ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বহু কাঙ্ক্ষিত স্থায়ী গ্যালারি শিল্পকলায়

কিংবদন্তির শিল্পীদের দুর্লভ শিল্পকর্ম, চারুকলার সমৃদ্ধ ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩০ মার্চ ২০১৬

কিংবদন্তির শিল্পীদের দুর্লভ শিল্পকর্ম, চারুকলার সমৃদ্ধ ইতিহাস

মোরসালিন মিজান ॥ হওয়া জরুরী। এখন হচ্ছে। তখন হচ্ছে। আদতে হচ্ছিল না। শুধু চারুকলার জন্য শিল্পকলায় আলাদা ভবন। বিশাল পরিসর। এর পরও বাংলাদেশের চিত্রকলা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে পারে, এমন কোন গ্যালারি এখানে হচ্ছিল না। এবং অতঃপর বন্ধ্যত্ব দূর হলো। মঙ্গলবার জাতীয় চিত্রশালায় উদ্বোধন করা হলো একটি স্থায়ী গ্যালারির। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব বিখ্যাত শিল্পীর ছবি দিয়ে এটি সাজানো হয়েছে। আছে অপেক্ষাকৃত নবীন এবং প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের কাজ। যখন তখন গ্যালারি ঘুরে দেখা যাবে। ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের চারুকলার ইতিহাস, শিল্পীদের কাজের বিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেবে নতুন গ্যালারি। স্থায়ী গ্যালারি বলতে নতুন কোন স্থাপনা নয়। চিত্রশালা প্লাজার ১ নম্বর গ্যালারিটিকে স্থায়ী গ্যালারির রূপ দেয়া হয়েছে। ভবনের নিচতলার সংগ্রহশালায় আছে বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম। দূরদর্শী চিন্তা থেকে এসব ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার পর থেকে তালাবদ্ধ কক্ষ। দুর্লভ ছবি, ভাস্কর্য ইত্যাদি দেখার কোন সুযোগ পাচ্ছিলেন না শিল্পপ্রেমীরা। অনেক ছবি পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় কিছু ছবি নিয়ে চালু করা হলো স্থায়ী গ্যালারি। কিংবদন্তি শিল্পীদের দারুণ সব কাজ এখানে। গ্যালারিতে প্রবেশ করতেই চোখ আটকে যায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবিতে। চিত্রকর্ম নয় শুধু, শিল্পকলা একাডেমির এগুলো অমূল্য সম্পদ। বর্তমান মহাপরিচালকের সময়ই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের যৌবনে আঁকার যে ক্ষমতা ছিল, চারটি ছবিতে তার প্রকাশ। গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে শিল্পী আনোয়ারুল হকের দুটি, মোঃ কিবরিয়ার তিনটি, আমিনুল ইসলামের দুটি, আব্দুর রাজ্জাকের তিনটি চিত্রকর্ম। আছে রশীদ চৌধুরীর দুটি, মুর্তজা বশীরের তিনটি, কাজী আব্দুল বাসেদের তিনটি ছবি। কিংবদন্তি শিল্পী এসএম সুলতানের অনেক ছবি শিল্পকলার সংগ্রহে। সেখান থেকে নেয়া হয়েছে চারটি। আছে শিল্পী দেলোয়ারের একটি, দেবদাস চক্রবর্তীর তিনটি ছবি। সদ্য প্রয়াত বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা ছবি আছে তিনটি। রাখা হয়েছে আবু তাহেরের দুটি, নিতুন কু-ুর একটি অনন্যসাধারণ শিল্পকর্ম। আছে শিল্পী সামসুল ইসলাম নিজামীর দুটি, হামিদুর রহমানের একটি, প্রাণেশ ম-লের একটি শিল্পকর্ম। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবি থেকে নেয়া হয়েছে ৩টি। সফিকুল হোসেন থেকে ১টি। গ্যালারিতে রফিকুন নবীর ছবি আছে দুটি। সমসংখ্যক ছবি সমরজিৎ রায় চৌধুরীর। বিখ্যাত শিল্পী হাশেম খানের দুটি ছবি রাখা হয়েছে গ্যালারিতে। জুনাবুল ইসলামের আছে দুটি, মোহাম্মদ মহসিনের একটি। মুস্তাফা মনোয়ারের অসাধারণ দুটি ছবি দেখেও মন ভরে যায়। এভাবে মোট শিল্পী ৯৫জন। শিল্পকর্ম সংখ্যা ১৩৮। সব মিলিয়ে স্থায়ী গ্যালারি। সীমাবদ্ধতা নিয়েই শুরু। অচিরেই তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও জানানো হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বিকেলে চারুকলা