ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাকাণ্ড ও বিধান সভার নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৯ মার্চ ২০১৬

মমতাকাণ্ড ও বিধান সভার নির্বাচন

তৃণমূল কংগ্রেসপ্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়টা এখন ভাল যাচ্ছে না। রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন সব নজিরবিহীন ঘটনা ঘটছে যা তাকে ও তার দলকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। প্রথমত, অভূতপূর্বভাবে এ রাজ্যে একমাস ধরে সাত দফায় ভোট হতে চলেছে যা আজ পর্যন্ত ভারতের কোন প্রদেশে বা প্রান্তে হয়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অন্য চারটি রাজ্যেও বিধানসভা ভোট হচ্ছে। সেখানে কিন্তু ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া একদিনে বা দু’দিনেই সম্পন্ন হবে। দ্বিতীয়ত, অঘটন হলো জাতীয় নির্বাচন কমিশন এ রাজ্যে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য অভূতপূর্ব সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন ভোটের একমাস আগে নির্বাচনবিধি জারি হওয়ার আগেই রাজ্যে ৫০০ কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, যারা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে। ভোটারদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেসের লুম্পেনরা যাতে তাদের ভোটদান থেকে বিরত না রাখতে পারে সেজন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যের গ্রামেগঞ্জেও পৌঁছে গেছে ও টহলদারি এবং নজরদারির কাজ পুরোমাত্রায় শুরু করেছে। গত অক্টোবর মাসে কলকাতা ও সল্ট লেক পুরসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তৃণমূলের গু-াবাহিনী বুথ দখল করে ভোট ডাকাতি করে ও ভোটারদের পিটিয়ে যেভাবে শাসক দলকে ভোটে জিততে সাহায্য করে তার পুনরাবৃত্তি বিধানসভা নির্বাচনে রোধ করতেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদি এই সব কড়া দাওয়াই দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর সঙ্গে এক জেলা শাসক, ছয় জেলার পুলিশ সুপার ও ৩২ জন পুলিশ প্রশাসনের নিচের তলার অফিসারকে তাদের স্ব স্ব পদ থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়েছে। এদের সবার বিরুদ্ধে শাসক দলের হয়ে কাজ করার এবং বিরোধী দলগুলোকে অযথা হয়রানি করে কোণঠাসা করার অভিযোগ ছিল। এদের সবাই ‘মমতা দিদির’ ব্যক্তিগত দলদাস বলে তাদের কুখ্যাতি আছে। এসব সিদ্ধান্তে মমতা দিদির খুব গোসা হয়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, এসব নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত আমাদের রাজ্যের ও বাঙালীর জন্য এক চরম অপমান। যা বাঙালী কোন মতেই সহ্য করবে না। বাঙালীর জাত্যাভিমানের ওপর এটি একটি বিরাট আঘাত। যার যোগ্য জবাব বাঙালী ভোটের মাধ্যমে দেবে। এর থেকে বোঝা যায় ‘দিদি’ একেবারে হিশেহারা ও আতঙ্ক জ্বরে ভুগছেন। কিন্তু তিনিও দমবার পাত্রী নন। তার ওই ছয় কাছের পুলিশ সুপারদের পদোন্নতি দিয়ে তিনি তাদের পুরনো জেলাতেই বহাল রেখেছেন, যাতে নির্বাচনী কাজে তারা তার দলের হয়ে কাজ করতে পারেন। দিদি রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনকে এমন পক্ষপাতদুষ্ট এবং তার দলের তাঁবেদারে পরিণত করেছেন যে, তার নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। পুলিশ সুপার ও এ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল পদের অফিসাররা হলেন তাঁর ‘তোলা বাবু’। যারা ভয় দেখিয়ে টাকা তোলেন এবং দিদির দলকে টাকার যোগান