ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী আস্তানা থেকে চারটি পিস্তল বিপুল বিস্ফোরক ও বোমা বানানোর সরঞ্জাম উদ্ধার;###;টার্গেট ছিল পহেলা বৈশাখ- ধারণা পুলিশের

বগুড়ায় ২০ গ্রেনেড উদ্ধার ॥ বোমা তৈরিকালে বিস্ফোরণে নিহত ২

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৫ এপ্রিল ২০১৬

বগুড়ায় ২০ গ্রেনেড উদ্ধার ॥ বোমা তৈরিকালে বিস্ফোরণে নিহত ২

সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস ॥ বগুড়ার শেরপুরের জোয়ানপুর কুঠিরভিটা গ্রামে যে বাড়িতে রবিবার রাতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে ২ ব্যক্তি নিহত হয় সেই বাড়িতে পাওয়া গেছে গ্রেনেড, বিপুল বিস্ফোরক ও বোমা বানোনোর আধুনিক সরঞ্জাম, শক্তিশালী জেল আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশী অস্ত্র। সোমবার সকালে ঢাকা থেকে কাউন্টার টেররিজম ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ডিভিশনের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রহমতউল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি দল ওই বাড়ি পরিদর্শন করে। এ ছাড়াও পুলিশ ও র‌্যাব তদন্ত করছে। ধারণা করা হচ্ছে জেএমবি অথবা উগ্র জঙ্গী কোন গোষ্ঠী ওই গ্রামে ঘাঁটি বানিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, জামায়াত অধ্যুষিত ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়ি থেকে গত বছর বিএনপি-জামায়াতের কথিত আন্দোলনে নাশকতার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো। আগামীতেও দেশ অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনায় বোমা বানানোর সরঞ্জাম এনে বোমা বানানো হচ্ছিল। পুলিশের ধারণা, পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে উগ্র জঙ্গীরা এমন প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পহেলা বৈশাখে বগুড়াসহ অন্যান্য স্থানের মেলায় এই বোমা বিস্ফোরিত হতো। জঙ্গীদের এ ধরনের আরও কোন আস্তানা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম, পুলিশ ও র‌্যাব ঘরের ভেতরে থেকে ২০ হাতে তৈরি তাজা গ্রেনেড, চারটি আধুনিক পিস্তল ও ৪০ রাউন্ড গুলি, গ্রেনেড তৈরির জিআই পাইপ কেটে বানানো খোলস ৩ বস্তায় প্রায় দেড় হাজারটি, উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক ঘটানোর টিউবের নিও জেল প্রায় ৬০ কেজি, পাঁচ শতাধিক ডেটোনেটর, গ্রেনেড রিলিজ বা আনলক করার পিন কয়েক শ’, স্ক্রু ও তারের কানেকশনে অটো সুইচিং পিন, পাওয়ার সরঞ্জাম, একটি হাসুয়া, একটি পাসপোর্ট, কয়েকটি মোবাইল ফোন, মডেম ও ট্যাব, একটি নতুন মোটরসাইকেল এবং বোমা তৈরির বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার করে। পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, বিশেষ ধরনের যে জেল পাওয়া গেছে তা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। যা দিয়ে বানানো একটি গ্রেনেডে অন্তত দু’শ’ লোক মারা যেতে পারে। বস্তা ভর্তি গ্রেনেড তৈরির যে খোলস পাওয়া গেছে তা প্রতিটি দেড় ইঞ্চি ব্যাসার্ধের। এই সকেটের মধ্যে বিস্ফোরকদ্রব্য, জেল, পাওয়ার পয়েন্টের নেগেটিভ পজিটিভ তার অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে গ্রেনেড ছোড়ার উপযোগী করা হয়। এর সঙ্গে থাকে গ্রেনেড আনলক পিন, যা দ্রুত খুলে ছুড়ে দিলেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে স্পিøন্টারগুলো অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বুলেটের মতো মানব দেহে ঢুকে মেরে ফেলে। ভয়াবহ এই শক্তিশালী গ্রেনেড সেখানে তৈরি হচ্ছিল। শক্তিশালী যে বিশটি গ্রেনেড পাওয়া গেছে তা নিস্ক্রিয় করা হয়। শেরপুর থানার ওসি জানান, ডেটোনেটর ও জেল খামারকান্দিতে নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে ধ্বংস করা হবে। জোয়ানপুর গ্রামের কুঠিরবাড়ি এলাকাটি বগুড়া জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ও শেরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। জাতীয় মহাসড়ক থেকে প্রায় ২শ’ মিটার ভেতরে। এলাকার মাহবুবুল আলম থাই এ্যালুমিনিয়াম গ্লাস ও গ্রিলে চাকচিক্য এই বাড়িটি বানিয়ে মাস ছয়েক আগে মাসে ২২শ’ টাকায় ভাড়া দেয় সিএনজি অটোরিকশা চালক মিজানুর রহমানকে। বাড়ির মালিক ঢাকার ইপিজেডে ব্যবসা করেন। ওই বািড়তে মিজানুর রহমান তার স্ত্রী শাপলা ও দশ বছরের মেয়ে মোসলেমা ও ভগ্নিপতি থাকত। তাদের বাড়ি নওগাঁয়। শুক্রবার মিজানুর রহমান পরিবারসহ নওগাঁয় যায়। বাড়িতে তার ভগ্নিপতি ও এক অচেনা লোক থাকে। রবিবার রাতে তারাই বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরিত হয়ে মারা যায় বলে মনে করা হচ্ছে। এমনও ধারণা করা হয় নিহতরা বাইরে থেকে আসা কেউ। যাদের সঙ্গে বাড়ির ভাড়াটে ও মালিকের সুসম্পর্ক রয়েছে। বাড়িটির চারটি কক্ষ, ডাইনিং স্পেস ও রান্নাঘর। মাত্র একটি ঘরে খাট আছে। আর সবই ফাঁকা। এই বাড়ির দু’টি দরোজা। পেছনের দরোজা দিয়ে আসা যাওয়া করলে টের পাওয়া যায় না। বাড়ির সামনের দিকের দেয়াল উঁচু তবে পেছনের দেয়াল অনেকটা নিচু যাতে সহজেই ডিঙ্গানো যায়। পুলিশের ধারণা, সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে বাড়িটি বানানো হয়েছে। দু’টি কক্ষ বোমা বানানোর কাছে ব্যবহৃত হতো। পাশের আরেক বাড়িতে থাকে মালিকের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার ও তার স্বামী হেদায়েত হোসেন। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। হেদায়েত হোসেনও ইপিজেডে কাজ করে বলে পরিচয় দেয় তবে কি কাজ করে তা কেউ জানে না। সুমাইয়া আক্তার বলতে পারে না কে সেই বাড়িতে ছিল। এলাকার লোকজন জানায়, ওই বাড়ির দরোজা জানালা বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকত। কে থাকত কে যেত-আসত বোঝা যায় নি। কারও নাম ঠিকানাও কেউ জানে না। তবে যারা আসা-যাওয়া করত তারা এই এলাকার কেউ নয়। রবিবার রাত সাড়ে ন’টার দিকে ওই বাড়িতে উচ্চ ক্ষমতার বোমা বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। ফায়ার সার্ভিস গিয়ে ঘরের ভেতরে দুই ব্যক্তিকে বোমায় রক্তাক্ত দেখে পুলিশে খবর দেয়। আহতদের দ্রুত বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। পথেই একজন ও অপর ব্যক্তি হাসপাতালে মারা যায়। তাদের কোন পরিচয় মেলেনি। আহত ব্যক্তিকে বার বার জিজ্ঞাসা করা হলে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে কোন পরিচয়ই দেয়নি। সোমবার বিকেল পর্যন্ত লাশগুলোর দাবি কেউ করেনি। খোঁজ খবর করে জানা যায়, গ্রামে অচেনা লোকের আনাগোনা ছিল বেশি। বোমা বিস্ফোরণের পর বিষয়টি সকলের নজরে আসে। এর আগে কি পরিমাণ বোমা বা গ্রেনেড বানিয়ে কোথাও পৌঁছানো হয়েছে কি না সে খবর নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে এর আগেও এই বাড়ি থেকে অনেক গ্রেনেড বগুড়া ও অন্যান্য জায়গায় গেছে। বগুড়ার পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, এই ঘটনায় এখনও কাউকে আটক করা হয়নি। ঘটনার গভীরে গিয়ে তদন্ত করা হবে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের পরিচয় মেলেনি।
×