ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ॥ ‘ঢাকাকে বাসযোগ্য করা হবে’

৬ মাসের মধ্যে সরাতে হবে আবাসিকের বাণিজ্যিক স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৫ এপ্রিল ২০১৬

৬ মাসের মধ্যে সরাতে হবে আবাসিকের বাণিজ্যিক স্থাপনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকার প্রথম ৩০০ বছর ছিল প্রাক শিল্প যুগ। তখন শিল্প ছিল না। এই শহরে প্রথম পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৪ সালে। বিদ্যুত আসে ১৮৭৮ সালে। প্রথম রেললাইন স্থাপিত হয় ১৮৮৫ সালে। মোটরযান শুরু হয় গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে। প্রথম শিল্পের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এরপর দ্রুতগতিতে বদলে যেতে থাকে ঢাকার চিত্র। কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে গোটা রাজধানীই এখন বাণিজ্যিক নগরীতে পরিণত হয়েছে! হারিয়েছে আবাসিক চরিত্র। নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা না করেই ইচ্ছেমতো হয়েছে নগরায়ন। এখনও অব্যাহত। ফলাফলÑ বসবাসের অযোগ্য হিসেবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারির তালিকায় স্থান পেয়েছে একসময়ে ঐতিহ্য আর হস্তশিল্পে সমৃদ্ধ এই শহর। বিশিষ্ট নগরবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, ঢাকা আজ শুধু রাজধানী শহরই নয়, এটি এখন শিল্প, বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও শিক্ষার শহর। ১৯৯২ সালের পর এই শহরে গড়ে উঠেছে ৫৪টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। হাজারো বছরের পুরনো ঢাকা এখন পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর একটি। এই নগরীকে স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক শহর করতে হলে প্রয়োজন তিন থেকে চারভাগে ভাগ করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বাস্তবতা হলো কাজের কাজ কিছু হয়নি। দিন দিন সঙ্কট বাড়ছে। হচ্ছে ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতম। এই প্রেক্ষাপটে গোটা নগরীকে বাসযোগ্য করে তুলতে শেষ পর্যন্ত সরকারকেও কঠোর অবস্থানে যেতে হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপন করে সঙ্কট সমাধানে উপায় খুঁজতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন নিয়ে। সোমবারের মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শহর এলাকায় আবাসিক প্লট ও ভবন থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে ছয় মাস সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার। এই সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো না সরালে সেগুলো উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগের এই সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আলোচনার পর মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয় বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মন্ত্রিসভার ২০১৫ সালের ৮ জুনের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগ তাদের প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ তুলে ধরে। আবাসিক এলাকায় বার লাইসেন্স বাতিল করে সেগুলো অপসারণ করা হবে। আবাসিক এলাকায় নতুন করে কোন বারের লাইসেন্স দেয়া হবে না। পাশাপাশি আবাসিক এলাকার সব গেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল বন্ধ করতে হবে। প্লট মালিককে এসব স্থাপনা সরাতে ছয় মাসের সময় দেয়া হবে। এর মধ্যে স্থাপনা না সরালে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সেগুলো অপসারণ করা হবে বলে সচিব জানান। আবাসিক এলাকার অননুমোদিতভাবে স্থাপিত সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও ছয় মাসের মধ্যে সরাতে হবে। যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে আবাসিক এলাকায় কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেসব স্থাপনা সরাতেও সংশ্লিষ্টদের সময় দেয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান। তিনি জানান, গত বছরের ৮ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনার বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়। গোটা রাজধানী কেন বাণিজ্যিক হলো ॥ নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকা কখনই বাণিজ্যিক হওয়ার কথা ছিল না। কাঁচাবাজার, পশুরহাট, নিত্যপণ্য, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতানের জন্য পৃথক পৃথক এরিয়া নির্ধারণ করার কথা ছিল। এজন্য মূলত দায়িত্ব ছিল নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ রাজউকের। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আজ গোটা নগরী বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই শহরের আবাসিক, বাণিজ্যিক চরিত্র বোঝা এখন কঠিন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নগর উন্নয়নের সঙ্গে ২০টির বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এ জন্য দায় এড়াতে পারে না কেউ। তবে ভবন নির্মাণ ও আইন মানার পুরো বিষয়টি দেখভালের দায় রাজউকের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নগর বিশেষজ্ঞরা শামসুল হক জনকণ্ঠ’কে বলেন, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি। শহরের আবাসিক বাণিজ্যিক চরিত্র এখন বোঝা যায় না। সবই একই রকম মনে হয়। তিনি বলেন, নগরীর চরিত্র বদলানোর প্রতিযোগিতা এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইচ্ছেমতো ভবন নির্মাণ হচ্ছে। যেখানে সেখানে হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কিছু আবাসিক জোন সম্প্রতি একেবারেই চরিত্র