ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সবুজের বনসাই রাজ্য

খর্বাকৃতির বৃক্ষজুড়ে শিল্প সুন্দর, বহু সাধনার শিল্পকর্ম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৪ এপ্রিল ২০১৬

খর্বাকৃতির বৃক্ষজুড়ে শিল্প সুন্দর, বহু সাধনার শিল্পকর্ম

মোরসালিন মিজান, গাজীপুর থেকে ফিরে ॥ নাম সবুজ। কে এম সবুজ। থাকেনও সবুজ নিয়ে। সরকারী চাকরি। ছোট্ট সংসারে স্ত্রী, একপুত্র। এরপর যেটুকু সময়, বৃক্ষকে দেন উজাড় করে। সাধারণ বৃক্ষ তার পরিচর্যায় বেঁচে থাকে। বড় হয়। আর কিছু বৃক্ষ ছোট। খর্বাকৃতির। সবুজ নিরন্তর সাধনায় এগুলোকে নিজের মনের মতো করে গড়ে নেন। শৈল্পিক আর সুন্দর করেন। হ্যাঁ, বনসাইয়ের কথা বলছি। এই শিল্পকর্ম নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তাঁর। বনসাইয়ের রীতিমতো রাজ্য গড়েছেন। অসংখ্য বনসাই দিয়ে সাজিয়েছেন বসতভিটার চারপাশ। ভূমিতে যেমন, ছাদেও। প্রদর্শনীতে এসবের কিছু দেখা হয়েছে বটে। রাজ্যটি ঘুরে দেখা হলো সম্প্রতি। সত্যি মুগ্ধ হওয়ার মতো। মূল রাজ্য গড়া হয়েছে গাজীপুরে। আমবাগ এলাকায়। এখানে বেশ কিছু জায়গা নিয়ে কে এম সবুজের বনসাই রাজ্য। গাড়ি থেকে যেখানে নামতে হয় ঠিক সেই পথের ধারে বনসাই যেন স্বাগত জানায়। হালকা বেড়া দেয়া স্থানটি বাগানের মতো। ভেতরে প্রবেশের আগে একাধিক মাটির ডিবি। গাছ যেমন চায়, সেভাবে মাটি প্রস্তুত করে পলিপ্যাকে ভরা হচ্ছে। তারপর গুঁজে দেয়া হচ্ছে চারা। একই প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে টব। পরে এগুলো চলে যাচ্ছে রাস্তা ঘেঁষে থাকা জমিতে। মাটিতে সরাসরি কোন গাছ লাগানো হচ্ছে না। ভূমির পুরোটাই পলিপ্যাক বা টবে সাজানো। অসংখ্য পলিপ্যাক। প্রতিটিতে চারা। ছোট কঁচি পাতা উঁকি দিচ্ছে। বড় পলিপ্যাক ও টবে পরিণত গাছ থেকে কেটে আনা শাখা প্রশাখা পুঁতে রাখা হয়েছে। তাতেই প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে! নতুন প্রাণ। বাড়ির পেছনের জায়গাটা আরও বড়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, চারা হয়ে নেই কোনটি। সবকটি গাছ। কিছু গাছ অর্ধেক করে কাটা ড্রামে। সেখান থেকেই শাখা প্রশাখা বিস্তার করছে। বনসাইগুলোও অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির। কোন কোনটিতে চমৎকার ফল ধরে আছে! একটি গাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে ঘ্রাণ শুকতে দিলেন সবুজ। বললেন, দেখুন একদম আসল ঘ্রাণটা। এবং নাকের কাছে নিতেই সে ঘ্রাণ পাওয়া হলো, আহ, কী সতেজ সে ঘ্রাণ! সবুজ বাসার দুটি ছাদেও বনসাই করেছেন। ছোট একটি ছাদে হিজল তমাল শিমুলের বনসাই। কামিনীর আছে পাঁচটা জাত। শেওড়াও নজর কাড়ে। এখানে