ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

উনিশ শতকে নারী জাগরণ-২

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১ এপ্রিল ২০১৬

উনিশ শতকে নারী জাগরণ-২

(পূর্ব প্রকাশের পর) সাথে সাথে আরো প্রকজনের নাম এসে যায়, যার দীপ্ত আভায় ঠাকুর বাড়ি তথা কলকাতা শহর নতুন কিরণে অভিষিক্ত হয়। তিনি ঠাকুর বাড়ির মেজ বৌ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। স্বামী প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন বাংলার নারী স্বাধীনতারও একজন জাগ্রত সৈনিক। বিলেতে গিয়ে নতুন সভ্যতার নারীর ঘরে বাইরে কর্মদ্যোতনায় তিনি মুগ্ধ, বিস্মিত। শুধু তাই নয়, সেই বিস্ময় আর আনন্দের স্রোতে নিমন্ত্রিত করে তাঁর স্ত্রীটিকেও। প্রথা অনুযায়ী ঠাকুর বাড়ির কড়া শাসন, দুর্ভেদ্য বিধি নিষেধ, কঠোর শৃঙ্খল সব কিছু ভেঙে দেন স্বামীর অনুপ্রেরণায় বাড়ির মেজ বৌ। এ নতুন আলোয় পা রাখাটা অত সহজ ছিল না। দেবেন্দ্রনাথের অভেদ্য নিয়মকে উপেক্ষা করে প্রথমেতি তিনি স্ত্রীকে ঘরের বার করতে পারেননি। কিন্তু এক সময় সে স্বপ্ন যখন সফল হল জ্ঞানদ নন্দিনী দেবী ঠাকুরবাড়ির সীমাবদ্ধ অন্দরমহল থেকে বৃহত্তর বহিরাঙ্গণে পা দিলেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি ঠাকুর বাড়ির এই মেজ বৌটি। শুধু বম্বে মাওয়া নয়, গবর্ণমেন্ট হাউসে মাওয়া প্রথম বাঙালি রমণীও তিনি। এরপর সুদূর বিলেও পর্যন্ত যান একাকী দুটি শিশু সন্তানসহ। সাত সমুদ্র তের নদী পার হতে তখন ভারতীয় পুরুষরাই ভয়ে, শঙ্কায় শিউরে উঠতেন। সেখানে একজন নারী তাও আবার পুরুষ সঙ্গী ছাড়া। নতুন সূর্যের আলোকোজ্জ্বলের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল থেকে সারা বাংলা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিভাবান স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী। গৃহস্থে, কর্মে প্রবাসে, আদর্শে স্বামীর সহযোগি হতে পারা সত্যিই এক অকল্পনীয় ব্যাপার। রক্ষণশীলতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে গতানুগতিক সংস্কারকে পশ্চাতে ফেলে নতুন যাত্রা পথে নিঃসঙ্কোচে, নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে যাওয়া এক মহীয়সী নারী আজো বাংলার নারী স্বাধীনতার দীপ্ত জ্যোতিষ্ক। এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুনের আহ্বানে শরিক হওয়াই শুধু নয়, পরিপূর্ণতা লাভক রা আসলে কঠিন। জ্ঞানদানন্দিনীর এই আধুনিক চেতনা, নবসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমেই অনুপ্রাণিত হলেন প্রায়ই সমবসয়সী দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেকটা রক্ষণশীল ঠাকুর বাড়ির এই মানুষটি মেজবৌঠানের নতুন আহ্বানে সিক্ত হলেন, অনুগামী হলেন। পীরালি ব্রাহ্মণ বলে সমাজে স্বীকৃত ঠাকুরবাড়ির ছেলে মেয়েদের উচ্চ সম্ভ্রান্ত বংশে বিয়ে হতো না। অন্যদিকেে দবেন্দ্রনাথের মেয়ের বিয়ের পর কেউই শ্বশুর বাড়ি অবধি যাননি। স্বর্ণকুমারী ঠাকুরবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে ও কলকাতাতেই আলাদা বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও কলকাতাকেই আলাদা বাড়ি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। ছেলেরা ও বিয়ে করে অতিসাধারণ ঘরের সহজ সরল বালিকাদের। বধু হওয়ার পর শিক্ষা-দীক্ষায়, রুচিতে আচরণে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তোলা হতো। এসব মেয়েদের পারিবারিক নামটা ও মুছে যেতো। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও ছিলেন সাধারণ ঘরের সামান্য এক বালিকা। বিয়ের পর তাঁকে ঠাকুর বাড়ির যোগ্য বৌ হিসেবে তৈরি করা হয়। মেজ বৌঠানের অনুরাগী ভক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বিয়ে করেন ঠাকুরবাড়ির আশ্রিত জাগজোহনের পৌত্রীকে। বালিকা মাতঙ্গিনী ঠাকুরবাড়িতে এসে হয়ে যান কাদম্বরী। শুধু নামেই নয় সর্বক্ষেত্রে তিনি ঠাকুরবাড়ির কাক্সিক্ষত বউ হয়ে ওঠেন। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে তথা সমাজে বিশিষ্টতা দান করে। ঠাকুর বাড়ির পরশমণি, প্রাপ পুরুষ রবীন্দ্রনাথকেতিি ন যে রকম অনুপ্রাণিত করেন তেমনটি আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। বিশ্বনন্দিত রবীন্দ্রনাথকে জীবনব্যাপী প্রভাবিত করা, কাদম্বরীর স্মৃতি মন্থনে রবীন্দ্র সাহিত্যের কলেবরে সমৃদ্ধ হওয়া সর্বোপরি নতুন বৌঠানকে জীবন ও সাহিত্যে চিরস্থায়ী করা সত্যিই এক অভাবনীয়, বিস্ময়কর ঘটনা প্রবাহ। ঠাকুরবাড়ির অবরোধ প্রথা জ্ঞানদানন্দিনী আগেই তুলে দেন। তাই স্ত্রীকে ঘরের বার। করতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বেশী বেগ পেতে হয়নি। তিনি স্ত্রীকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন। কাদম্বরীকে নিয়ে তিনি ঘোড়ায় চড়ে কলকাতার গড়ের মাঠ ঘুরে আসতেন। কলকাতা শহরের সবার সামনে এক অশ্বারোহিনী শ্রদ্ধা মিশ্রিত বিস্ময়ের উদ্রেগ করতো বৈ-কি। কারণ অন্ত:পুরবাসিনী ঠাকুর বাড়ির এক বধূ ঘোড়ায় চড়ে নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় স্বামীর সাথে গড়ের মাঠ ঘুরে আসতেনÑনারী জাগরেণের আর এক দিশারী তো বটেই। ঠাকুর বাড়ির সামান্য এক সেরেস্তার সাধারণ কন্যা ভবতারিণী মাত্র ১০ বচর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের সাথে বাধা পড়েন। ঠাকুর বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী ভবতারিণী হয়ে যান মৃণালিনী দেবী। কদরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রবধূটিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। স্কুরে পাঠানো থেকে শুরু করে গৃহশিক্ষক রাখা কোনো কিছুর ব্যাপারে শ্বশুর মহাশয় এ বধূটির জন্য কার্পণ্য করেননি। অতি আধুনিক হতে না পারলেও কবিপতœী মোটামুটি ঠাকুর বাড়ির যোগ্য বউ হয়ে ওঠেন। গৃহ-পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত মৃণালিনী দেবী সুললিত ভাষায় চিঠি পত্রও লিকতে পারতেন। সুখে, দুঃখে, কর্মে, সাহিত্যে কবিপতœী অসম্পষ্ট ছায়ার মতো কবিকে সান্নিধ্য দিয়ে যান আজীবন। ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বেথুন স্কুল নারী শিক্ষাকে অবারিত করলেও সবার জন্য সে-পথ সহজ সরল হয়নি। শুধু শিক্ষা নয়, সমাজের সব ধরনের অব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে নারীকে আরো অনেক কালক্ষেপণ করতে হয়। নব উদ্ভাবনকে স্বাগত জানাতে মান সভ্যতাকেও দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুর্বল অংশ হিসাবে নারীর ক্ষেত্রে এ সময় হয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। বিদ্যাসাগর ও নিউ উদ্যোগে ভদ্রঘরের মেয়েদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারী শিক্ষাকে সার্বজনীন করার প্রয়াসে লিপ্ত হন। এর পরেও স্কুলে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা ছিল হতে গোনার মতো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরই স্ত্রী শিক্ষার আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ব প্রথম মেয়েদের পরীক্ষা দেবার অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৮৮৩ সালের শুরুতে চন্দ্রমুখী এবং বাদম্বিনী উভয়েই বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং বিংশশতকের প্রথমার্ধে প্রায়ই অর্ধশত মহিলা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। নারী শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়ার ফলে সামাজিক অঙ্গনে মেয়েদের ভূমিকা ত্বরানিবত হয়। মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে এ শিক্ষার প্রয়োগ ততটা হয়নি। কারণ মুসলমান সমাজই এ শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে অনেক বেশী দেরি করে। মুসলমান সমাজের তুলনায় অনেক অগ্রগামী হিন্দু সমাজ উনবিংশ শতাব্দীতেই ইউরোপীয় সভ্যতাকে ধারণ লালন থাকে। সেটা শিক্ষা কিংবা শিল্পসংস্কৃতি অথবা রাজনৈতিক সচেতনতা সব দিক থেকেই বলা যায়। মুসরিম নারীদের মধ্যে সর্ব প্রথম নবাব ফয়জুন্নেসা ও বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী শিক্ষা ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হলেন। বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষা নয় নারীকে তার যাবতীয় অধিকার অর্জন করার ব্যাপারে বাস্তব কর্মসূচি এবংত ার সচেতন ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাাখেন। বেগম রোকের একটি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করছি ‘সহস্রজনের বাধা ঠেলিয়া অগ্রসর হওয়া একজনের কার্য্য নহে। তাই একটু আশার আলোক দীপ্তি পাইতে না পাইতে চির নিরাশার অন্ধকারে বিলীন হয়। স্ত্রী-শিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটা কুসংস্কার আছে যে, তাঁহারা ‘স্ত্রী শিক্ষা’ শব্দ শুনিলেই ‘শিক্ষার কুফলের’ একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া ওঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রী লোকের মত দোষ সমাজ অম্লান-বদনে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষা প্রাপ্ত মহিরা দোষ না করিলেও সমাজ কোনো কল্পিত দোষশতগুণ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ ‘শিক্ষার’ ঘাড়ে চাপাইয়া দের এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে ‘স্ত্রী শিক্ষাকে নমস্কার’ তারপরেও বিংশ শতাব্দী পুরো পর্ব জুড়ে নারী শিক্ষা, অধিকার সচেতনতা, রাজনৈতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণ, ভোট প্রদানের নিশ্চয়তায় নারীরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুরো সমাজ যদি বিপর্যস্ত হয় সেখানে দুর্বল পুরুষ এবং নারী কেউই যথার্থ অর্থে তার অধিকার আর স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারে না। সমাজে টিকে থাকতে হবে নারী-পুরুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে। একজন নারী তার মঙ্গল আর মাধুরী নিয়ে সত্যিকারের মানুষের মতো তার সমস্ত অধিকার পেতে চায়। (শেষ)
×