ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

পুনরাবৃত্তির নাটক রাজাবলি

প্রকাশিত: ০৭:১২, ৩১ মার্চ ২০১৬

পুনরাবৃত্তির নাটক রাজাবলি

হিংসামত্ত পৃথিবীতে অহিংসার বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটকে পশুবলি বন্ধ করতে চাইলে রাজা গোবিন্দমানিক্য রঘুপতির চক্রান্তের মুখোমুখি হয়। হত্যাচক্রান্তে প্রবৃত্ত রঘুপতি শেষ পর্যন্ত তার প্রাণাধিক প্রিয় জয়সিংহের আত্মহুতির কারণে হিংসার পথ ছেড়ে অহিংস পথে যাত্রা করে। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুসৃত পথ ধরে ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ‘বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটার’ শিল্পধারার জনক ড. মুকিদ চৌধুরী লিখলেন নাটক ‘রাজাবলি’। নাটক ‘বিসর্জন’, উপন্যাস ‘দেবদাস’, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রচলিত কথা আর রঘুপতিকে নিধনের মৌলিক ইন্টারপিটিশনের সংমিশ্রণে ড. মুকিদ চৌধুরীর নাটক ‘রাজাবলি’। শাহজাহান শোভনের নির্দেশনায় এবং নাট্যভূমি প্রযোজিত ১৯তম প্রযোজনা নাটক রাজাবলি উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হলো গত ১০ মার্চ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। হলে প্রদর্শিত নাটকে গোবিন্দমানিক্য, নক্ষত্ররায়, রঘুপতি প্রভৃতি চরিত্র ঐতিহাসিক কারণে এবং বিসর্জন নাটকের সুবাদে একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বর্তমান নাটকে উপস্থিত। নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরীর সৃজন সত্যবতী, দয়মন্তী এবং পুস্কর যাদের মধ্যে দিয়েই তার মূল দর্শন উপস্থাপিত। রঘুপতির সঙ্গে সত্যবতীর সম্পর্ক, দয়মন্তীর জন্ম পরিচয়ের সঙ্কট, দয়মন্তীর স্বাবলম্বী হওয়ার তেজদীপ্ত আচরণের কারণে প্রেমিক পুস্করকে অস্বীকার, পুস্করের জীবনের অনিশ্চয়তা, দোষে দুষ্ট রঘুপতিকে বিনাশের মধ্যে দিয়ে পুস্করের জীবনের এক রকমের অর্থ দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাটক ‘রাজাবলি’। বাহুবলি দিয়ে নাটক রচনা হয় না যদিও নাট্যকারের কল্পনালোকের ভাষা প্রকাশে বাহুবলি সহায়ক। সেরূপ জোড়াতালির সংমিশ্রণটাই নাটক না যদিও রচিত নাটক অসংখ্য চিন্তাশীল মানুষের কৃতকর্ম, ঘটনার জোড়াতালির সংমিশ্রণ। ড. মুকিদ চৌধুরী অপরের থেকে পুষ্টি লাভ করে মৌলিক নাটক সৃজন করবেন সময় নিয়ে, বিষয়ের গভীরে গিয়ে সেটাই তার পথ চলার আপাত অনুরণন। নির্দেশক শাহজাহান শোভন দীর্ঘদিন ধরেই প্রাণের গভীর ভালবাসা এবং নিরন্তন ক্ষত-বিক্ষত পথ চলার মধ্যে দিয়েই নাটকের চর্চাটা ধরে রেখেছেন। একটা সুনাম এবং মূল্যায়ন পাবার মতো প্রযোজনা ‘রাজাবলি’কে ঘিরে সার্বিক অর্থে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা শক্তিশালী এবং ত্যাগী। গোবিন্দমানিক্যরূপী অভিনেতা কামরুল ইসলাম তার প্রাণাধিক প্রিয় কন্যাকে চিরদিনের মতো হারিয়েও যে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মঞ্চে এসে না ভেঙ্গে পড়ে অভিনয়টা সাবলীলভাবে করে গেলেন, এ ত্যাগ তো ভোলার নয়। মোহসিনা শবনম তো রাজগাম্ভীর্য অক্ষুণœ রেখে পোশাক পরালেন। শিপলুর আবহ ফিল্মিক। পলাশ হেনরী সেনের সেটে নাটকের মূল উপজীব্য স্থান দেবালয়ের গা ছমছমে ভাব কিন্তু রোমাঞ্চকতা যেমন নাটকটাকে দেয়ালের মতো ঠেস দিয়ে সাপোর্ট করে তেমনি তারই পরিকল্পিত আলো সেটকে জীবন্ত করে তোলে সময় পরম্পরায়। চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেক কসরত করেছেন সত্য, কিন্তু সে অর্থে ফোকাস হবার মতো সুযোগ তারা কমই পেলেন। ড. মুকিদ চৌধুরী উদ্ভাবিত বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটার নিয়ে কথা থাকে। মাছের বাজারে সবাই একসঙ্গে কথা বলে বলেই কারও কথা পরিষ্কার শোনা যায় না। ফলে মূল দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অসংখ্য সমান্তরাল দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন ঠিক কি কারণে তা বোঝা গেল না। ইউরোপ-আমেরিকায় মায়ের প্রয়াণে সন্তানের শোক প্রকাশে সঙ্গত দিতে বিলাপকারীদের আনা হয়। আঙ্গিক-আত্মিক বেদনার সমন্বয়ে তারা মুভমেন্ট বিলাপ উপস্থাপনা করে। ইউরোপ-আমেরিকার বালির মতো অবস্থা এখনও বাংলার পলির না। ফলে অভিনয়ের খরারকালে অভিনয়টা ঠিকঠাক মতো করতে পারলেই যথেষ্ট। বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটার নাকি ডেড্লি থিয়েটার সেটি বড় কথা না, বড় কথা থিয়েটারটা শেষ পর্যন্ত রিয়েল থিয়েটার হলো কিনা! গবেষণার চক্করে পড়ে সাহিত্যের বিলুপ্তি দেখতে কারওরই ভাল লাগে না। সম্ভাবনাময় পথচলায় নাটক ‘রাজাবলি’।
×