ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

সুদ হ্রাসে পর্যুদস্ত বৃদ্ধদের বয়স্কভাতা দেয়া হোক

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১ এপ্রিল ২০১৬

সুদ হ্রাসে পর্যুদস্ত বৃদ্ধদের বয়স্কভাতা দেয়া হোক

মানুষের বয়সের দিক থেকে আমাদের জন্য দুটো ভালো খবর আছে- খুবই ভালো খবর। প্রথম খবরটি হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল বাড়ছে। দ্বিতীয় খবরটি হচ্ছে প্রায় ১৬ কোটি লোকের মধ্যে যুবা বয়সের লোকের সংখ্যাই বেশি। আজকের বিষয় দ্বিতীয়টি নয়। আমরা প্রথম খবরটি দিয়েই শুরু করব। এই যে গড় আয়ুষ্কাল বা গড় আয়ু বাড়ছে তা কী অবিমিশ্র আশীর্বাদ? অন্যান্য উন্নত দেশে যেখানে বয়স্ক লোকের আধিক্য তাদের অবস্থা কী? অথবা ভিন্নভাবে বলতে হয়, এই যে গড় আয়ু বাড়ছে তা তো এমনি এমনি হচ্ছে না। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, খাদ্যদ্রব্য দূষণ থেকে শুরু করে নানা স্বাস্থ্য প্রতিকূল পরিবেশেও গড় আয়ু বাড়ছে। অর্থাৎ বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়ছে। বলতেই হয়, চিকিৎসাসেবা, পুষ্টি, খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি উন্নতি অন্যত্র। গ্রামাঞ্চলে আগে দলে দলে লোক মারা যেত যক্ষ্মা, কলেরা, ওলাওঠা, বসন্ত, ডায়রিয়া ও ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগে। বলাবাহুল্য, এসব রোগের উৎপাত এখন নেই। এ কারণে বহু লোক বেঁচে যাচ্ছে। চিকিৎসাসেবা ও খাদ্যগ্রহণ ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান উন্নতি আছে। কারণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে না গিয়ে আমরা প্রশ্ন রাখছি অন্যত্র। গড় আয়ু বৃদ্ধি কী অবিমিশ্র আশীর্বাদ? নিশ্চয়ই নয়। গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের কাঠামো বদলে যাচ্ছে, সমাজের নতুন নতুন চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে, সরকারের দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে, বহু মানুষের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অসহায়ত্ব বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের একাকীত্ব বেড়ে যাচ্ছে। সমাজের উল্টো দিকে এক অন্য জগতের সৃষ্টি হচ্ছে যেখানে একাকীত্ব ভর করছে অগণিত মানুষকে। একটা উদাহরণ দিই। একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ঘটনা। আমি বসে আছি কখন ডাক পড়বে বলে। হুইল চেয়ারে পাশেই এসে হাজির এক ভদ্রলোক যার বয়স হবে ৭০-এর কাছাকাছি। ভদ্রলোক বড়ই কাহিল। সঙ্গে তার বৃদ্ধা স্ত্রী। যে ছেলেটি সঙ্গে এসেছে তার হাবভাবে মনে হচ্ছে না ছেলেটি তার সন্তান। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওই ছেলেটি ভদ্রলোকের প্রতিবেশী। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সে দরকারি সময়ে ভদ্রলোকের সেবা দেয়। ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে থেকেও নেই। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ও ব্যস্ত ওর সংসার নিয়ে, ছেলেমেয়ের স্কুল, ঘর-সংসার নিয়ে। পুত্র সন্তান একটি। সে বিয়ে করে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আলাদা থাকে। অতএব বলা চলে ভদ্রলোকের সব থেকেও কেউ নেই। তার আয়ের উৎস একটা ছোট দোতলা বাড়ি। একতলা ভাড়া দিয়ে পান হাজার পনেরো টাকা। আর আছে কিছু সঞ্চয় যার সুদই তার একমাত্র আয়ের উৎস। ছেলেমেয়েরা কোন সাহায্য করে না। দৈনন্দিন কাজ যথা : বাজার