ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

অভিভাবকহীন অটিস্টিক শিশুদের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩ এপ্রিল ২০১৬

অভিভাবকহীন অটিস্টিক শিশুদের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অটিস্টিকদের বিকাশের সুযোগ করে দিতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অটিস্টিকদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। সেই প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে মেধা বিকাশের মাধ্যমে তারাও যেন সমাজকে কিছু উপহার দিতে পারে। অটিস্টিকসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রকাশেরও অধিকার আছে। তাদের সে সুযোগ দিতে হবে। আর অটিস্টিক শিশুদের পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের লালন-পালনের জন্য রাষ্ট্রই উদ্যোগ গ্রহণ করবে। শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নবম ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণে এসব কথা বলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব চৌধুরী মোঃ বাবুল হাসানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ মোজাম্মেল হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসরীন আরা সুরাত আমিন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে কিছু সময় কাটান। এরপর তিনি প্রতিবন্ধীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেন। অটিস্টিকদের সর্বাত্মক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সব সময় উপলব্ধি করি যে, অটিস্টিক শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে মায়ের। তাই তাদের মা-বাবা যখন থাকবে না, তখন এদের কি হবে? এরা কোথায় যাবে? আমরা এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নিচ্ছি। বাবা-মা যখন থাকবে না, তখন সরকারের পক্ষ থেকে তাদের লালন-পালনের ব্যবস্থা আমরা করব। আজ আর প্রতিবন্ধিতার জন্য মা-বাবাকে দোষারোপ করার সেই সুযোগটা নেই। থাকাও উচিত না। সকলেরই মনটা এখন বড় করা উচিত। পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং মনীষী জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী থাকার পরও স্বীয় প্রতিভাগুণে বিশ্ববরেণ্য হতে পেরেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, অটিস্টিক শিশুরা যেন অবহেলায় হারিয়ে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তারাও মানুষ। তারাও আমাদের সমাজের অংশ, তাদের জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। একটা দেশকে উন্নত করতে হলে সকলকে নিয়ে করতে হবে, কাউকে অবহেলা করে না। শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কারণে দেশে অটিজম সচেতনতা বেড়েছে। আমাদের দেশে আগে অটিজম নিয়ে কোন সচেতনতাই ছিল না। কোন সন্তান অটিস্টিক থাকলে বাবা-মা সেটা লুকাতেন। সমাজের কাছে বলতে পারতেন না। মাত্র কিছুদিন থেকে এ সচেতনতার ব্যাপারটা সামনে চলে এসেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারায় আনতে সরকার ‘কাজ করে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা তাদের জন্য ‘সুন্দর পরিবেশ’ সৃষ্টির প্রতিশ্রতি দেন। অটিজম আক্রান্তদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষায় নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন ও সেখানে তিন হাজার একশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার কথাও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে বিভিন্ন সেবা দেয়া হচ্ছে বলে জানান। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারায় আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাডেমি ফর অটিজম এ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার স্থাপনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। এখানে অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী মানুষদের এক সঙ্গে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের আমলে প্রতিবন্ধীদের জন্য নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা সেনানিবাসে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘প্রয়াস’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় এর শাখা করার কাজ চলছে। পাশাপাশি প্রতিটি সেনানিবাসে শাখা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই দেয়া হয়েছে, এছাড়া পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ৩০ মিনিট দেয়া হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বাংলা একাডেমি ব্রেইল প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছে। অটিজমে আক্রান্তদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক, কাউন্সেলিং ও অন্যান্য সেবা এবং সহায়ক উপকরণ দেয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এই সকল কেন্দ্রে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে যা থেকে প্রায় ২৪ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সেবা গ্রহণ করেছেন। ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ ১৫টি সরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র করে অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অটিজম আক্রান্তদের শনাক্ত করে তাদের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার এ্যান্ড অটিজম’-এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিফতর ও আইসিডিডিআরবি’র মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া অটিজম ও স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞ গ্রুপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উপযোগী করে স্ক্রিনিং টুলস প্রণয়ন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ‘বিশেষ সফটওয়্যার’ তৈরি করে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়ার উপরও গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী। অটিজমের বিরুদ্ধে নিজের মেয়ের জোরালো ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিসিয়েটিভ ইন বাংলাদেশ-এর জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের প্রচেষ্টায় দেশ ও বিদেশে অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার উদ্যোগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারের জন্য আর্থ-সামাজিক সহায়তা শীর্ষক প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। আমেরিকায় যখন সে কাজ করত, তখন আমি তার কর্মক্ষেত্রে গিয়েছি। কীভাবে তারা কাজ করে তা দেখতে গিয়েছি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবন্ধীদের জন্য তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছি, নিউরো প্রতিবন্ধী ডেভেলপমেন্ট সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ পাস করেছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীরা বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। বিশেষ অলিম্পিকে অসংখ্য স্বর্ণপদকসহ দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহিৃত করে পরিবারের স্নেহ, ভালবাসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তোলা হলে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা না হয়ে অপার সম্ভাবনা বয়ে আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় ॥ ডেপুটি স্পীকার ॥ সংসদ রিপোর্টার জানান, ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছেন, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং সঠিক সেবা-যতœ পেলে তারাও সমাজের জন্য অনেক কিছু করতে পারে। শনিবার বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্রান্তে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে নিউট্রিশন এ্যান্ড অটিজম রিসার্চ সেন্টার সোসাইটি (নার্ক) আয়োজিত ‘লাইট ইট আপ ব্লু ক্যাম্পেইন’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিতির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। ডেপুটি স্পীকার বলেন, অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল যে জনহিতৈষী কাজ করে যাচ্ছেন তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রতিবন্ধী উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবন্ধীদের ভাতা প্রদানকে বতর্মান সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করলে দেশ গঠনে প্রতিবন্ধী সন্তানরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তিনি সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকল বিত্তবান মানুষকে প্রতিবন্ধী কল্যাণে সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ানোর অনুরোধ জানান। বলেন, প্রতিবন্ধীরা স্পেশাল অলিম্পিক থেকে স্বর্ণ জয় করে এনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তাই আমাদের সকলের উচিত হবে প্রতিবন্ধী সন্তানদের অবহেলা না করে তাদের প্রতি ভালবাসা ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা। প্রতিবন্ধীরা কোন মতেই সমাজের অভিশাপ নয়, তারা আশীর্বাদ। অনুষ্ঠান শেষে তিনি মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বিশ্ব অটিজম দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত র‌্যালিতে অংশ নেন।
×