ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে একদিন বয়সের বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ

টাঙ্গাইলে ধ্বংসের মুখে পোল্ট্রি শিল্প

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩০ মার্চ ২০১৬

টাঙ্গাইলে ধ্বংসের মুখে পোল্ট্রি শিল্প

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ২৯ মার্চ ॥ দেশের অন্যতম পোল্ট্রি শিল্প এলাকা টাঙ্গাইল। জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসের তথ্য মতে এই জেলায় রেজিস্ট্রিকৃত লেয়ার খামার সংখ্যা ১২৬৯ ও ব্রয়লার খামার সংখ্যা ১৬৭৮টি। অন্যদিকে জেলা পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা মালিক সমিতির তথ্য মতে এ জেলায় ছোট-বড় খামার আছে ৩০ হাজারের বেশি। তাদের মতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মাংস ও ডিমের চাহিদার যোগানদাতা এই জেলা। কিন্তু বর্তমান সময়ে বহুবিধ আগ্রাসনের কবলে পড়ে স্বউদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রান্তজনের এই শিল্প আবার ধ্বংসের পথে। বিগত দিনে খাদ্যে ও ডিমে সিন্ডিকেট হলেও এবার তারা বেছে নিয়েছেন অন্য পন্থা। পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম উপাদান হলো একদিন বয়সী বাচ্চা। তাদের মতে বাচ্চা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে একদিন বয়সের বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েকগুণ। এদিকে বাড়তি দাম দিয়েও বাচ্চা পাচ্ছেন না খামারিরা। চাহিদার তুলানায় বাচ্চা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ খামারিরা। কোম্পানিগুলো নিজেরাই মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য জারি রেখেছে কৃত্রিম সঙ্কট। যার ফলে স্বউদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রান্তজনের এই শিল্প আবার ধ্বংসের পথে। সরেজমিনে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পাওয়া গেছে একই চিত্র। সর্বত্রই একদিন বয়সী বাচ্চার জন্য হাহাকার। খামারীরা জানান, দু’মাস আগে একদিন বয়সের ব্রয়লার বাচ্চার দাম ধরা হতো ৪০ টাকা। এখন সেই বাচ্চার দাম ধরা হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। আগে লেয়ার বাচ্চার দাম ধরা হতো ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এখন সেই বাচ্চার দাম ধরা হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। খামারিরা আরও জানান, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত একদিন বয়সের বাচ্চাগুলো আইনভঙ্গ করে মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য নিজেদের খামারে ব্যবহার করছে। এতে করে বাজারে বাচ্চার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রান্তিক খামারিরা দাম বেশি দিয়েও চাহিদা মোতাবেক বাচ্চা পাচ্ছে না। তাদের আরও অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে বাচ্চার কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজেরা মাংস ও ডিম উৎপাদনে নিয়োজিত হচ্ছে। যার ফলে এক সময় তৃণমূলের খামারগুলো বাচ্চার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে তারা বাজারে ডিম ও মাংসের কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ইচ্ছামাফিক মুনাফা করতে পারবে। সরকারের দুর্বলতা আর আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দিনের পর দিন সরকারের চোখের সামনেই এই চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছেন বলেই তারা মনে করছেন। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোকারচর গ্রামের লেয়ার খামারি আসাদ বলেন, নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে একজন খামারিকে দিন পার করতে হয়। ভাইরাস জনিত রোগ-ব্যাধির জন্য খামারিকে ২৪ ঘণ্টাই সজাগ থাকতে হয়। এ যেন এক যুদ্ধ ক্ষেত্র। অধিকাংশ খামারি এই যুদ্ধে পরাজিত। তারপরও যে দু’একজন জয়ী হয় বা যখনই এই শিল্পের একটু সুদিন আসে তখনই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নতুন নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। তিনি আরও বলেন, এর জন্য অন্যতম দায়ী সিপি কোম্পানি। বহুবার এ সিপি কোম্পানির বিরুদ্ধে খামারিরা আন্দোলন করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার লেয়ার পোল্ট্রি মালিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর ফকির জানান, ভাইরাস জনিত রোগে অনেকগুলো খামারের মুরগি মারা গেছে। যে সমস্ত খামারগুলোর মুরগি মারা গেছে, তারা নতুন করে বাচ্চা উঠাবে। কিন্তু বাজারে কোন কোম্পানির বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চা না পাওয়ার কারণে ওই খামারিদের পথের ফকির হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সন্ধানপুর গ্রামের লেয়ার খামারি হেলাল বলেন, দুই মাস আগে বাচ্চার অগ্রীম টাকা দিয়ে এখনও অনেক খামারি চাহিদা মোতাবেক বাচ্চা পায়নি। কোম্পানিদের কাছে জানতে চাইলে বলে উৎপাদন কম। কিন্তু তা সত্য নয়। আমাদের কাছে খবর আছে সিপি কোম্পানি অন্যান্য কোম্পানির সাথে সিন্ডিকেট করে তাদের ইন্ট্রিগেশন প্রোগ্রাম আবার চালু করে মাংস ও ডিম উৎপাদন শুরু করেছে। পোল্ট্রি শিল্প রক্ষা জাতীয় পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন বলেন, আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি তুলেছি এই বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের হাত থেকে এই শিল্পকে রক্ষার জন্য। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সরকার আমাদের দাবি আমলে নেন না। আমরা খামারিরা দেশের মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। আমরা মনে করি, দেশের পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বহুজাতিক কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত। যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করেছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা বিনয় কুমার নাগ বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনও আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সরকারীভাবে একদিন বয়সের বাচ্চা উৎপাদনের কার্যক্রম চালু হয়েছে যা দেশের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যেসব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এসব কাজে জড়িত রয়েছে হাইকোর্টে একটি মামলা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আমরা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। সরকার পোল্ট্রি শিল্প রক্ষায় যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। অচিরেই এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি জানান।
×