ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দেশে বিদেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৩১ মার্চ ২০১৬

তিন দেশে বিদেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি

রহিম শেখ ॥ রিজার্ভ থেকে চুরির ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী নাগরিকদেরও প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঘটনা তদন্তে শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপিন্সে অবস্থানকালে সে সব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সিআইডি কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে ফিলিপিন্স যাওয়ার অনুমতিও পেয়েছেন তারা। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় ফিলিপিন্সে শনাক্ত হওয়া আট ব্যক্তি ও শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় ব্যক্তি কখনও বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিআইডি সূত্র জানায়, জড়িতরা হ্যাকিংয়ের আগে ঢাকায় এসেছিলেন বলে তারা ধারণা করছেন। এ কারণে গত দুই বছরে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর করা হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনার চেষ্টায় নামছে সরকার। এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে বিশেষায়িত একটি টাস্কফোর্স। এছাড়া ফিলিপিন্সে পাচার হওয়া রিজাভের্র ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিপরীতে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন ফিলিপিন্স সিনেটের প্রেসিডেন্ট প্রো-টেমপোর রালফ রেক্টো। তবে, চুরি যাওয়া অর্থের পুরোটাই পেতে আশাবাদী ফিলিপিন্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ। অর্থ উদ্ধারের সিনেটের পুরো প্রক্রিয়া নিয়েও সন্তুষ্ট তিনি। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত ডলারগুলো কাদের কাছে গেছে তা শনাক্ত হয়ে গেছে। এখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে পুরো নেটওয়ার্কটি চিহ্নিত করা যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে ৫০টি কম্পিউটারের ফরেনসিক পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজনদের নানাভাবে নজরদারি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফিলিপিন্সের সিনেটের শুনানিতে এখন পর্যন্ত আটজনের নাম এসেছে। তারা হলো মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভেরগারা, এনরিকো টিয়োডরো ভ্যাসকুয়েজ, উইলিয়াম সো গো, ক্যাম সিং ওং ওরফে কিম ওং, মায়া সান্তোস দেগুইতো ও রোমালদো আগ্রাদো। এদের কেউ গত দুই বছরে বাংলাদেশে এসেছিল কিনা ইমিগ্রেশন বিভাগ তা খতিয়ে দেখছে। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের শালিকা পেরেরা, মিয়ুরিন রানাসিংহে, প্রদীপ রোহিথা, সান্থা নালাকা ওয়ালাকুলুয়ারাচ্চি, সঞ্জিভা তিসা বান্দারা ও শিরানী ধাম্মিকা ফার্নান্দোও কখনও বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা তাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সিআইডির উর্ধতন এক কর্মকর্তা জানান, টাকা চুরির বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। এ কারণে হ্যাকার চক্রের সদস্যরা নাম ও পাসপোর্ট পাল্টিয়েও বাংলাদেশে আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। এ জন্য অভিযুক্তদের ছবি দেখেও তাদের ঢাকায় আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে ঘটনা তদন্তে ফিলিপিন্স, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রেও যাচ্ছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা। সেখানে অবস্থানকালে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সিআইডি কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মির্জা আবদুল্লাহহেল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, রিজার্ভ থেকে চুরির ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য বিদেশীদেরও প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সেটা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে করা হবে। ল্যাপটপ জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির পর দেশে-বিদেশে তদন্তে নেমেছে বিভিন্ন সংস্থা। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তা তাদের ল্যাপটপ বুধবার আইটি অপারেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি ও শাখা অফিসের সব কর্মকর্তা তাদের ল্যাপটপ সংশ্লিষ্ট একাডেমি বা অফিসের আইটি সেলে জমা দিয়েছেন। এর আগে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট-১ এর মহাব্যবস্থাপক নূর-উন-নাহার স্বাক্ষরিত এক অফিস নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদন্তের স্বার্থে ব্যাংক সব কর্মকর্তার ল্যাপটপ সংগ্রহ করে সিকিউরিটি এজেন্ট ইনস্টল করে নেটওয়ার্ক চলমান করা প্রয়োজন। এ জন্য সব কর্মকর্তাকে ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রত্যেক কর্মকর্তার ল্যাপটপ ফেরত দেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে ১ হাজার ৫০০ ল্যাপটপ জমা নেয়া হচ্ছে। এক সঙ্গে সব ল্যাপটপ জমা নেয়ায় কাজে কিছুটা বিঘœ ঘটছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সাময়িক। আবার সব ল্যাপটপ ফেরত দেয়া হবে। ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার ফেরত পাওয়া সম্ভব ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের বিপরীতে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার উদ্ধার করে তা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন ফিলিপিন্স সিনেটের প্রেসিডেন্ট প্রো- টেমপোর রালফ রেক্টো। দেশটির গণমাধ্যমে বুধবার সকালে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এ কথা বলেন তিনি। তবে, বাকি অর্থ কোথায় আছে কিংবা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে কিছুই জানাননি তিনি। ফেডারেল রিজার্ভ থেকে পাচার হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে শঙ্কা কেবল দানাই বাঁধছে। ফিলিপিন্স পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের পরিমাণটুকু অর্ধেকের নিচে নামিয়ে এনেছেন দেশটির সিনেটের প্রেসিডেন্ট রালফ রেকট্রো। গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি জানান, ১৪ মিলিয়ন ফেরত দিতে পারেন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং। ৪.৬৩ মিলিয়ন ডলার রয়েছে সোলায়ার ক্যাসিনোতে আর প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার ইস্টার্ন হাওয়াই লেজার কোম্পানি লিমিটেডে। ৮১ মিলিয়নের মধ্যে সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেতে পারে মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার। তবে, চুরি যাওয়া অর্থের পুরোটাই পেতে আশাবাদী ফিলিপিন্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ। অর্থ উদ্ধারের সিনেটের পুরো প্রক্রিয়া নিয়েও সন্তুষ্ট তিনি। এদিকে, ফিলরেম কোম্পানির প্রেসিডেন্ট সালুদ বাউতিস্তা তার কোম্পানির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, রিজাল কমার্সিয়াল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ১৭ মিলিয়ন ডলার তার প্রতিষ্ঠানে আসে, যা ব্যবহার হয়েছে স্থানীয় বাজারে। অর্থ ফেরত আনতে গঠন হচ্ছে টাস্কফোর্স ॥ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনার চেষ্টায় নামছে সরকার। এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে বিশেষায়িত একটি টাস্কফোর্স। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে দু-একদিনের মধ্যেই এ টাস্কফোর্স গঠন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিশেষত ফিলিপিন্সের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধার সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার। বিশেষ করে ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং চ্যানেলে যদি বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ থেকে থাকে, তবে তা ফেরত পাওয়া যাবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশেষায়িত টাস্কফোর্সটি গঠন করা হচ্ছে। টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে থাকতে পারেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট আরও দুটি অফিসের প্রতিনিধিরা। সূত্র বলছে, বিশেষায়িত এ টাস্কফোর্সের প্রথম কাজই হবে চুরি যাওয়া অর্থ কী অবস্থায় আছে, তা নির্ণয়ের চেষ্টা করা। বিশ্বের কোন কোন দেশে এ অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে, তাও চিহ্নিত করবে টাস্কফোর্স। পাশাপাশি অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে তারা। ফিলিপাইনের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) রয়েছে। তাই চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপিন্সে থাকলে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করবে এ টাস্কফোর্স। রাকেশ আস্তানার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার মেয়াদ বাড়ল ॥ রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনায় রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে গঠিত ফরেনসিক তদন্ত দলের রিপোর্ট জমা দেয়ার মেয়াদ ৩০ দিন বাড়ানো হয়েছে। এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে এই কমিটির তদন্ত কাজ শেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরি হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাবেক উপ-প্রধান কর্মকর্তা রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে একটি ফরেনসিক তদন্ত দল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কমিটিকে ৩০ মার্চের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে ফরেনসিক তদন্ত দলের কাজ এখনও শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য তাদের আরও এক মাস সময় দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
×