করা, মেডিকেল টেস্ট করা, ওষুধ কেনা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদিতে তারা কাজে লাগে না। বলা যায় অবসরপ্রাপ্ত এই ছোট ব্যবসায়ী এখন এক অসহায় প্রাণীতে পরিণত হয়েছেন যাকে নিয়ে তার বৃদ্ধা স্ত্রী প্রয়োজনীয় কাজ সারেন। এই যে বর্ণনা দিলাম মনে কী হয় এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। সমাজ ভেঙ্গে তছনছ হচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে ‘নিউক্লিয়ার’ পরিবার হচ্ছে। চাকরিজীবী, শ্রমজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য পায়ের উপর আছে। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন এখন আগের মতো বিবেচ্য নয়। ফলে সমাজে অসহায় লোকের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ এই ধরনের লোকের দেখাশোনার কোন ব্যবস্থা রাষ্ট্রও করেনি, বেসরকারী খাতও করেনি। মাঝে মাঝে শোনা যায়, দু’একটা বৃদ্ধাশ্রমের কথা। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধ লোকদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। সঠিক তথ্য জানি না। তবে ধারণা করা যায় প্রতিবছর শুধু সরকারী খাতেই ২০-৩০ হাজার লোক অবসরে যায়। বেসরকারী খাতের তথ্য যোগাড় করা আরও কঠিন। তবু বলা যায় সরকারী অবসরপ্রাপ্ত লোকজনের তুলনায় বেসরকারী খাতে অবসরপ্রাপ্ত লোকজনের সংখ্যা হবে কয়েকগুণ। বলাবাহুল্য, এ ধরনের লোকদের কিছু একটা আয়ের উৎস আছে। কিন্তু বয়স্ক লোকদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক লোকের কোন আয়ের উৎস নেই। তারা সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল। গ্রামের অবস্থা শহরের চেয়ে খারাপ। গ্রামে ছেলেমেয়েরা প্রথম সুযোগেই বুড়ো বাপ-মাকে পরিত্যাগ করে। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গ্রামীণ বৃদ্ধরা খুবই বেশি অসহায়। তাদের দেখার কেউ নেই। গ্রাম ও শহরে বহু ঘর-বাড়ি আছে যেখানে একজন বৃদ্ধকে একটা ওষুধ খাইয়ে দেয়ার কোন লোকও নেই। টয়লেটে নিয়ে যাওয়া, ভাত খাইয়ে দেয়া, হাঁটা-চলায় একটু সাহায্য করা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, মেডিকেল টেস্ট করানো, ওষুধ ক্রয় করা, কাঁচাবাজার করে দেয়া থেকে শুরু করে ডজন ডজন কাজ আছে যাতে সাহায্য করার মতো লোকও অনেক সময় অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পায় না। এমনটা কিন্তু বাস্তব সত্য। ‘বিছানায় পড়া’ কোন বৃদ্ধ বাড়িতে থাকলে তো সর্বনাশ। এসব নিত্যদিনের দেখা চিত্র। অবসরপ্রাপ্ত অথবা বেসরকারী খাতের কর্ম থেকে ছুটি নেয়া এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা কী? রাষ্ট্রের তো কোন ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্র আয়-দায় নেই এমন বৃদ্ধদের জন্য একটা উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে দেখলাম এমন লোকের সংখ্যা ৩০ লাখ। অর্থাৎ একদম অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সরকারের কাছ থেকে একটা মাসিক ভাতা পান। সম্ভবত এর নাম বয়স্ক ভাতা। এর জন্য নীতিমালা আছে। আমি এদের কথা বলছি না। আমি বলছি এমন একটা শ্রেণীর লোকের কথা যারা অসহায়, যাদের কিছু আয় আছে, কিন্তু সে আয় তাদের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট নয়। তারা দরিদ্র হিসেবে সমাজে পরিচিত নয়। দরিদ্র হিসেবে কারও কাছে হাত পাততেও তারা রাজি নন। অথচ তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ভাত খেলে ওষুধের ব্যবস্থা করা যায় না। ওষুধের টাকা