ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের মতো জনপ্রিয় সাময়িকীগুলোও তাদের প্রিন্ট এডিশন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই ভেসে আসে তাদের অনলাইন ভার্সন। সত্যিই বিস্মিত হতে হয় যুগের হাওয়া বদলের এই নির্মম বাস্তবতা দেখে! গণতান্ত্রিক বিশ্বে সংবাদপত্রের বলিষ্ঠ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ২০ শতক জুড়ে। এ শতকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সংবাদপত্র সমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। অর্থ ও ক্ষমতার দিক থেকে রাষ্ট্র এবং সমাজে আধিপত্য বিস্তার করেন সাংবাদিক ও পত্রিকার মালিকরা। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে এ গণমাধ্যম। কিন্তু ২০ শতকের শেষভাগে এসে খবরের কাগজের একচেটিয়া আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম। ২১ শতকের প্রথম দশকে ইউরোপের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র এবং মিডিয়া গ্রুপগুলো চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। যে কারণে তারা কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেনডেন্ট, লন্ডন ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড এ দুটি পত্রিকার আয় ২৪ শতাংশ কমে যায়। ফলে এর আংশিক মালিকানা বিক্রি করে দেয়া হয়। ২০০৯ সালে লোকসানের মুখে পড়ে যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইল কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হয়। লেইসেসটার মারকারি, ব্রিস্টল ইভিনিং পোস্ট, ডারবি টেলিগ্রাফ- প্রতিটি পত্রিকাই বড় অংশে কর্মী ছাঁটাই করে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাওয়ায় তারা এ পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এসব পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের পাঠকসংখ্যা প্রিন্ট এডিশনের চেয়ে অনেক বেশি। অনলাইনে বিজ্ঞাপনও ভাল। ফলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা যত বাড়ছে, কাগজে ছাপানো পত্রিকার বাজার ততই ছোট হয়ে আসছে। কানাডার ‘পাওয়ার কর্পোরেশন’ নামক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত লা প্রেস পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়ে এটি ডিজিটাল ট্যাবলয়েডে রূপান্তরিত হয়েছে। গার্ডিয়ান পত্রিকাও তাদের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে দেয়ার জন্য গভীর চিন্তা-ভাবনা করছে। এরই মধ্যে তারা বিশাল পরিসরে অনলাইন সংস্করণ চালু করে দিয়েছে। দ্য সান, পকার প্লেয়ার এবং দ্য অনিয়ন তো আগেই অনলাইন সংস্করণে চলে গেছে। তাদের অনলাইন পাঠকসংখ্যা কাগজের চেয়ে অনেক বেশি। অনলাইনের প্রবল আধিপত্যের মুখে পশ্চিমা দুনিয়ায় সংবাদপত্র যে সঙ্কটের মুখে পড়েছে সেটা অনেক দিন ধরেই প্রতিফলিত হচ্ছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় সংবাদপত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে দিন দিন। এখন সেখানে নতুন প্রজন্ম অনলাইনে সংবাদ পড়ে। সেটিতেই পশ্চিমা পাঠকরা এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে দিন দিন পাশ্চাত্য দেশগুলোতে খবরের কাগজের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিনা পয়সায় দিয়েও খবরের কাগজ পড়াতে পারছে না পত্রিকাগুলো। ব্রিটেনের অন্য কাগজগুলোও একই অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কাগজের বিক্রি আগের তুলনায় কমেছে। তবে তাদের পাঠকসংখ্যা ইন্ডিপেনডেন্টের মতো এতটা কমেনি। যে কারণে অন্য পত্রিকাগুলোও ছাপার সংস্করণ থেকে আস্তে আস্তে অনলাইনের দিকে ঝুঁকছে। তাহলে কি পাশ্চাত্যে খবরের কাগজের দিন শেষ হয়ে আসছে? উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এখন অনলাইনের ছোঁয়া এসে লাগছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও এখন অনলাইনেই সংবাদ দেখছে। অনেক বাসা-বাড়িতে এখন আর পত্রিকা রাখতে দেখা যায় না। পথে রাস্তার জ্যামে কিংবা ট্রাফিক লাইটে কেউ বিক্রি করতে আসছে না ‘আজকের তাজা খবর’, বাসে-ট্রেনে যাত্রীদের হাতে হাতে নেই আর দিনের কাগজটি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের সংবাদপত্র এখনও ঝুঁকিতে পড়েনি। তার কারণ সুস্পষ্ট। কারণ, এখানে কম্পিউটার এখনও সাধারণের কাছে পৌঁছায়নি। যাদের ঘরে কম্পিউটার আছে তারাও কম্পিউটারবান্ধব হয়ে উঠেনি। অন্যদিকে গ্রামবাংলায় যোগাযোগ কাঠামোর প্রসার ঘটায় সেখানে সংবাদপত্র প্রবেশ করছে। যে কারণে সংবাদপত্রের বাজার হয়ত অক্ষুণœ আছে। তবে এর মানে এই নয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে সংবাদপত্র গুটিয়ে গেলে এখানে ব্যতিক্রম হবে। বড়জোর আয়ু দীর্ঘ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা যদিও গোটা বিষয়টিকে নতুন প্রজন্মের পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। তাদের মতে আই-প্যাড স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে ওঠা নিউজ আপডেটে অভ্যস্ত প্রজন্মের কাছে কাগজের পাতা ওল্টানোটা ‘বিলাসিতায়’ পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি এই প্রজন্ম সচেতন থাকতেও চায় না। চায় হাতগরম গল্প। খবরের কাগজ পড়লে সচেতনতা বাড়ে তো ঠিকই, সেই সঙ্গে বাড়ে সাক্ষরতাও। কিন্তু নতুন প্রজম্ম পড়াশোনায় নেই। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, কেন কাগজের পাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই প্রজন্ম। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী শতকরা ৭২ জনই ইন্টারনেটে অভ্যস্ত। আর ৬৫ উর্ধ শতকরা ৪১ জন মাত্র ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। নিউইয়র্ক টাইমসের অপর এক পরিসংখানে দেখা যায়, অনলাইন পাঠকসংখ্যা ছাপানো কাগজের সংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ। এর কারণ হয়ত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা তেমন জোরালো নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপন আয় ঠিক তার উল্টো। অনলাইনের বিজ্ঞাপনের আয় ছাপানো কাগজের চেয়ে দশগুণ বেশি। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত দেখা যাবে বিজ্ঞাপনও সব অনলাইনে চলে যাচ্ছে। অবশ্য অনলাইনের সেই ঝড় এখনও বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি। তবে ঝড়ের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই ঝড়ের বাতাসে দেশে গজিয়ে উঠেছে শত শত অনলাইন নিউজ পোর্টাল। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞাপন এখন সেদিকে ঝুঁকেনি। এ কারণেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন পোর্টালগুলো আবার আমের মুকুলের মতো অকালে ঝরে যাচ্ছে। তবে যারা টিকে থাকবে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত তারাই আগামী দশকে বাংলাদেশে ভার্চুয়াল মিডিয়া জগতে নেতৃত্ব দেবে। এক্ষেত্রে পত্রিকাগুলো তাদের নীতি পরিবর্তন করে অনলাইন জগতে প্রবেশ করায় শেষ পর্যন্ত তারাই হয়ত নেতৃত্বের আসনে থেকে যাবে। অর্থাৎ আগামী দশকে বা তার পরের দশকে যদি পশ্চিমা বিশ্বের মতো আমাদের উপমহাদেশেও অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিস্ফোরণ ঘটে তবে নেতৃত্বে পত্রিকাগুলোই থেকে যাবে। পত্রিকাগুলো হয়ত সীমিত আকারে কাগুজে পত্রিকা প্রকাশ করবে। অনলাইন পাঠকই হবে