দেন। আর সে জন্য নির্বাচন কমিশন অন্য রাজ্য থেকে বরিষ্ঠ আইএএস অফিসারদের এ রাজ্যে এনে নির্বাচন তদারকির দায়িত্ব দিয়েছেন। নাসিম জাইদি বার বার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তিনি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে সব রকম ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর প্রভাব শাসক তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের চলনে বলনে কোনভাবেই পড়ছে না। যেমন মমতা দিদি বলে চলেছেন ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী তো ভোট হয়ে গেলে চলে যাবে। তারপর আমার পুলিশকে সব দেখতে হবে। এখন বিরোধী ও তার সমর্থকদের কী হবে?’ দিদির এক ডান হাত প্রকাশ্য সভায় বলছেন, ‘বিরভূমের প্রতিটি আসনে ৮০,০০০ ভোটের মার্জিনে জিততে হবে।’ দলীয় কর্মীদের এক সভায় দিদির ওই বিশ্বস্ত নেতা বলেছেন, ‘কী কৌশলে আমরা পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোট জিতেছি সেটা আপনাদের জানা। সেই একই কৌশল বিধানসভা নির্বাচনে প্রয়োগ করা হবে। সুতরাং কোন চিন্তার কারণ নেই। সিপিএমের এক প্রাক্তন হেভিওয়েট মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা যিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন দিদির মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে। এক জনসভায় তার প্রাক্তন দলের কমরেডদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘ভোটের পর তোদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। পুকুর, ডোবায় গিয়ে তোদের প্রাণ বাঁচাতে হবে। ভোটের পর আমাদের হাতেই ক্ষমতা আসবে। তখন কোন কমিশন তোদের বাঁচাবে?’ স্বভাবত বিরোধীরা প্রশ্ন করছে, নির্বাচন কমিশন আগের নির্বাচনের মতো এই সব প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারির বিরুদ্ধে মমতা ও তার সাগরেদদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তাহলে ভোটাররা কোন সাহসে নির্ভয়ে গিয়ে ভোট দেবেন? নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধীরা ভরসা রাখতে পারে কি? শুধু হুঁশিয়ারি দিয়েই ক্ষান্ত থাকছে না দিদির দল। রাজ্যে কমিশনের পাঠানো ভিনরাজ্যের পর্যবেক্ষকদের রাজ্য প্রশাসন নানান ফন্দি ফিকির করে কব্জায় এনেছে। তাদের কাজের সময় কখনও রাজ্য প্রশাসন তাদের শপিং মলে নিয়ে গিয়ে কেনাকাটা করাচ্ছে অথবা কোথাও কোন মন্দির, মসজিদে নিয়ে গিয়ে পুজোপাঠ ও নামাজ পড়াচ্ছে। কোথাওবা আবার নিজের দায়িত্বের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকার পর্যটন কেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। এসব করছে রাজ্য প্রশাসনের লিয়াজোঁ অফিসাররা। বিরোধীরা বলছে, শাসক দল পর্যবেক্ষকদের নিজেদের তাঁবে রাখার এ এক হীন প্রচেষ্টা। কিন্তু যে অঘটনটি দিদি ও তাঁর দলকে বিরাট ধাক্কা দিয়ে বেসামাল করে দিয়েছে তা হলো দিল্লীর একটি টিভি চ্যানেল স্টিং অপারেশন করে ‘দিদির সততার মুখোশ টেনে খুলে ফেলেছে।’ ওই স্টিং অপারেশনে দলের সাত সাংসদ, তিন বিধায়ক এবং এক উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন। ওই টিভি চ্যানেলের কর্ণধার তৃণমূল নেতা ও পুলিশ আধিকারিককে ঘুষ দিয়েছিলেন যাতে তাঁরা তাকে অনৈতিকভাবে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেন, যার ফলে তিনি সরকারী ও বেসরকারী কাজের বরাত পান। ঘুষ নেবার সময় ওই নেতারা ও আধিকারিক এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তারা তাকে বরাত পাইয়ে দিতে যথাযোগ্যভাবে সাহায্য করবেন। ঘুষ নেয়াকে কেন্দ্র করে শুধু রাজ্য রাজনীতিই নয়, জাতীয় রাজনীতি তোলপাড়। লোকসভার অধ্যক্ষ বিজেপির বরিষ্ঠ সাংসদ লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে একটি ‘এথিক্স’ কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটিকে ঘুষ কা-ের তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই কমিটি যদি ঘুষ দেয়া-নেয়া হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ পায় তাহলে তৃণমূলের ছয় লোকসভা সদস্য তাদের সদস্যপদ খোয়াতে পারেন। এতেই প্রমাদ গুনেছেন মমতা। তার বক্তব্য, তদন্তের সিদ্ধান্তটি তড়িঘড়ি করে নেয়া হয়েছে তাকে ও তার দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। তিনি সব ধরনের তদন্তের বিরোধিতা করে বলছেন, ‘আমার দলের কেউ ঘুষ নিতে পারে সেটা যখন বিশ্বাস করি না তখন তদন্তের কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। পুরোটাই সাজানো, গট আপ, রাজ্যে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনার মতো।’ এমনকি তাঁর অতি প্রিয় পুলিশ আধিকারিক যিনি তৃণমূলের হয়ে টাকা তোলেন বলে দাবি করেন ওই স্টিং অপারেশনে, তাঁর বিরুদ্ধেও তিনি কোন তদন্ত করতে নারাজ। আসলে দিদির ভয়, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরিয়ে আসে। অবাক করার ব্যাপার হলো এই মমতা দিদিই ২০০২-এর তাহেলকা কা-ের স্টিং অপারেশনকে সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং বিজেপির নেতৃত্বে যে এনডিএ জোট ছিল তার থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে বার করে আনেন। বলেন, ঘুষকা-ে জড়িত মন্ত্রীর সঙ্গে এক কাতারে বসবেন না। তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বান্ধবী জয়া জেটলির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি জর্জ ফার্র্নানডেজের বাড়িতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার পক্ষে প্রভাব বিস্তার করার জন্য ঘুষ নিয়েছিলেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি বঙ্গারু লক্ষণও একই কাজের জন্য ঘুষের টাকা নিয়েছিলেন। বিজেপি লক্ষণকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়। সিবিআই কোর্ট তাকে ঘুষ নেয়ার জন্য চার বছর কারাদ-ে দ-িত করে। তাকে এক লাখ টাকার জরিমানাও দিতে হয়। তাহেলকা ঘুষকা-ের স্টিং অপারেশন যিনি করেছিলেন তিনিই তৃণমূল নেতাদের ঘুষ নেয়ার ব্যাপারটা ক্যামেরাবন্দী করে স্টিং অপারেশন করেন। তাহেলকা স্টিং অপারেশনকে সাংবাদিকতার নয়া দিগন্ত বলে প্রশংসা করলেও মমতা এখন সেই একই লোকের করা স্টিং অপারেশনকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মূল চাবিকাঠি বলে অভিযোগ এনে চরম দ্বিচারিতার খেলা খেলছেন। বলছেন, স্টিং অপারেশনের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এটা একটা নিকৃষ্ট সাংবাদিকতার পরিচায়ক। এটা একটা অনৈতিকতার মাধ্যম। কিন্তু মমতার মুখে নৈতিকতার বুলি মানায় না। তিনি যে এক চরম সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর সাম্প্রতিক সব বক্তব্য। তার এই দু’মুখো সুবিধাবাদী রাজনীতি তার কট্টর সমর্থকদেরও হতাশ করেছে। বিশেষ করে তিনি নির্বাচন কমিশনের করা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে ভাষা ও ভঙ্গিতে তোপ দাগছেন তাতে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। যে মমতা বিরোধী পক্ষ থাকার সময় কমিশনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য কঠোর থেকে কঠোরতর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতেন, সেই