আছে তো ‘টেস্টের’ টাকা নেই। ‘টেস্টের’ টাকা আছে তো হাসপাতালে ভর্তির টাকা নেই। এর রকম লোক দেশে এখন হাজার হাজারÑ বলব লাখ লাখ। এই শ্রেণীর লোক দেখা যাবে হয়ত পেনশন পায়, কিন্তু এই পেনশনে তার অর্ধেক মাসও চলে না। এই শ্রেণীর লোকদের হয়ত সঞ্চয়পত্র থেকে কিছু সুদ আয় হয়, কিন্তু সেই আয় তার এখন অর্ধেকে নেমেছে। এই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে অনেকে আছেন যাদের হয়ত মেয়াদী আমানত আছে কিছু টাকার। এর উপর বর্তমানে ব্যাংক কোন সুদই দেয় না বলা যায়। মূল্যস্ফীতির হার পাঁচ-ছয় শতাংশ, অথচ ব্যাংক এখন আমানতের উপর সুদ দেয় চার শতাংশ। তার অর্থ কী দাঁড়াল? পেনশনের টাকায় তার চলে না, সুদের টাকা তার হ্রাস। উল্লেখ্য, এই চিত্র হচ্ছে সরকারী কর্মচারী যারা দীর্ঘদিন চাকরি করে অবসরে গেছেন। বলাবাহুল্য, এর বাইরে রয়েছে লাখ লাখ লোক যাদের পেনশনের সুযোগ নেই। রয়েছে শুধু সঞ্চয়পত্র ও আমানতের ওপর সুদের আয়। যাদের পেনশনের সুযোগ আছে তাদের বর্তমান অবস্থা কী তা দেখা যাক। ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে একটি খবরের কাগজে প্রকাশিত তথ্য থেকে পাঠকদের জানাচ্ছি। তথ্যটি দিয়েছে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। খবরটির শিরোনাম হচ্ছে : ‘অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তাদের অর্ধেকের জীবন চলে ঋণ করে।’ খবরের ভেতরের খবরে দেখা যাচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী-কর্মকর্তাদের ৪৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশেরই ঋণ পরিশোধের কোন ক্ষমতা নেই। এসব লোকের সংসার চলে না। এদের মাসিক যে খরচ তার অর্ধেকও তাদের আয় নয়। এই যদি হয় সরকারী অবসরপ্রাপ্তদের অবস্থা তাহলে দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বয়স্ক লোকদের অবস্থা কী? বেসরকারী খাতের যে সমস্ত বয়স্ক লোক অবসর জীবনযাপন করছেন তাদের অবস্থা কী? এ অবস্থায় এই অগণিত অসহায় লোকদের বাঁচানোর ব্যবস্থা কী? সমাজের একদম নিচের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা আছেÑ টাকার অঙ্ক যাই হোক। সমাজের বিত্তবানরা ‘করে’ খাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা নানা ধরনের ভর্তুকি সুবিধা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন। মাঝখানে যে লাখ লাখ অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছে তাদের কী হবে? তাদের সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানো হয়েছে। আরও কমানো হবে বলে সরকারের ‘সারিন্দারা’ বলছেন, ব্যাংক আমানতের ওপর কোন সুদ দিচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির নিরিখে বরং নেতিবাচক সুদ। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাদের সঞ্চয়পত্রের আয় হ্রাস পাচ্ছে, যাদের আমানতের ওপর সুদ আয় হ্রাস পাচ্ছে তাদেরকে ‘বয়স্কভাতা’র আওতায় আনা হোক। এর জন্য একটা নীতিমালা করা যেতে পারে। এখনই সময়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। সঞ্চয়পত্র ও আমানতের ওপর সুদ যখন ‘বাজারভিত্তিক’ই হবে, তখন ‘বাজারি অর্থনীতির’ শিকার যারা তাদের বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের। এটা ‘বাজারি অর্থনীতির’ ‘কাফফারা’। এই অর্থনীতিতে যে এক শতাংশ ৯৯ শতাংশ সম্পদের মালিক হবে তাদেরকে ৯৯ শতাংশকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এটাই এখন দাবি হোক। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×