ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা মিথ্্ এবং রিয়েলিটি

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৬ এপ্রিল ২০১৬

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা মিথ্্ এবং রিয়েলিটি

একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গত নবেম্বর থেকে তিন মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থাশীল মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) জন্য এই জরিপ পরিচালনা করেছে নিয়েলসন-বাংলাদেশ। এই আইআরআই সংস্থাটি কট্টর ডানপন্থী বলে পরিচিত। ডানপন্থী হোক আর বামপন্থী হোক উক্ত মার্কিন সংস্থাটির পক্ষ থেকে এই জরিপ চালানো হয়েছে ৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের আটটি বিভাগের সব জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের দু’হাজার ৫৫০ জনের মতামত নেয়া হয়েছে। জরিপে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বয়স ১৮ বছর ও তার বেশি। জরিপের ফল মোটামুটি নির্ভরযোগ্য মনে হয়। জরিপে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ার একটা সাধারণ চিত্র পাওয়া যায়। ৫৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা জানিয়েছে। এর আগের জরিপে দেখা গেছে, এই আস্থা ছিল ৪৮ শতাংশের। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৩ শতাংশের মতে বাংলাদেশ সঠিক পথে চলেছে। ৮৩ শতাংশের মতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই ভাল অথবা কোনরকম ভাল। ৭৭ শতাংশের মতে দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের আশাও বেড়েছে। ৭২ শতাংশ মনে করেন আগামী বছর তাদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। ৬৫ শতাংশ মনে করেন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও বাড়ছে। কোন ধরনের জরিপ ছাড়াও সাধারণ চোখে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ দুই-ই বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিক এবং শহরের সাধারণ শ্রমিক থেকে দিনমজুর সকলেরই আয় উপার্জন বেড়েছে এবং সেই আয় উপার্জনের নিরাপত্তাও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গবর্নর আতিউর রহমানের দূরদর্শী নীতির দরুন বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি তেমন ঘটেনি এবং দ্রব্যমূল্য বিস্ময়করভাবে স্থিতিশীল। এতদসত্ত্বেও আলোচ্য জরিপে দেখা যায়, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষের হার আগের চাইতে ৮ শতাংশ বেড়েছে। শঙ্কা বেড়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চরমপন্থা নিয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৪ শতাংশের মতেই ধর্মীয় চরমপন্থা খুবই বড় সমস্যা। আগেই বলেছি, এই জরিপের ফল নিয়ে বিতর্ক তোলার অবকাশ কম। নতুন করে অন্য কোন সংস্থা জরিপ চালালেও এই ফলের সামান্য হেরফের হতে পারে। খুব একটা অন্যথা হবে না। সন্দেহ নেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। তবে আওয়ামী লীগের কর্মকর্তারা যদি মনে করেন, সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংগঠনের প্রতিও মানুষের আস্থা বেড়েছে অথবা বাড়ছে তাহলে তারা ভুল করবেন। আমি আগেও লিখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন দলীয় নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠে গেছেন। দেশের বড় বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যায় সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা তাঁর জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বাড়িয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার তাঁর কৃতিত্ব, সাফল্য ও জনপ্রিয়তার ভাগ পেয়েছে। কোন কোন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বাকপ্রগলভতা, পরস্পরবিরোধী উক্তি, বিতর্কিত কার্যকলাপ এবং অহেতুক ও অসংলগ্ন কথাবার্তা এই জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়তে দেয়নি। নইলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে বিস্ময়কর রেকর্ড এই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তাতে জনপ্রিয়তা আরও বহুগুণ বেড়ে যেত। জরিপে দেখানো হয় সরকারের প্রতি এই জন আস্থা বৃদ্ধির ভাগ ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগও পেত, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তারা তা পায়নি। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলো সম্পর্কে আলাদাভাবে জনমত সমীক্ষা চালানো হলে এই সত্যটি ধরা পড়ত। নিয়েলসন-বাংলাদেশের জরিপে যদিও বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রতি জন আস্থা বেড়েছে; কিন্তু জরিপে অংশগ্রহণকারী মানুষের মতামত পাঠ করলেই বোঝা যায়, তারা সরকারের সাফল্য সম্পর্কে কথা বলেছেন, সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের কোন সাফল্য সম্পর্কে নয়। সুতরাং এই জরিপের কথা জেনে যদি আওয়ামী কোন নেতাকর্মী অতি উল্লসিত হন এবং ভাবেন কেল্লাফতে হো গিয়া, রাজনীতির মাঠে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তারা বড়ই ভুল করবেন এবং সেজন্য ভবিষ্যতে তাদের চরম খেসারতও দিতে হতে পারে। সরকারের এত উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ যে সংগঠন হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারছে না, তার মূল কারণ, সংগঠনে সঠিক নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের অনুপস্থিতি। দুর্নীতির প্রাবল্য, বহু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা অথবা সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে পরিচিতি লাভ। আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতার আত্মীয়দের ব্যাপক দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট এবং সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ, ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল, দুর্নীতি, স্বার্থ সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত তো এখন মিডিয়ার নিত্যদিনের খবর। ফলে এই সংগঠনগুলো সরকারের ভাল কাজের খবর জনসাধারণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারছে না এবং সরকারের সাফল্যের অংশীদারিত্বও তারা দাবি করতে পারছে না। মাইনাস শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন কী দাঁড়াত তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। তাই সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষার দুটো দিক আছে বলা চলে, যে দুটো দিকের কথা জরিপে উহ্য রয়েছে, উল্লেখিত হয়নি। একটি হলো মিথ এবং অন্যটি হলো রিয়েলিটি। মিথ্ হলো, জরিপে সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের (সরকার এবং সংগঠনের) প্রতি জন আস্থা বেড়েছে বলা হয়েছে বলে অনুমিত হতে পারে। কিন্তু রিয়েলিটি হলো, জনগণের এই আস্থা বেড়েছে সরকারের প্রতি (আমি বলব বিশেষ করে শেখ হাসিনার প্রতি), আওয়ামী লীগের সংগঠনের প্রতি নয়। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সহিংসতা এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে শেখ হাসিনারও অসন্তোষ প্রকাশ সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে স্বস্তি লাভের অবকাশ কম। জনমত সমীক্ষার মিথ্ এবং রিয়েলিটির কথা যখন বলেছি তখন তার একটি উদাহরণ দেই। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চার্চিল। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধে জয়লাভ করায় ব্রিটিশ জনগণের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। তাঁকে বলা হলো সেভিয়ার অব দ্য নেশন বা জাতির ত্রাণকর্তা। চার্চিলের এই একক জনপ্রিয়তা তাঁর দল টোরি পার্টি অর্জন করেনি। কিন্তু এটা দলের অন্যান্য নেতা বোঝেননি। তারা ধরে নিলেন চার্চিলের এই জনপ্রিয়তা টোরি পার্টিরও। তারা ধরে নিলেন এই জনপ্রিয়তা থাকতে থাকতে সাধারণ নির্বাচন দেয়া ভাল। তাহলে তারা সহজেই জিতে যাবেন। তারা বুঝতে পারেননি, টোরি দলের জনপ্রিয়তা হচ্ছে মিথ্, রিয়েলিটি হচ্ছে চার্চিলের একক জনপ্রিয়তা। এই অপরিণামদর্শিতার জন্যই টোরি দল ১৯৪৫ সালেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। এই নির্বাচনে বিশ্ববাসীকে অবাক করে চার্চিলের নেতৃত্বাধীন টোরি দল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আওয়ামী লীগকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। একটি দু’টি জনমত সমীক্ষার ফল দেখে আত্মসন্তোষে ভুগলে তারা ভয়ানক ভুল করবেন। তারা মনে করতে পারেন বিএনপি এখন মৃত এবং জামায়াত এখন অর্ধমৃত সাপ। কিন্তু মৃত ও অর্ধমৃত সাপের দেহে প্রাণ সঞ্চারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ওঝার দলের এখন অভাব নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে মনীষী বারট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এখন মরা সাপ।’ কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখার পর বলেছিলেন, ‘পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মরা দেহে কখন কারা প্রাণ সঞ্চার করেছে এবং কেমন করে করেছে তা আমি বুঝতে পারিনি।’ বাংলাদেশে বিএনপিকেও মরা সাপ ভেবে আওয়ামী লীগের কোন নেতা-কর্মীর অতি উল্লসিত হওয়ার কোন কারণ নেই। মরা সাপের দেহে প্রাণ সঞ্চারের বহু দেশী-বিদেশী ওঝা এখন চারদিকে ওঁৎ পেতে বসে আছেন। আর জামায়াত যদি আধমরা সাপ হয়, তাহলে সাপের মতোই জামায়াতের নিত্যনতুন খোলস পাল্টানোর অভিনব সব কৌশল জানা আছে। তালেবান, আল কায়েদা, হরকাত-উল-জিহাদ, জেএমবি ইত্যাদি কত নাম, কত খোলস আছে জামায়াতীদের। জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য গোলাম আযম যদি ‘ভাষা সংগ্রামী’ ও ‘মজলুম জননেতা’ সাজতে পারেন, তাহলে তারই হাতে গড়া দল বাংলাদেশের জামায়াত কেন ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রামী দলের’ খোলস ধারণ করতে পারবে না? আমেরিকানরা তো তাদের মডারেট ইসলামিক দল হিসেবে একটা স্থায়ী সার্টিফিকেট দিয়ে রেখেছে। যদিও জামায়াত একাত্তরের ভয়ানক গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি প্রধান শরিক দল। কোন জরিপের ফল দেখে মরা অথবা আধমরা সাপকে উপেক্ষা করা আওয়ামী লীগের উচিত নয়। সরকারের কৃতিত্বকে সম্বল করে ভবিষ্যতে ডিজিটাল বৈতরণী সহজে পার হওয়ার আশা করাও সঙ্গত হবে না। সরকারের কাছ থেকে শক্তি আহরণ নয়, আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে নিজেকে শক্তিশালী করে সরকারকে শক্তি সরবরাহ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলো জনগণের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এজন্যে দুর্নীত, সন্ত্রাস ও আত্মকলহমুক্ত একটি আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন প্রয়োজন। শেখ হাসিনা সংগঠনটিকে সংশোধিত ও শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃণমূল পর্যায় থেকে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করুন। নইলে শুধু একক জনপ্রিয়তা ও সরকারের ভাল কাজ দ্বারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না। লন্ডন : ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২০১৬
×