বিভাগের মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন দেশের বরেণ্য শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, হাশেম খান, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী প্রমুখ। একেবারে তরুণ শিল্পীরাও এসেছিলেন। আর প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। প্রথা মেনে যে আলোচনা, এদিন সামান্যই হয়েছে। কাজের কথা হয়েছে বেশি। শুরুটা করেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। জাতীয় সংগ্রহশালা শিল্পকলা একাডেমিতে রাখার বিপক্ষে অবস্থান নেন তিনি। বলেন, জাতীয় সংগ্রহশালা বা ন্যাশনাল গ্যালারি হবে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। সব দেশে তা-ই হচ্ছে। এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট সেই শিল্পীরা ঠিক করবেন, ন্যাশনাল গ্যালারি কীভাবে চলবে। শিল্পকলার সংগ্রহশালায় থাকা বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে, তাতেও তিনি সন্তুষ্ট নন বলে জানান। স্থায়ী গ্যালারির ছবি তিন মাস বা ছয় মাস পর পর পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেন তিনি। খ্যাতিমান শিল্পী হাশেম খান ন্যাশনাল গ্যালারি নিয়ে জাতির জনকের স্বপ্নের কথা জানান। পরামর্শ দিয়ে বলেন, সংগ্রহশালার জন্য অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পীদের ছবিও কেনা উচিত। শিল্পীর এমন প্রস্তাবকে কড়তালি দিয়ে স্বাগত জানান তরুণ শিল্পীরা। অবশ্য বক্তৃতার মোড় শতভাগ ঘুরিয়ে দেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর। অনেক বছর আগে তার হাতেই যাত্রা শুরু করেছিল শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগ। কিন্তু পরবর্তিতে অনেক কিছুই আর ঠিক ঠিক এগোয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ন্যাশনাল গ্যালারির জন্য আগারগাঁওয়ে আলাদা জায়গা ঠিক করা হয়েছিল। সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। চারুকলা বিভাগের আমলা পরিচালক মঞ্চে যখন, তাকে রীতিমতো ঘায়েল করেন শিল্পী। বলেন, আপনি তো চারুকলার কিছু জানেন না। দেশীয় চারুকলার ইতিহাসের কী জানবেন আপনি? বিশ্ব চারুকলার ইতিহাস তো আরও জানবেন না। কিছুদিন এখানে চাকরি করবেন। তার পর চলে যাবেন। ভুলে যাবেন সব। এভাবে চারুকলা তথা শিল্পকলা একাডেমি চলা উচিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, শিল্পীদের কাজ শিল্পীদের দিয়েই করাতে হবে। শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ীও এটি সঠিক নয় বলে জানান তিনি। আরও কিছু জরুরী কথা উচ্চারিত হয় মন্ত্রী ও একাডেমির মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে। দর্শক গ্যালারিতে বসা সুধীজনও বক্তব্যের বিপুল কদর করেন। অনেক বিষয় সামনে চলে এলেও সংস্কৃতিমন্ত্রী ভালই সামলে নেন। স্বীকার করে বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিশেষ। শিল্পকলা একাডেমিও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। এখানে শিল্পীদের কাজ শিল্পীদেরই করা উচিত। সে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আশ্বস্থ করেন তিনি। স্থায়ী গ্যালারির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেক বিদেশী অতিথি এসে বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু স্থায়ী কোন গ্যালারি না থাকায় আমরা আমাদের চর্চা সম্পর্কে ভাল ধারণা দিতে পারিনি। আজ শুরুটা করলাম। এই আনন্দটা প্রকাশ করতে পারি আজ। সভাপতির বক্তব্যে একাডেমির মহাপরিচালকও হাস্যরসের মাধ্যমে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। এখন দেখার বিষয়, কবে এসব সীমাবদ্ধতা দূর হয়।
×