তিনি আজ ক্ষমতায় থেকে উলটো সুরে কথা বলছেন। নির্বাচন কমিশন নাকি রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। অনেকে বলছেন, এটা মমতার ‘প্যানিক রিয়েকশন’। যে বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের খুবই হতাশ করেছে তা হলো বাঙালী বুদ্ধিবাদীদের তৃণমূল ঘুষকা- সম্পর্কে কঠোর নীরবতা। অবশ্য এর একটি কারণ হলো বুদ্ধিবাদীদের এক বিরাট অংশকে মমতা টাকা, পদ, জায়গা, জমি, ফ্ল্যাট দিয়ে কিনে নিয়েছেন। বামফ্রন্ট আমলে যারা প্রতিবাদী বলে খ্যাত ছিল, আজ তারা কোন অন্যায়কে অন্যায় বলে দেখেন না। তাদের অনেকে এমনও বলছেন যে ঘুষ দেয়া ও নেয়া বাঙালীর সমাজ জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও শিক্ষিত শহুরে বাঙালী এই ভাবধারার সঙ্গে একমত নয়। বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে মমতার আতঙ্কের পারদ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। তার একটি মূল কারণ হলো তাঁর দল এই প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে জোট ছাড়া একাই ভোটযুদ্ধে নেমেছে। এর আগে তার দল হয় কংগ্রেস নয় বিজেপিকে জোটসঙ্গী করে নির্বাচন লড়েছে। তার একদা জোটসঙ্গী কংগ্রেস আজ সিপিএমের সঙ্গে জোট ও আসন সমঝোতা করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোমরবেঁধে লড়াইয়ে নেমেছে। তার একসময়ের জোটসঙ্গী বিজেপি তাকে ও তার দলকে আক্রমণের মূল নিশানা করে তার আতঙ্ককে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস-সিপিএমের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জোট মমতার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচনে জোটের একটিমাত্র দাবি, স্বৈরাচারী ক্ষমতালিপ্সু মমতাকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করে রাজ্যে গণতান্ত্রিক অধিকারকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ভোট ভাগ হয়ে যাতে মমতার দলের বাড়তি সুবিধা না হয় তা নিশ্চিত করতেই এই দুটি বিপরীত মেরুর দল আসন সমঝোতার পথ বেছে নেয়। ভোটের পাটিগণিত অনুযায়ী তৃণমূল গত লোকসভা নির্বাচনে ৪১ শতাংশ ভোট পেলেও বামফ্রন্ট পায় ৩০ শতাংশ এবং কংগ্রেস ১০ শতাংশ, যা যোগ করলে দু’পক্ষের ভোট সমান সমান হয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ হবে বিজেপির অন্তত ১০ শতাংশ ভোট। কারণ বিজেপি ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদি ঝড়ের জন্য যে প্রায় ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তা তার পক্ষে এখন ধরে রাখা অসম্ভব। কারণ মোদি ক্ষমতায় আসার দু’বছর পরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। আর সাংগঠনিকভাবে বিজেপি এ রাজ্যে খুবই দুর্বল। ফলে যারা গত লোকসভা নির্বাচনে মোদিকে দেখে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল (কট্টর তৃণমূলবিরোধী বাম ও কংগ্রেসের সমর্থক) তারা এবার বিজেপিকে ভোট দিয়ে তাদের ভোট নষ্ট করতে চায় না। সেই ভোটগুলো কংগ্রেস-সিপিএম জোট প্রার্থীরা পাবেই পাবে। এটাই জোটের তুরুপের তাস। কংগ্রেস-সিপিএম নির্বাচনী জোট যে কোনদিন হতে পারে তা রাজ্যবাসীর কাছে ছিল কল্পনাতীত। কারণ এই দুটি দল একে অপরের প্রধান প্রতিপক্ষই ছিল না তাদের সম্পর্ক ছিল অহিনকুলের। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এবং মমতার স্বৈরাচারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক মানসিকতার বিরুদ্ধে এই দুই বিপরীত মেরুর দল এক জোট হয়েছে। দুই দলের নিচুতলার কর্মী ও সমর্থকদের প্রবল চাপে দুই শিবিরের নেতারা জোট গড়তে বাধ্য হয়। কারণ মমতা অনৈতিকভাবে নানা ধরনের প্রলোভনের টোপ দিয়ে এক সাংঘাতিক দল ভাঙানোর খেলায় মেতে উঠেছিলেন। কংগ্রেসকে উদ্দেশ করে প্রায়শই বলতেন, তিনি দলটিকে সাইনবোর্ডে পরিণত করবেন। আর সিপিএম সম্বন্ধে বলতেন, ওর মাজা এমনভাবে ভেঙ্গে দেবেন যে দলটি কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কংগ্রেসের প্রতি মমতার দেয়া হুঁশিয়ারি শুনেই দলপ্রধান সোনিয়া গান্ধী ও দলের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রচ- ক্ষুব্ধ হন। তাদের আরও একটি ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় এসে কংগ্রেসের নয় বিধায়ককে মমতা নিজের দলে ভেড়ান এবং কংগ্রেসকে অপমান করে জোট থেকে তাড়িয়ে দেন। রাজ্যকে ‘ভেজাল’ কংগ্রেসের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ডাক দেন। সোনিয়া এসব ভোলেননি। তিনি ও তাঁর পুত্র রাহুল সুযোগ খুঁজছিলেন কিভাবে এই চরম অপমানের বদলা নেয়া যায়। কংগ্রেস যাতে সিপিএমের সঙ্গে জোট না বাঁধে সেই লক্ষ্যে মমতা তার দলের তাবড় তাবড় নেতাদের সোনিয়া ও রাহুলের কাছে পাঠান দরবার করতে। তাতে উল্টো ফল হয়েছে। তারা দু’জনেই ক্ষেপে দলের ও জোটের হয়ে ভোট প্রচারে আসছেন। জোটের কাছে যে প্রশ্নটি বড় আকার দেখা দিয়েছে তা হলো সিপিএম-এর সমর্থক ও কর্মীরা কংগ্রেসের প্রতি তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে কী কংগ্রেস প্রার্থীদের জন্য ভোট দেবে? একই প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেস ভোটারদের সম্বন্ধে। কিন্তু জোটের জন্য আশার আলো জ্বালিয়েছে নিচুতলার দুই শিবিরের কর্মী ও সমথর্করা। তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর হাতে চূড়ান্তভাবে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়ে তাদের মনে তৃণমূলবিরোধী (পড়ুন মমতা বিরোধী) মানসিকতা এমন জোরালোভাবে কাজ করছে যে, যা দুই দলের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এক সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যা দুটি দলকে খুব কাছাকাছি এনেছে এবং জোটের পথকে অনেকটা মসৃণ করে দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য একটাই। ২৯৪ আসনে কংগ্রেস-বামসহ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে যেন একজন করে প্রার্থী নির্বাচন ময়দানে থাকে। যদিও কয়েকটি আসনে দুটি দল আসন রফায় পৌঁছতে পারেনি, যার জন্য ওই সব আসনে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবুও জোটের নেতারা শেষ চেষ্টা করে দেখছেন যে এতে যদি তৃণমূলের সুবিধা হয়ে যাচ্ছে তাহলে জোটের কোন এক পক্ষকে ভোটের লড়াই থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। বাহবা দিতে হয় রাজ্য সিপিএমের তিন বরিষ্ঠ নেতাÑ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্র ও গৌতম দেবকে যারা আগ বাড়িয়ে কংগ্রেসকে যথার্থ সম্মান জানিয়ে, নিজেদের জয়ী আসন ছেড়ে দিয়ে জোট প্রক্রিয়াকে সুদৃঢ় করেছেন। তাঁরা এবং সিপিএমের অসৎ নেতারা এখন কংগ্রেসের মিছিল মিটিং ও জনসভায় উপস্থিত থেকে এক নতুন রাজনৈতিক নজির ও সংস্কৃতি গড়ছেন। একইভাবে কংগ্রেসের নেতারা সিপিএমের পদযাত্রায় শামিল হয়ে সিপিএমকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করছেন। এই নির্বাচনে মমতার চরম অস্বস্তির কারণ হলো স্টিং অপারেশনে তার দলের নেতারা ঘুষ নিতে গিয়ে যেভাবে ক্যামেরাবন্দী হলেন তাঁর অস্বস্তি কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে তার দলের এক সাংসদের বোমা ফাটানো এক বক্তব্যে। বারাকপুরের লোকসভা সদস্য দীনেশ ত্রিবেদী বলেছেন, ‘আমি দলের সভাপতি হলে বলতাম, যারা টাকা নিয়েছেন তাঁরা যতক্ষণ না কলঙ্কমুক্ত হচ্ছেন ঘরে বসে থাকুন। তারা যদি ইস্তফা দিতেন তৃণমূলের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে যেত।’ তার মন্তব্য থেকে পরিষ্কার ঘুষকা-ে অভিযুক্তদের প্রতি মমতা দিদি যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে ত্রিবেদীর সমর্থন নেই। শুধু ত্রিবেদীই নয়, যাদবপুরের সাংসদ সুগত বসু প্রকাশ্যে বলছেন, স্টিং অপারেশনের ছবিগুলো যদি জাল হয়ে থাকে, তবে তা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হোক। কিন্তু মমতা সব ধরনের তদন্ত ও পরীক্ষার ঘোরবিরোধী। তাঁর এই তদন্তবিরোধী মানসিকতা রাজ্যবাসীকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে তৃণমূল নেতারা সত্যি সত্যি ঘুষ নিয়েছেন। মমতা ঘুষকা-কে আড়াল ও চাপা দিতে এমন সব মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন যে তিনি ও তার দল ক্রমশ মিথ্যাচার জালে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমে বলা হলো পুরো ঘুষকা-টাই ‘সাজানো, জাল এবং ম্যানুফ্যাকচারর্ড।’ তারপর বলা হলো দুবাই থেকে বিদেশী টাকা এনে তাঁর ও দলের স্বচ্ছ ভাবমূতিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে যারা টাকা নিয়েছে তারা দলের হয়ে ‘অনুদান’ নিয়েছে। কিন্তু অনুদান নিলে দলের তরফ থেকে রসিদ কেটে অনুদানদাতাকে দিতে হয়। অনুদান নগদে নিলে ২০,০০০ টাকার বেশি নেয়া যায় না। বেশি টাকা নিতে গেলে চেকে নিতে হয়। যার কোনটাই তৃণমূল নেতারা করেননি। মমতার ঘুষকা- নিয়ে আরও একটি শিরপীড়ার কারণ যে বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। তিনি তার দলের আইনজীবীকে দিয়ে আদালতে আর্জি পেশ করেছেন এই বলে যে, ঘুষকা- মামলার শুনানি এক মাস ধরে চলা নির্বাচনের সময় যেন স্থগিত থাকে এবং আদালত ঘুষকা- নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে যেন নিজেকে বিরত রাখে। কিন্তু আদালত দুটি আর্জিই নাকচ করে দিয়েছে। মমতা ঘুষকা-কে যতই জাল, ষড়যন্ত্র বলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যর্থ। ঘুষকা-ে জড়িয়ে যাওয়া এক সাংসদ সৌগত রায় প্রকাশ্য সভায় কবুল করেছেন যে, তার নাম ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি খুবই লজ্জিত। তাঁর এই বক্তব্যকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা মমতাবিরোধী প্রচারে নেমে পড়েছে। আর তাতেই বেড়েছে মমতার গাত্রদাহ। হুঁশিয়ারির মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি ভোটার ও বিরোধীদের ধমকাচ্ছেন এই বলে, যারা বিরোধীদের ভোট দেবে তাদের ফলাফল ঘোষণার পর তৃণমূলের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। মমতার অতি বিশ্বস্ত নাম্বার টু মুকুল রায় যিনি তিন মাস আগে তৃণমূল থেকে বেরিয়ে নিজের এক আলাদা দল গড়ার নাটক করেছিলেন, সেই তিনিও তার ঘনিষ্ঠ মহলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, কংগ্রেস-সিপিএমের যদি জোট হয়, তাহলে মমতার বিপদ আছে। তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে। আর তা হলেই তৃণমূল দলটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সঠিক হবে তা এখন বলা না গেলেও এটা বলা যেতে পারে নিশ্চিতভাবে যে ঘুষ কেলেঙ্কারি ও সারদা চিটফা-কা- বিরোধীদের মরা গাঙে বান এনেছে এবং তাদের পালে হাওয়া তুলেছে। লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক
×