ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইডেনে মন ছুঁয়ে দিল সামিদের নৃত্য

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৫ এপ্রিল ২০১৬

ইডেনে মন ছুঁয়ে দিল সামিদের নৃত্য

মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ করতে করতে চ্যাম্পিয়নই হয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবাইকে পেছনে ফেলে টি২০ বিশ্বকাপে এক নম্বর দল হয়ে গেল। শিরোপা ঘরে তুলল। সেই শিরোপা হাতে নিয়ে ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গানের তালে নাচতে নাচতে থাকল। ব্রাথওয়েট যখন এক এক করে শেষ ওভারে চার ছক্কা হাঁকালেন, তখন সবার কণ্ঠে একই সুর, ‘হোয়াট আ ম্যাচ। হোয়াট আ ব্রাথওয়েট!’ আর যখন ৬ বলে ১৯ রান থাকা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর শিরোপা নিয়ে ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গানের তালে নাচতে থাকে, তখন সবাই বলতে থাকেন, ‘হোয়াট আ টিম ওয়েস্ট ইন্ডিজ!’ সবার মন ছুঁয়ে দিয়েছে এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। জেতার আনন্দ কত ভাগে উপভোগ করা যায়, তা বুঝিয়ে দিল। ‘পাগলা নাচ’ দেয় সামি, ব্রাভো, রাসেল, স্যামুয়েলস, গেইলরা। কখনও শুয়ে নাচ দেয়। কখনও আবার পেছন ফিরে নাচ দেয়। কখনও একে অপরকে গলায় জড়াজড়ি করে নাচ দেয়। কখনও মাটিতে লুটিতে পড়ে। ডিগবাজি খেতে থাকে। জার্সি খুলে খালি গায়ে ঘুরতে থাকে। পাগল হয়ে যায় যেন। নাচতেই থাকে। তা আর শেষ হয় না! নাচতে নাচতেই শিরোপা হাতে নিয়ে মাঠ ছাড়েন ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা। কোনভাবেই নাচ থামে না। হোটেলে যেতে টিম বাসে ওঠার আগে নাচেন। তাজ বেঙ্গল হোটেলে রুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত যতক্ষণ সময় লাগে, নাচতে থাকেন সামিরা। এমনই অবস্থা হয়, সবাইকে মাতিয়ে তুলেন। তাদের এই যে আনন্দ, এই যে আনন্দ উপভোগ করার স্টাইল; তা সবার মনে তালের সৃষ্টি করেছে। সচরাচর কী ঘটে? ম্যাচ শেষ হলেই পুরো স্টেডিয়াম খালি হতে থাকে। রবিবার কী ঘটেছে? সবাই জানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেহেতু চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূূর্ণ ম্যাচ থেকে যে আনন্দ মিলেছে; তারচেয়ে দ্বিগুণ আনন্দ দেবেন সামিবাহিনী। ঠিকই তাই হয়েছে। দর্শকরা মাঠ ছাড়েননি। তাদের ‘ড্যান্স’ দেখতেই স্টেডিয়ামে থাকেন। সামিরাও হতাশ করেননি। ম্যাচ শেষ হতেই নাচ শুরু করে দেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর থেকে স্টেডিয়াম ছাড়ার আগ পর্যন্ত ব্রাভোর গাওয়া ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গানটি বাজতেই থাকে। গানটি গান ব্রাভো। যাকে এখন তাই ‘ডিজে ব্রাভো’ বলা হয়। এই গানের তালে তালে দুই হাত সামনে উঁচু করে উইকেটের মাঝখানে গিয়ে নাচেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন মহিলা টি২০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ মহিলা ক্রিকেটাররাও। নাচতেই থাকেন সামিরা। শিরোপা হাতে নেয়ার আগেও নাচেন। শিরোপা নিয়েও নাচেন। এমনই অবস্থা হয়, শিরোপা হাতে যে গ্রুপ ফটোসেশন হয়, তাদের নাচের তালে সেই ফটোসেশনই হতে পারছিল না। শেষপর্যন্ত আইসিসির কর্মকর্তারা অনেক অনুরোধ করে একটু সময়ের জন্য তাদের ‘ড্যান্স’ থামান। কী অবস্থা হয়েছে, তাতেই বোঝা যায়। ম্যাচ জেতার চেয়েও বেশি এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের আনন্দ উপভোগের দৃশ্য দেখতে সবাই অপেক্ষায় থাকে। ইংল্যান্ডের কেভিন পিটারসন তো সঙ্গে সঙ্গে টুইট করেছেন, ‘কী ব্যাটিংটাই না করল ব্রাথওয়েট! তুমি একজন সুপার স্টার!’ ভারতের গৌতম গম্ভীরও টুইট করেছেন, ‘সুপার শো!’ টুইটের ছড়াছড়ি লেগে যায়। শ্রীলঙ্কার এ্যাঞ্জলো ম্যাথুস যেমন টুইট করেন, ‘অসাধারণ ম্যাচ। অসাধারণ ফাইনাল।’ আসলেই ম্যাচটি অসাধারণই হয়েছে। কী উত্তেজনা ম্যাচে। একটা সময় মনে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতবে। একটা সময় মনে হয়েছে জিতবে ইংল্যান্ড। শেষ ওভারে গিয়ে যে কোন দল জিততে পারে। এমন স্নায়ুচাপের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে যতটানা ডোবালেন ব্রাথওয়েট, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো স্টোকসের। তিনিই যে শেষ ওভারটি করতে আসেন। আর টানা চার বলে চার ছক্কা হাঁকিয়ে দেন ব্রাথওয়েট। স্টোকসের ক্যারিয়ার নিয়েই তো এখন টানাহেচড়া শুরু হয়ে যাবে। চার ছক্কায় বিশ্বজয় করে বসল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১২ সালের পর আবারও টি২০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলো। তারাই এখন একমাত্র দল, যারা একাধিকবার টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছে। ২০০৭ সালে ভারত, ২০০৯ সালে পাকিস্তান, ২০১০ সালে ইংল্যান্ড ও ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেভাবে খেলল, মনে হলো ‘নতুন যুগে’র সূচনাই হয়ে