ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ জালিয়াতি তদন্তে অগ্রগতি এনেছে ফিলিপিন্স সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৫ এপ্রিল ২০১৬

রিজার্ভ জালিয়াতি তদন্তে অগ্রগতি এনেছে ফিলিপিন্স সরকার

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে অনেক ‘অগ্রগতি’ এনেছে ফিলিপিন্স সরকার। আজ দেশটির ব্লু-রিবন সিনেট কমিটির চতুর্থ শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। শুনানিতে দুই চীনা নাগরিক শুহুয়া কাও ও দিং জিজের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে। আজকের শুনানিতে উপস্থিত থাকতে ওই দুই চীনা নাগরিকের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে সিনেট কমিটি। কমিটির ধারণা, ওই দুই ব্যবসায়ী ফিলিপিন্স থেকে পালিয়েছেন। এজন্য তাদের আইনের আওতায় আনতে ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে ফিলিপিন্স সরকার। এদিকে আজকের শুনানিতে চীন এবং ফিলিপিন্সের বড় বড় কোম্পানি এবং রাঘববোয়ালদের নামও বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ শুনানিতে সিনেট কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছয় ব্যক্তিকে ডেকেছে। এতে ফিলিপিন্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন, যারা এখন ফিলিপিন্সে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের চুরি করা টাকার মধ্যে আরও ৮ লাখ ২৫ হাজার ডলার ফেরত দিয়েছেন সন্দেহভাজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সিনেট ব্লু-রিবন কমিটির শুনানি রয়েছে। এ শুনানিতে সিনেট কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছয় ব্যক্তিকে ডেকেছে। এরা হচ্ছেনÑ রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দিগুইতো, রেমিটেন্স লেনদেন কোম্পানি ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট সøুইড বাতিস্তা, ক্যাসিনো মালিক কিম অং, ব্যবসায়ী উইক্যাং জু, চীনা দুই ব্যবসায়ী সুহুয়া গাও এবং ডিং জিজ। এর আগেও প্রথম চারজন শুনানিতে অংশ নেন। ওই শুনানিতে ক্যাসিনো মালিক কিম অংয়ের স্বীকারোক্তিতে শেষোক্ত দুই ব্যক্তির নাম উঠে আসে। পরে সিনেট কমিটি তাদেরও শুনানিতে ডাকে। ফিলিপিন্স থেকে হংকংয়ে পাচার হওয়ার পরও ৩৪ মিলিয়ন ডলার সেদেশে রয়ে গেছে বলে জানান কিম অং। এর আগে গত শনিবার রাতে সিনেট ব্লু-রিবন কমিটির শুনানিতে অংশ নিতে ফিলিপিন্সে পৌঁছান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা। তারা হলেনÑ বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যুগ্মপরিচালক আবদুর রব ও বাজেটিং বিভাগের সহকারী পরিচালক জাকের হোসেন। আজ মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির শুনানিতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব করবেন। চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে তারা দেশটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। আজ মঙ্গলবার ফিলিপিন্সের সিনেট ব্লু-রিবন কমিটির চতুর্থ শুনানিতে এ বিষয়ে আরও তথ্য দেবেন চীনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ব্যবসায়ী কিম অং। দেশটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, তার জবানবন্দীতে দেশটির রাঘববোয়ালদের নাম বেরিয়ে আসতে পারে। এছাড়া এ ঘটনায় হ্যাকার ছাড়াও কোন্ দেশের কতজন নাগরিক জড়িত তাও বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজকের সিনেট কমিটির শুনানিকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের গোটা ব্যাংকিং খাতের নজর এখন ফিলিপিন্সের দিকে। জানা গেছে, গেল ৪ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্সের রিজাল কর্মাশিয়াল ব্যাংকে পাঠানো হয়। রিজাল ব্যাংকের চারটি এ্যাকাউন্ট থেকে ওই অর্থ ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিলে হাতবদল হয়ে ফিলিপিন্সের মুদ্রা ব্যবস্থায় মিশে যায় বলে স্থানীয় পত্রিকাগুলো খবর প্রকাশ করে। রিজার্ভ চুরির ঘটনার পেছনে চীনা বংশোদ্ভূত ক্যাসিনোর জাঙ্কেট অপারেটর কিম অংকেই মূল ব্যক্তি বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। তবে এই ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বেজিংয়ের শুহুয়া গাও এবং ম্যাকাওয়ের ডিং জিজে নামে দুই জাঙ্কেট এজেন্ট ফিলিপিন্সে নিয়ে যায় বলে সিনেট কমিটির শুনানিতে দাবি করেছেন কিম অং। অংয়ের ভাষ্যমতে, গাও প্রায়ই ফিলিপিন্সে যাওয়া-আসা করেন এবং গত আট বছর ধরে জুয়ার মক্কেল (জাঙ্কেট এজেন্ট) এনে দেন। এ মহলে পরিচিতি রয়েছে তার। ম্যাকাওয়ের ব্যবসায়ী ডিংকেও তিনিই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। গাও একবার সোলায়ার রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনোতে এক সপ্তাহের মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ফিলিপিনো পেসো (প্রায় এক কোটি ডলার) হেরে ওই অর্থ তার কাছ থেকে ধার করেছিলেন। বাংলাদেশের চুরি যাওয়া অর্থ থেকে ওই এক কোটি ডলার গাও তাকে পরিশোধ করেন বলে সিনেট শুনানিতে দাবি করেন অং। এই এক কোটি ডলারের বাইরে দুটি ক্যাসিনোর জুয়ার এ্যাকাউন্টে থাকা আরও ৫৫ লাখ ডলার ফেরত দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এছাড়া আরও ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার এখনও হাতবদল হয়নি এবং তা মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের কাছে থাকতে পারে বলে অংয়ের দাবি। তবে তা অস্বীকার করেছেন ফিলরেমের কর্মকর্তারা। ফিলিপিন্সের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, দেশটিতে অর্থ পাচারের ঘটনায় সাতজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার অভিযোগ চূড়ান্ত করেছে এএমএলসি। ব্লু-রিবন কমিটিতে দেয়া সাক্ষ্য ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে গঠন করা হয়েছে এ অভিযোগ। তবে অভিযুক্ত সাতজনের নাম প্রকাশ করেনি এএমএলসি। আজ সিনেট কমিটির শুনানিতে নতুন করে আরও দুই ক্যাসিনো অপারেটরকে হাজির হতে বলা হয়েছে। অর্থ পাচারে কিম অং যে দুই চীনা ব্যবসায়ীর নাম বলেছেন, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে তাদের তলব করা হয়েছে। শুনানিতে অংশ নেবেন রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা বিআইআরের প্রতিনিধিও। সিনেটের শুনানিতে অংশ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাও এখন ম্যানিলায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা বলেন, রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারের তৎপরতার অংশ হিসেবে শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের দুইজন কর্মকর্তা ফিলিপিন্সে গেছেন। তারা অর্থ চুরির ইস্যুতে ওই দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন। এদিকে ফিলিপিন্সে পাচার হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক অর্থ এখনও ওই দেশেই রয়েছে জানিয়ে তা বাংলাদেশকে ফেরত দেয়া সম্ভব বলে সর্বশেষ শুনানির পর এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন দেশটির সিনেটর রালফ রেক্তো। সিনেটরের ওই বিবৃতির বরাত দিয়ে গত বৃহস্পতিবার ম্যানিলা বুলেটিন জানায়, প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলার দুটি ক্যাসিনো ও মুদ্রা বিনিময় ব্রোকারেজ হাউসের কাছে রয়েছে। ৮ লাখ ২৫ হাজার ডলার ফেরত দিয়েছেন অং ॥ বাংলাদেশের চুরি করা টাকার মধ্যে আরও ৮ লাখ ২৫ হাজার ডলার ফেরত দিয়েছেন সন্দহভাজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এর আগে ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দিয়েছেন কিম ওং। সোমবার সকালে আইনজীবীর মাধ্যমে কিম ওই অর্থ ফেরত দেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন এএমএলসির নির্বাহী পরিচালক জুলিয়া বাকে-আবাদ। তবে ৩৮ দশমিক ২৮ মিলিয়ন পেসোর মধ্যে দুটি ৫০০ পেসোর নোট জাল ধরা পড়ায় ফেরত দেয়া কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয় বলে সোমবার দ্য ইনকোয়ারারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জুলিয়া বলেন, বেলা ১১টা থেকে দুই ঘণ্টা ধরে ওই মুদ্রাগুলো গণনা করে দুটি জাল নোট পাওয়া যায়। কিমের আইনজীবী ভিক্টর ফার্নান্দেজ বলেন, কিম অংয়ের আইনী পরামর্শক ইনোসেনসিও ফেরারকে নিজের পকেট থেকে ওই দুটি জাল নোট বদলে দিতে হয়েছে।
×