হারিয়ে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। এমন তো কথা ছিল না। তিনি বলেন, কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ এ কাজটি করেছেন। যাদের দেখে দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়েছেন। হাত গুটিয়ে বসেছিল রাজউক। তারা কোন কাজ করেনি বরং অপরাধকে লালন করেছে বছরের পর বছর। এই সুযোগে সঙ্কট এখন মহামারি আকারে ছড়িয়েছে। যে কারণে মন্ত্রিপরিষদে এ নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যদি রাজউক কাজের কাজটি করত তাহলে এ রকম সমস্যা এখন হতো না। দায়িত্বে গাফিলতির জন্য রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়ে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রতিটি দেশেই নগর উন্নয়নে একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তারা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করে। এ্যাকশন হয়। সব কাজের ফলোআপ হয়। আমাদের এখানে কিছুই হয় না। তাই বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে হলে এখন কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। গবেষকরা বলছেন, রাজউক আর সিটি কর্পোরেশনকে সমন্বয় করে নগর গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার পর এক বছরের মধ্যে সংবিধান, দুই বছরের মধ্যে পাঁচসালা পরিকল্পনা হয়। কিন্তু রাজধানী শহরের জন্য পরিকল্পনা হয়নি। ১৯৭৪ সালের মধ্যেই রাজধানীর পরিকল্পনা হওয়া জরুরী ছিল। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সময় ১৯৫৮-৫৯ সালে তৎকালীন ডিআইটি যে নগর মহাপরিকল্পনা নেয় সেটাই ভিত্তি। এই মহাপরিকল্পনার মাধ্যমেই ঢাকা নগরী একটি কাঠামো পেয়েছিল। এর আওতায় গড়ে উঠেছিল মিরপুর রোড, ভিআইপি রোড, তেজগাঁও, ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, বনানী, লালমাটিয়া, গুলশান, উত্তরা ও শেরেবাংলানগর। এটা না হলে এই নগরে একেবারেই বসবাস করা যেত না। এখন সমস্যা বাড়ছে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ না হওয়ার কারণেই। ১৯৯৫ সালে নেয়া পরিকল্পনা এক বছর পর ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়। ২০১০ সালে ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নামে যে পরিকল্পনাটি নেয়া হয়েছে সেটা ঢাকার স্বার্থে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। ইতিহাসবিদরা বলছেন, ঢাকা শহরের রয়েছে হাজারো বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ ১৬১০ সালে। তখন ঢাকাকে সুবাহ বাংলার প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। শহর বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে বিকাশ লাভ করলেও পর্যায়ক্রমে পশ্চিম তুরাগ নদ ও উত্তরে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। গত ৪০০ বছর ধরে এই তিনটি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল এবং এর বাইরেও ঢাকার বিস্তৃতি ঘটেছে। আয়তনে ঢাকার বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে স্থানীয় ভৌগোলিক অথবা ভূসংস্থানিক অবস্থা ও পরিবেশ। নগরীতে দৃষ্টি যতদূর যাবে সবখানেই হাট-বাজার আর বাণিজিক চিত্র। আবাসিক ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত চলছে। হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দোকানপাটেরও অভাব নেই। বাসা-বাড়িতে বিষাক্ত রাসায়নিক গুদাম আছে নগরীর বাদামতলীসহ ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট হচ্ছে ইচ্ছেমতো। অলি-গলিতে হচ্ছে বহুতল ভবন। পরিবহন সঙ্কট তো আছেই। উপশহর থেকে মূল শহরের রাস্তায় আসতে আধুনিক যোগাযোগ স্থাপনের কোন সম্ভাবনাও নেই। অপরিকল্পিত অবকাঠামো ৭৩ ভাগ ॥ শহর ও নগর উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন থেকে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নূরুল হুদা। বুয়েটের গবেষকরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় গড়ে ওঠা অবকাঠামোর ৭৩ শতাংশ পুরোপুরি অপরিকল্পিত। একটি বড় সিটির জন্য মোট ভূমির প্রায় ২৫ ভাগ রাস্তা প্রয়োজন অথচ রাজধানী ঢাকা শহরে আছে ৮ ভাগের কম। প্রস্থের দিক থেকে ২০ ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ছয় ভাগেরও কম রাস্তা ব্যবহারের উপযোগী। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য রাস্তা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু রাজধানীজুড়েই স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় অপরিকল্পিত নগরায়ন ও রাজধানী উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগর উন্নয়নের বিষয়ে সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন না করায় অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে। জায়গা না রেখে নির্মিত হয়েছে বেশিরভাগ ভবন। বেশিরভাগ স্থাপনা হয়েছে রাস্তা ঘেঁষে। সড়ক দখল করেও ভবন নির্মাণ হয়েছে। মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করতে হলে কতটুকু জায়গা রাখা প্রয়োজন, পার্কিং সুবিধা আছে কিনা, ঢাকার শহরতলি অঞ্চলগুলোতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ রাস্তা থাকা জরুরী এর কোন কিছুই দেখভাল হয়নি। আমরা উন্নত শহরের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবধান হবে অনেক বেশি। ভুলে আর অবহেলায় তৈরি এই নগরী এখন ঢেলে সাজানো কষ্টসাধ্য। নগরজুড়েই অপরিকল্পনার ছাপ ॥ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই রাজউকের জমি দখল করে গুলশান লেকে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন জব্বার টাওয়ার। দীর্ঘ সময় ভবনটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও কিছুই করতে পারেনি সংস্থাটি। তেমনি হাতিরঝিলে অনুমোদনহীন বিজিএমইএ ভবন নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি রাজউক। কোন রকম পার্কিং সুবিধা না রেখেই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে কাপ্তান বাজার মার্কেট। খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, চানখাঁরপুল সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইস্টার্ন প্লাজা, মোতালেব প্লাজা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য মার্কেট, বাড়ি ও স্থাপনা রয়েছে। এর সবই প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়নি। আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করে বাণিজ্যিককরণ করা হয়েছে অথচ দেখা বা বলার কেউ নেই। এক সময়ের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারার চরিত্র পাল্টে গেছে। এখন দেখলে মনে হবে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে এটি হয়ত তৈরি করা হয়েছিল। গবেষণা বলছে, বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে মানা হয়নি ভূমি ব্যবহারের যথাযথ নীতিমালা। বুয়েটের গবেষণায় দেখানো হয়, জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে গড়ে ওঠা অপরিণামদর্শী উন্নয়নের ফলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থার কারণে বিপর্যস্থ পরিবহন খাতও। গবেষক দলের প্রতিনিধি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক এসএম সোহেল মাহমুদ জানান, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠায় ঢাকা শহরে নিত্যদিনের ভোগান্তি বাড়ছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের উন্নয়নে কার্যকর কোন নীতিমালা না থাকায় যেখানে সেখানে গড়ে ওঠা এ অবকাঠামোর ফলে ভূমির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ১৯৫৯ সালের মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এ শহর। নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্যের কারণে এ শহরের অবকাঠামো উন্নয়নে সে পরিকল্পনাও অনুসরণ করা হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাহাবুব-উন-নবী জনকণ্ঠ’কে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উন্নত শহরের আদলে রাজধানীকে গড়ে তুলতে না পারার জন্য দায়ী সরকার। কারণ নগর উন্নয়ন ও সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কোন সংস্থাকে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। অর্থাৎ সরকার প্রয়োজনমতো উন্নয়ন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে নগর উন্নয়নের জন্য সমস্ত দায়িত্ব রাজউকের হাতে বলা হলেও তা শুধু বলার জন্য বলা। এ পর্যন্ত সরকারী কোন সংস্থা আইন অমান্য করলে রাজউকের ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। নিয়ম ভঙ্গ করে সরকার অথবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ভবন নির্মাণ করলে কিছুই করতে পারে না রাজউক। শুধু নিরীহ মানুষদের ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতা দেখাতে পারে। বিশিষ্ট এই নগরবিশেষজ্ঞ বলেন, একজন যুগ্মসচিবের পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন রাজউকের চেয়ারম্যান। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মন্ত্রীর সম-মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের যে কোন ভুল সিদ্ধান্তে রাজউক হস্তক্ষেপ করে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। ২৫ ভাগ ভূমি স্থাপনা নির্মাণের উপযুক্ত ॥ বুয়েটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, নীতিমালা মেনে অবকাঠামো গড়ে তোলার মতো উঁচু জমি নেই রাজধানীতে। মাত্র ২৫ শতাংশ ভূমি স্থাপনা নির্মাণের উপযুক্ত। বাকি অংশ নিম্নাঞ্চল বা বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ ঝুঁকির মধ্যেই অবকাঠামো নির্মাণ করায় প্রতিবছর প্রতিস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা খরচ হয়। বর্তমানে ঢাকা শহরের ৬২ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ভূমিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং বাকি ৩৭ শতাংশে অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ৮ শতাংশ ভূমিতে বাণিজ্যিক ও ৯ শতাংশে প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ৪ শতাংশ জায়গায় উন্মুক্ত জলাশয়সহ ১০ শতাংশ ভূমিতে গড়ে উঠেছে, সেনানিবাস এবং ২ শতাংশে বিমানবন্দর। পরিকল্পিত কোন মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বড় বড় প্রশাসনিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিমানবন্দর। শহরের ১২ শতাংশ জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা প্রভাব ফেলছে সামগ্রিক উন্নয়নে। নগর উন্নয়নে প্রথম মাস্টারপ্ল্যানে ৫ শতাংশ খোলা জায়গা ছিল। গত ৫৪ বছরে খোলা জায়গার পরিমাণ কমে পৌঁছেছে ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে। এ বিষয়ে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, পৃথিবীর কোন দেশেই রাজধানী ঢাকার মতো অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়নি। দীর্ঘ সময় পর ঢাকা শহরের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। তিনি বলেন, ঢাকার মতো জনবহুল শহরের জন্য একটি নগর পরিকল্পনা খুবই জরুরী। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে গড়ে ওঠা ভবনের জন্য এ শহর বসবাসের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিশীলিত নগরায়নের জন্য শীঘ্রই বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী এগোতে হবে। তা না হলে ঢাকা শহরকে রক্ষা করা ক্রমেই দুরূহ হবে।
×