পত্রিকাগুলোর মূল পাঠকসংখ্যা। বিজ্ঞাপনের বাজারও ধীরে ধীরে সেদিকেই অগ্রসর হবে। এটা এখনই বলা যায়। সংবাদপত্রের ইতিহাস ৫০০ বছরেরও বেশি সময়ের। ৫০০ বছর আগে প্রথম সংবাদপত্র শুরু হয়েছিল হাতে লেখা নিউজলেটার হিসেবে মূলত বণিকদের জন্য। ১৪০০ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মান থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম ছাপানো কাগজ। ১৬০০ শতাব্দীর শুরুতেই ইংরেজী ভাষায় সংবাদ পত্র প্রকাশিত হতে শুরু করলেও আধুনিক সংবাদপত্রের পথচলা শুরু ১৯৬৬ সালে ‘লন্ডন গ্যাজেট’-এর মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ এ পথ চলায় বারবার সংবাদপত্র হুমকির মুখে পড়েছে। রেডিও এবং টেলিভিশন এসে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল ছাপার কাগজকে। কিন্তু সেই হুমকি মোকাবেলা করে আজও টিকে আছে ছাপানো খবরের কাগজ। কিন্তু একাবিংশ শতাব্দীতে এসে খবরের কাগজের অস্তিত্ব এখন সত্যিই হুমকির মুখে। অনলাইন এসে বিপদে ফেলে দিয়েছে খবরের কাগজকে। কারণ এখন আর মানুষ বিরাট এক কাগজজুড়ে খবর খুঁজে সময় নষ্ট করতে চায় না। গুগল কিংবা ইয়াহুতে একটি সার্চ দিলেই চলে আসে খবর। সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে প্রয়োজনীয় সব লিঙ্ক। অমুক পৃষ্ঠায় দেখুন কিংবা পুরনো কাগজের ঝুড়ি নিয়ে বসার ঝামেলা নেই এখানে। ব্লগিংয়ের সুবাদে সবাই প্রকাশ করতে পারছে তাদের মতামত, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়। সমগ্র বিশ্বের দরজা এখানে খোলা। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা, যখন খুশি। শুধু কি তাই? অনেকটা বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে সব খবর। জীবন এখন অনেক সহজ। অধিকাংশ সময়ই কাটে কম্পিউটারের সামনে। ইটারনেটের এই যুগে এখন সব খবর সব তথ্যই আছে ল্যাপটপ কিংবা নোটপ্যাডে। এখন আর কাগজ খোঁজার প্রয়োজন নেই। ফলে বিশ্বজুড়েই খবরের কাগজ এখন হুমকির মুখে। বিশ্বের গণমাধ্যম-তাত্ত্বিকরাও সংবাদপত্রের জন্য দুর্দিনের পূর্বাভাস দিচ্ছেন। তাদের পূর্বাভাসের মূল প্রেরণা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিকাশ এবং এর বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠা। ইন্টারনেটের কল্যাণে সংবাদপত্রের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দ্রুত বিকাশ লাভ করছে অনলাইন সংবাদমাধ্যম, যাকে বলা হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল। ‘আজকের খবর কালকে পড়ার’ অভ্যাসের পরিবর্তে অনলাইন সংবাদমাধ্যম দিচ্ছে ‘মুহূর্তের খবর মুহূর্তে পড়ার’ সুযোগ। ফলে কেউ চাইলে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছেন মুঠোফোনের মতো যোগাযোগের একটি ক্ষুদে মাধ্যম দিয়ে। যার কারণে সংবাদপত্রের চেয়ে বিকল্প মাধ্যমেও খবর পাওয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে। এই নিউজ পোর্টালগুলোও অল্প সময়েই সংবাদের ‘বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের দেশে অনলাইন সংবাদমাধ্যম শৈশব ছেড়ে কেবল কৈশোরে পা দিচ্ছে; যৌবনে পা রাখতে আরও সময় লাগবে। তখনই মূলত সংবাদপত্র সত্যিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যদিও এ নিয়ে এখন বিস্তর বিতর্ক চলছে। বিতর্ক হচ্ছে- সংবাদপত্র কি মানুষের সংবাদ-আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে, নাকি নিউজ পোর্টালগুলো সংবাদ জোগানের ‘বিকল্প’ থেকে ‘মূলধারা’ হয়ে দাঁড়াবে? তবে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের অগ্রযাত্রায় সংবাদপত্রের ভিত্তি যে নড়ে উঠেছে তা সহজেই বলা যায়। বিশ্বের নামী-দামী পত্রিকাগুলো তাদের প্রচারসংখ্যা ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের পাঠকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিপরীতে নিউজ পোর্টালের পাঠকসংখ্যা বেড়েই চলেছে। যে কারণে শুধু মুদ্রণ ভার্সনে ভরসা রাখতে পারছেন না সংবাদপত্রের নীতি নির্ধারকরা। ফলে তারা কাগজের পাশাপাশি ‘ই-পত্রিকা’ হিসেবে অনলাইনেও প্রকাশ করছেন সংবাদপত্র। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিটি পত্রিকাই একই নামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছে। যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেনডেন্ট- তিনটি পত্রিকারই একই নামে অনলাইন ভার্সন রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নামী-দামী পত্রিকাগুলো অনলাইন পোর্টালে চলে গেছে। শুধু পত্রিকা কেন, অনলাইনের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও। তারাও এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পোর্টালে তাদের প্রকাশিত খবরগুলো প্রচার করছে। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, অনলাইন পাঠকসংখ্যা পত্রিকার চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এতেই প্রমাণিত হয়, পাঠক এখন অনলাইন নিউজের দিকে ঝুঁকছে। তাই বলা যায়, মুদ্রণযন্ত্রের পর সংবাদমাধ্যম অর্থাৎ গণমাধ্যমের দ্বিতীয় বিপ্লব এনেছে ইন্টারনেট। কারণ এখন ‘সংবাদের জন্য পাঠকরা অপেক্ষা করেন না, পাঠকদের জন্য সংবাদ অপেক্ষা করে।’ আর এ সম্ভব হয়েছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণেই। দেশ যত এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি যত গতিশীল হচ্ছে, মানুষের কর্ম ব্যস্ততাও তত বেড়ে চলেছে। ব্যস্ত মানুষের পক্ষে সময় নিয়ে পত্রিকা পড়ার সুযোগ কোথায়? বরং স্মার্টফোন এসে পাঠককে আরও পত্রিকাবিমুখী করে তুলছে। এখন স্মার্টফোনের বদৌলতে পাঠক তার কাজের ফাঁকে কিংবা চলতি পথেই অনলাইনে খবর দেখে নিতে পারছেন। ইন্টারনেট প্রযুক্তি এতটাই উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে যে, এখন বরং যখনই যে খবর অনলাইনে আসছে তা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পাঠককে এলার্ট করছে। আর পাঠক তৎক্ষণাৎ তা স্মার্টফোনে চোখ বুলিয়ে তা দেখে নিতে পারছেন। ইন্টারনেটের এই যুগে হয়ত একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখবেন নাস্তার টেবিলে আর নেই আজকের কাগজ। আমরা যেমন ছেড়ে এসেছি গ্রামোফোন, টেপরেকর্ডার, ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ, ঠিক তেমনি করেই হয়ত আগামী দিনে ভুলে যেতে হবে খবরের কাগজের যুগ। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের জয়জয়কার অবস্থা। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী ও ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানি গণমাধ্যমে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। তাদের অধিকাংশ বিনিয়োগ হয়েছে অনলাইনভিত্তিক সংবাদ ও বিনোদন মাধ্যমে। সুতরাং বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারাও আঁচ করতে পারছেন আগামী দিনগুলোতে মিডিয়া জগৎ শাসন করবে অনলাইন পোর্টাল। সেটা অনুধাবন করে সেদিকেই তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। অনলাইন নিউজ পোর্টাল উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে এখন থেকেই সক্রিয় হতে হবে। নতুন পত্রিকা যারা বের করতে চান তাদের জন্যও এটা সুযোগ। প্রিন্টেড ভার্সনের পাশাপাশি অনলাইন ভার্সনে বেশি জোর দিতে হবে। এখনই হয়ত রিটার্ন আসবে না, তবে জনপ্রিয় করতে পারলে এক সময় সেই অনলাইন ভার্সনই ‘সোনা প্রবাহিত নদীতে’ পরিণত হবে।
×