ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা মামলায় চাক্ষুস সাক্ষীর অভাবে বেরিয়ে আসছে গ্রেফতারকৃতরা

সমান অপরাধী হুকুমের আসামিরাও

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৫ এপ্রিল ২০১৬

সমান অপরাধী হুকুমের আসামিরাও

বিকাশ দত্ত ॥ দশম সংসদ নির্বাচনের আগে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক সহিংসতায় যে সমস্ত আসামি গ্রেফতার হয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষীর অভাবে আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে তারা বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে যাদের নির্দেশে ৯২ দিন সহিংস আন্দোলনে সাড়ে তিনশত মানুষকে পুরিয়ে হত্যা করা হলো। সেই আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলা থেকে অনেককেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আইনজীবীদের অভিমত হুকুমের আসামিদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। তারাও একই অপরাধে অপরাধী। সমস্ত ফৌজদারি মামলা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে। কাজেই সাক্ষী না পাওয়া গেলে বিচার সম্ভব নয়। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় সে সময় সারাদেশে প্রায় ৩১৫টি মামলা হয়েছিল। আসামি করা হয়েছিল অন্তত: ৬৩ হাজার ব্যক্তিকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুরে সবচেয়ে বেশি সহিংস ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে যাদের নামে মামলা করা হয়েছে তারা সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অব্যাহতি পাচ্ছে। চাক্ষুস কোন সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা সাক্ষীর সাক্ষ্যতে অনেক মামলাই টিকছে না বলে জানা গেছে। মামলা হলেও আসামিরা কেন বেরিয়ে আসছে, এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের অভিমত এই ৬৩ হাজার নেতা-কর্মী কি নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে? তাদের পেছনে কি কারও নির্দেশ, প্ররোচনা বা ইন্ধন ছিল না? এসব অপরাধের অভিযোগের তদন্ত সরকারের যে সংস্থা করছেন, তাদের অবশ্যই এসব অপরাধের পেছনে যাদের নির্দেশ, প্ররোচনা বা ইন্ধন রয়েছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৪ ধারা, ১০৭ ধারা ও ১২০এ/বি ধারা অনুযায়ী এইসব জঘন্য অপরাধের নির্দেশদাতা, প্ররোচনাদাতা এবং পরিকল্পনাকারীরাও সমানভাবে দোষী। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, যারা গাড়ি পোড়াল, পেট্রোল ঢেলে মানুষ হত্যা করল। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে এই জঘন্য অপরাধের হুকুমদাতা কারা তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তারাও একই অপরাধে অপরাধী। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে যাত্রী হত্যার ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ পলাতক ২৮ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। অন্যদিকে সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৯ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৬ জুন দিন ধার্য করেছে আদালত। ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, এদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। দেখা যাক বিচারে কি হয়। চাক্ষুস সাক্ষীর অভাবে অনেক আসামি কারাগার থেকে বের হয়ে আসছে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে কি করে সাজা দেয়া যাবে। সমস্ত ফৌজদারি মামলা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে। সাক্ষী ছাড়া বিচার হবে না। হুকুমদাতাগণ কি ধরনের হুকুম দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কি অভিযোগ এনেছে তার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। ফৌজদারি আইনে আছে সরাসরি অপরাধের সঙ্গে তিনি আসবেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যার সম্পৃক্তা আছে। অপরাধ ঘটার সময়ে যদি কেউ প্ররোচনা দেয় তবে সে ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জাড়িত না থাকলেও প্ররোচনাকারী হিসেবে সে সম অপরাধে অপরাধী। এ জন্য কোন অপরাধী যিনি পরোক্ষভাবে প্ররোচনা দেন চক্রান্ত করেন তাকেও সমভাবে অপরাধী হিসেবে পর্যায়ভুক্ত করা যাবে। এদের এ্যাবেটার বলা হয়ে থাকে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সারাদেশে নিহত হয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক। পুলিশ সদস্য মারা যান ১৭ জন। আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক পুলিশ সদস্য। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘিরে সহিংসতা ও হেফাজতের তা-বের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় দায়ের করা অনেক মামলার তদন্তও শেষ হয়নি। মামলার অজ্ঞাত পরিচয়কারীদের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশদাতারা রয়েছে এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সুপীমকোর্টের তরুণ ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকারের কথা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- জীবনের অধিকার। এই অধিকার সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব যে শুধু সরকারের তা কিন্তু নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ওপরও দায়িত্ব বর্তায় এমন সব কাজ না করার যার দরুন অন্য একজন নাগরিকের জীবনের অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সাধারণ একজন নাগরিকের চেয়ে, যে নাগরিক রাজনীতি করেন-তার ওপর সংবিধানে উল্লেখিত যে কোন মৌলিক অধিকারসহ অন্যান্য মানবাধিকারসমূহ রক্ষা করার দায়িত্ব অনেক