ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফাতিন আরেফিন

সিদ্ধ ধানের ওম ও শিকড়ের গল্প!

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১ এপ্রিল ২০১৬

সিদ্ধ ধানের ওম ও শিকড়ের গল্প!

মানুষ- ইতিহাস কবিতার আর জীবনের গায়ে জড়ানো- ধু-ধু শুধুই দূরের হাসি ভালোবাসিÑ পালায়ে যাওয়া ধুলা শুলা দিয়ে তৈয়ারি মেলার পুতুল... পাঠ করছিলাম তরুণ কবি সুপ্রিয় পলিয়ার ওয়াহিদের নতুন কবিতার বইÑ ‘সিদ্ধ ধানের ওম’। কবিতার পাঠ কেমন হওয়া উচিত কিংবা এর (পাঠ) পরবর্তী পর্যালোচনা, এসব পাশ কাটিয়েই কিছু সহজ আলোচনা শুরু করছি। অধিকন্তু এটা কোন সাহিত্য সমালোচনাও নয়, নিছক আমার ভালোলাগা কিছু অনুষঙ্গালোচনা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ‘হলুদ সবুরন্নেছার বাদামি চুলের বয়ান’ অথবা ‘রাঙা মরিয়মের শাদা চুলের বয়ান’ কবিতা দিয়ে। সাবলীল কথ্য ভাষায় লিখিত এই দুটি আখ্যান লিপিতে উঠে এসেছে আমাদের নিকটতম এবং সম্ভবত সর্বশেষ চিরায়ত গ্রাম বাংলার প্রেম-বিরহ- প্রাত্যহিক জীবনযাপনের গল্প, দুই বয়স্কা নারীর জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আবেগময় স্মৃতিচারণ। গল্পের টোনে পাঠক হয়তো খুঁজে ফিরতে পারেন অনেক অগ্রজকে। বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত কাব্যগ্রন্থটির এই অংশে সরস স্নিগ্ধ নিকটতম অতীতের শুদ্ধতম ঘ্রাণের মাঝেই কবি সমন্বয় ঘটিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের ঘ্রাণ। স্বাদ একই, কেবল ঘ্রাণে পার্থক্য। দুই প্রজন্মের গল্পের মেলবন্ধন। কাব্যগ্রন্থটির এই নিরীক্ষাকে আমি একটি সফলতা বলব। বিষয় আঙ্গিকে সাজানোটা যেমন সুন্দর লেগেছে, তেমনি এর কনটেন্টগুলোও। জার্নিটা অনেকটা এ রকম, শিকড় পেড়িয়ে মগডালে এসে খুঁজে পাওয়া সতেজ কিশলয়ের মতো। যেখানে ফুটে আছে কবিতা এক ‘উত্তর প্রদেশীয় বেলি’। এখানেও খুঁজে পাওয়া যাবে কবির চতুর্মুখী গভীর পর্যবেক্ষণ। কাব্যগ্রন্থটির প্রায় প্রতিটি কবিতাকেই দীর্ঘ কবিতা বলা চলে। একেকটা কবিতা একেকটা গল্প থেকে শুরু করে অনেকগুলো গল্পের আঁচড়ে ভরপুর। সেক্ষেত্রে কবিতাগুলো স্বভাবতই গল্পাশ্রিত, তবে তা কখনোই গল্পে ভারাক্রান্ত মনে হয়নি। ‘জীবন এক অলিখিত সুরের সঙ্গীত’Ñ এই অংশে দেখা যায় কবির অস্তিত্বের দহন, ভার বহনের আপ্রাণ চেষ্টা। ‘সিন্দুক হারানো চাবি’ কবিতায় দেখি কবির পরিবর্তিত জীবনের দ্বন্দ্ব, বোহেমিয়ান যাপন এবং সাহসী কবিসত্তাকে। কবিতার মেটাফোরে কবি তীক্ষè ভাষায় প্রকাশ করেছেন তার প্রতিবাদ, দ্বন্দ্বময় যাপন ও পরিবর্তনকে। আলোচনার সর্বশেষ কিন্তু কাব্যগ্রন্থের প্রথম অংশ ‘কাছের মানুষে লেপ্টানো সিঁদুরে মখমল’। কবি শুরু“করেছিলেন তার নিজের শিকড় থেকে। এরপর ছড়িয়ে গেছেন কা- মাড়িয়ে গাছের পাতায় পাতায়। সংখ্যার দিক থেকে পাঁচটি অংশে ভাগ করা মাত্র এগারোটি কবিতা। আগেই যেহেতু বলেছি প্রতিটা কবিতাই বেশ দীর্ঘ। অতীতের অনেক প্রতিথযশা কবিদের সূত্র ধরে পলিয়ার ওয়াহিদের এই নিরীক্ষাটাও দারুণ লেগেছে, যেহেতু এই সময়ে এক নাগরে দীর্ঘ কবিতা খুব একটা দেখা যায় না। তবে একটি কথা না বললেই নয়Ñ আবৃত্তিযোগ্য এই কবিতাগুলো যে কোন পাঠকের হৃদয়ে আঁচড় কাটতে বাধ্য। কাব্যগ্রন্থের শুরুতে এসে শেষ করলাম অনেকটা নিজের অজান্তেই। এমন সম্ভবত এ কারণেই করার সুযোগ ঘটেছে, কবি নিজেই অত্যন্ত যতœসহকারে পরিকল্পিতভাবে বইয়ের অধ্যায় এবং কবিতাগুলোর চমৎকার বিন্যাস করেছেন। তাই ওপর-নিচ, শেষ কিংবা শুরু, একই স্রোতে একই অনুভূতির তীব্রতা কিংবা গভীরতা নিয়ে যে কোন স্থান থেকে পাঠ সম্ভব। আলাদাভাবে এটা এজন্য বলা প্রয়োজন মনে করেছি, সহজাতভাবে প্রতিটা কবিতাই আলাদা আলাদা ভ্রমণ, আবার একই সঙ্গে এগারোটি কবিতা মিলে বিশেষ একটি কবিতা, বিশেষ একটি ভ্রমণ। আর এই বিশেষ কবিতাটির নামÑ সিদ্ধ ধানের ওম, আর এই বিশেষ ভ্রমণের নামÑ পলিয়ার ওয়াহিদ, একজন কবিসত্তাকে ভ্রমণ।
×