কয়েকটি গাছ দেখিয়ে সবুজ বললেন, বাইরে থেকে আনিয়েছি। নাম জানি না। নতুন নতুন গাছ সংগ্রহের নেশা থেকে সারা বছরই দেশে আসা প্রবাসীদের হাতে টাকা তুলে দেন তিনি। প্রবাসীরা এর পর আর গাছ না নিয়ে আসতে পারেন না! সবুজের বনসাইয়ের প্রদর্শনী বলা যায়, বড় ছাদটিকে। এখানে সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে স্থির হয়ে আছে বনসাই। সুন্দর টবে দারুণ উপস্থাপনা। যেন বনসাইয়ের প্রদর্শনী। দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। এখানে বহু জাতের বট। অশ্বত্থের ঝিলিমিল পাতা দেখে মন ভরে যায়। পাকুর বট, চায়না বটও অনিন্দ্য সুন্দর রূপে ধরা দিচ্ছে। আছে বেশ কিছু কামিনী। রঙ্গন, জবা আছে। আছে রঙিন বাগান বিলাস। পেয়ারার বনসাই করা হয়েছে। তাতে দিব্যি ধরে আছে ফল। জাম গাছের বনসাইয়ে এসে গেছে ফুল। তেঁতুলের চিরুনীর মতো ঘন পাতার দিকে তাতিয়ে থাকতে হয়। কদবেল, জামরুল আছে। জামরুলও খাওয়ালেন সবুজ। আম গাছের বনসাইয়ে মুকুল এসেছে। আছে করমচার বনসাই। চায়না বাঁশ বাঁশ বটে। দেখতে দারুণ সুন্দর। এত সুন্দর যে, বাঁশ বা বন বলে মনে হয় না। জিলাপির বনসাই নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন সবুজ। সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দর বনসাই রাজ্য। ১ বিঘার বেশি জায়গা এবং দুটি ছাদে টুকরো টুকরো সবুজ শুধুই লালন করা হচ্ছে। নিজের হাতে গড়া বনসাই রাজ্য ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে কে এম সবুজ বললেন, বেশ কয়েক বছর আগে শুরু করেছিলাম। প্রথমে কেউ তেমন উৎসাহ দেননি। ধীরে ধীরে আমি সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছি। এখন বনসাই আমার সংসারের অংশ। বৃক্ষপ্রেম থেকেই বনসাইয়ে আসা। এখন তিন হাজারের বেশি বনসাই সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে বলে জানান তিনি। প্রক্রিয়াধীন আছে কয়েক হাজার। বলেন, সম্প্রতি শুধু বকুলের ৮ হাজার চারা কিনেছি। হিজল কিনেছি ১ থেকে দেড় হাজার। প্রায় একই সংখ্যা হবে তেঁতুলের। এ খাতে বিপুল সংগ্রহ। সবুজ বলেন, বিশাল যে বৃক্ষ, চাইলেই একে কাছে রাখা যায় না। তাই বিকল্পটি বনসাই। বিশেষ করে শহুরে জীবনে এইসব টুকরো টুকরো সবুজের আবেদন অস্বীকার করা যায় না। যেন প্রকৃতির ছোঁয়া। ভালবাসা থেকে করলেও, ঢাকায় বনসাইয়ে নিয়মিত প্রদর্শনী করেন তিনি। বিক্রিও হয় ভাল। সবুজ জানান, কেউ আগ্রহী হলে তাদের চাহিদামতো বাগান করে দেন তিনি। সাধারণের মাঝে বৃক্ষপ্রেম জন্মাতে স্কুল কলেজে চারাও বিতরণ করেন। এবং তা বিনামূল্যে। আজকের পৃথিবীর প্রয়োজনে সবুজের এই প্রেম, সবুজের জন্য প্রেম বেঁচে থাক। আমাদের তাই প্রত্যাশা।
×