বেশি। গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর জাতীয় নির্বাচনের পর আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনৈতিক কর্মীগণ তাদের এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিএনপি একটি দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তার নেতা-কর্মীদের সাংবিধানিক যে রাজনৈতিক অধিকার আছে- তা থেকে বঞ্চিত করেছে। গত জাতীয় নির্বাচনের পরে আমরা দেখতে পাই যে, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মীরা সারাদেশব্যাপী এক সর্বগ্রাসী জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করে। বাস-রিক্সা-টেম্পো-রেলগাড়িযোগে যেসব সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করত, তাদের ‘জীবনের অধিকারের’ প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে, বিএনপি এবং এর রাজনৈতিক জোট যুদ্ধাপরাধী জামায়াত ইসলামীসহ অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা এসব মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে হত্যা করেছে, আহত করেছে, ঠেলে দিয়েছে অমানিশার অন্ধকারের দিকে। এর প্রমাণ বিএনপি জামাতের প্রায় ৬৩ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে করা ৩১৫টি মামলা। প্রশ্ন হচ্ছে- এই ৬৩ হাজার নেতা-কর্মী কি নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে? তাদের পেছনে কি কারও নির্দেশ, প্ররোচনা বা ইন্ধন ছিল না? এসব অপরাধের অভিযোগের তদন্ত সরকারের যে সংস্থা করছেন, তাদের অবশ্যই এসব অপরাধের পেছনে যাদের নির্দেশ, প্ররোচনা বা ইন্ধন রয়েছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৪ ধারা, ১০৭ ধারা, ১২০এ/বি ধারা অনুযায়ী এইসব জঘন্য অপরাধের নির্দেশদাতা, প্ররোচনাদাতা এবং পরিকল্পনাকারীরাও সমানভাবে দোষী। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৬ জনকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। আরেকটি মামলায় চার্জ গঠনের শুনানির জন্য ৬ জুন দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘিরে সহিংসতা ও হেফাজতের তা-বের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় দেশের ১৪টি স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ২৫ জেলায় মোট ৩১৫টি মামলার মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ৬৩টি মামলা হয়েছে যশোরে। এ ছাড়া গাইবান্ধায় ৫৩, দিনাজপুরে ৪৬, লক্ষীপুরে ৩১ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ২০টি মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলায় আসামি ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে গত বছর দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। এ সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সংঘর্ষ, বিভিন্ন যানবাহন ও ট্রেনে আগুন, রেললাইন উৎপাটনসহ নানা রকমের নাশকতা চালানো হয়। এমনকি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যা ও আগ্নেয়াস্ত্র লুট করা হয়। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ নিজেই। খালেদা আজ আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইবেন ॥ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে যাত্রী হত্যার ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ পলাতক ২৮ জন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এদিকে যাত্রাবাড়ী বাসে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যাসহ ৫টি মামলায় বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে আজ মঙ্গলবার জামিন চাইবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে যাত্রী হত্যার ঘটনায় দু’টি মামলা, গুলশান থানার একটি নাশকতার মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সম্পর্কে কটূক্তি করায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ৩০ মার্চ মামলাটির (যাত্রাবাড়ী থানার মামলা নম্বর ৫৯) চার্জশীট আমলে নিয়ে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লার আদালত। এ মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি হচ্ছেন খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জন। তাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে অথবা জামিনে আছেন ১০ জন। একই ঘটনায় দায়ের করা অপর একটি মামলায় একই আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক পৃথক আরও দু’টি চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। তিনটি চার্জশীটেই খালেদা জিয়াকে প্রধান ও হুকুমের আসামি দেখিয়ে তাকে পলাতক দেখানো হয়। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা ছোঁড়া হলে বাসের ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন। দগ্ধদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হলে ১ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নূর আলম (৬০) নামক এক বৃদ্ধ যাত্রী। মির্জা ফখরুলসহ ২৯ নেতা-কর্মীর চার্জ গঠনের শুনানি ৬ জুন ॥ সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৯ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৬ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫-এর বিচারক রুহুল আমিন এ দিন ধার্য করেন। মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল সচিবালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৯ নেতার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন পুলিশ। ২০১২ সালের ৩১ মে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক তপন চন্দ্র সাহা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাদের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
×