গেল। যে যুগ ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও ইঙ্গিত মিলেছিল। এবার যেন সেই ইঙ্গিত আরও পাকাপোক্ত হলো। প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে দলটি। বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যুব বিশ্বকাপে এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যুবারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মহিলা টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মহিলা ক্রিকেটাররা শিরোপা জিতেছে। এবার জিতল পুরুষ দলও। এটাকে নতুন যুগের সূচনাই তো বলা চলে। এ রকম ইতিহাস আজ পর্যন্ত কোন দলের নেই। একসঙ্গে যুবদল, মহিলা দল ও পুরুষ দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই করে দেখাল। তাতে করে প্রশংসা তো প্রাপ্যই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি, অর্থ নিয়ে যে ক্রিকেটারদের মধ্যে সবসময় ঝামেলা লাগে; এখন হয়ত সেটি দূর হয়ে যাবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন সামি ফাইনালের আগের দিন বলেছিলেন, ‘আমরা শিরোপা জিতেও উৎসব করতে চাই।’ সেমিফাইনালে ভারতকে হারিয়ে যে উৎসব করেছেন সামিরা, তারচেয়েও অনেকগুণ বেশি আনন্দ শিরোপা হাতে করেছেন। সঙ্গে বোর্ডের সঙ্গে তাদের ঝামেলা নিয়ে বলেছিলেন, ‘ধৈর্যই সবকিছুর অর্থ বুঝিয়ে দেয়।’ ইংল্যান্ডের মাইকেল ভনতো বলেই দিয়েছেন, ‘সামিকে শ্রদ্ধা করি। সে যে বলেছে “ধৈর্যই সবকিছুর অর্থ বুঝিয়ে দেয়” এখন বোর্ড নিশ্চয়ই তা নোট করবে?’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বারবাডোজ, কিউবা, জ্যামাইকা, হাইতি, গায়ানা, ত্রিনিদাদ এ্যান্ড টোবাগোতে আনন্দের র‌্যালি বের হয়। উৎসব হয়। জ্যামাইকান গতি মানব উসাইন বোল্টতো পেছনে টিভি ছেড়ে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটারদের সঙ্গে নাচের তালে যেন একাকীত্ব হয়ে যান। গাইতে থাকেন, ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’। সঙ্গে নাচতেও থাকেন। আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও ব্রায়েনতো টুইট করেন, ‘গ্রেট টুর্নামেন্টের শেষটাও কী গ্রেটভাবে হলো। বোঝা যাচ্ছে, পার্টি লং টাইম ধরেই হবে।’ ভারতের হরভজন সিং টুইট করেন, ‘হাহাহা...!!! সুপার ডিজে ব্রাভো, গেইল। তোমরা সবার ভেতরই চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন তাল তুলে দিয়েছে।’ শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া যেমন বিশদভাবেই টুইট করেছেন, ‘অকল্পনীয় কাজ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পুরো ফলই বদলে দিয়েছে। গ্রেট নক মারলন। তোমরা সত্যিই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য।’ পাকিস্তানের সাঈদ আজমল যেমন টুইট করেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে। ক্রিকেটে সেরা ম্যাচগুলোর একটি।’ ভারতের বীরেন্দর শেবাগ তার টুইটে কিছু বলেননি। তবে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। যেটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়নে’র তালে নাচছেন। ভারতের আজিঙ্কেয়া রাহানে লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলকে। কী দারুণ জয়!’ অস্ট্রেলিয়ার জেসন গিলেস্পিতো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ড্যারেন সামির আবেগ প্রবণ কথাগুলো শুনে মুগ্ধ। লিখেছেন, ‘গ্রেট ভালবাসা ড্যারেন সামি। আমি যে পোস্ট ম্যাচগুলো দেখেছি, এর মধ্যে সামির পোস্ট ম্যাচটি নিঃসন্দেহে সেরা।’ কী বলেছিলেন সামি? দেশের বোর্ডের কর্মকর্তাদের ধুয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তারা আমাদের কোন খেয়াল রাখেনি। এমনকি আমরা জার্সি থেকে শুরু করে সবকিছু নিজেরাই ব্যবস্থা করেছি।’ আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়েছেন সামি। পরে ক্রিকেট বোর্ডও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকর লিখেছেন, ‘তোমরা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কর্টনি ওয়ালস লিখেছেন, ‘টিম আসলেই চ্যাম্পিয়নের মতোই খেলেছে।’ অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন যেমন লিখেছেন, ‘অসাধারণ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছে মারলন। আর ব্রেথওয়েটেরতো তুলনাই হয় না।’ ভারতের বিরাট কোহলি লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমকে। অবিশ্বাস্য জয়!’ বাংলাদেশের মুশফিকুর রহীম টুইট করেছেন, ‘হোয়াট আ টিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাস্ট অসাধারণ। তোমরা এটার যোগ্য।’ শহীদ আফ্রিদি টুইট করেছেন, ‘ক্রিকেটের জয় হয়েছে আসলে।’ সত্যিই ক্রিকেটের জয় হয়েছে। ইংল্যান্ড হেরেছে। তবে দুর্দান্ত খেলেছে তারাও। শেষ ওভারে ব্রেথওয়েটের ব্যাটিং ভেল্কিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে গেছে। সেই জেতার পর যে আনন্দ করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সবার মনকে ছুঁয়ে গেছে!
×