ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ জালিয়াতির মূল পরিকল্পনা হয় ফিলিপিন্সে

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৮ মার্চ ২০১৬

রিজার্ভ জালিয়াতির মূল পরিকল্পনা হয় ফিলিপিন্সে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রিজার্ভ জালিয়াতির মূল পরিকল্পনা হয় ফিলিপিন্সে। সেখানে বসেই হ্যাকাররা এ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ও বাংলাদেশী নাগরিকদের। এক বছর আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরির পরিকল্পনা করে হ্যাকাররা। আর দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে নজর রেখেছিল তারা। হ্যাকার ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে একাধিক দেশের ব্যাংক, জুয়াড়ি চক্র ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ ঘটনার অন্যতম মূল হোতা হচ্ছে চীনা ব্যবসায়ী কিম অং। এ ঘটনার ‘রাগববোয়ালদের’ একজন হচ্ছেন ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের সিইও লরেঞ্জা ট্যান। এ জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন ওই ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাকিংয়ের ঘটনায় ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং সিস্টেম বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পুরো প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাধারণ মানুষের সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাংকিং সিস্টেম। দেশটির গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সূত্র বলছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্যেই এমন জালিয়াতি হওয়ার আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে দেশটির বৈদেশিক ব্যাংক লেনদেন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশকিছু দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে ফিলিপিন্সের সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ কেন এই সতর্কতা! খোদ ফিলিপিন্সের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রিজার্ভ এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হয়ে কেন ফিলিপিন্সে এলো? কারা এর সঙ্গে জড়িত! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে এ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়েছে ফিলিপিন্সে তা খোলা হয়েছিল প্রায় এক বছর আগেই। গেল বছরের ১৫ মে এই হিসাব খোলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় টাকা পাচারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এর মধ্যে অন্যের সই জাল করে একটি হিসাব খুলেন ফিলিপিন্সের রিজাল ব্যাংকের জুপিটর শাখা ব্যবস্থাপক দিগুইতো। ওইসব এ্যাকাউন্ট খোলার জন্য যেসব ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সেগুলোও ছিল ‘ভুয়া’। ওই চারটি এ্যাকাউন্ট যাদের নামে খোলা হয় তারা হলেন এনরিকো টিওডোরো ভাসকুয়েজ, আলফ্রেড সান্তোস ভারগারা, মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ ও জেসি ক্রিস্টোফার ল্যাগ্রোসাস। ৫০০ ডলার দিয়ে এ্যাকাউন্ট খোলার পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ সময়ে কোন লেনদেন হয়নি। জমা পড়েনি কোন অর্থ। উত্তোলনও করা হয়নি। চারটি এ্যাকাউন্টে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ৮১ মিলিয়ন ডলার জমা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ওই এ্যাকাউন্ট জব্দ করার অনুরোধ পাঠায় বিকেল ৫টায়। ওইদিন ব্যাংক ছুটি থাকায় কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি শাখা ব্যবস্থাপক ওই অনুরোধ পাওয়ার পরও তিনি চার এ্যাকাউন্টের অর্থ পরিশোধ করে দেন। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অনুরোধ পরিপালন করে এ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়। লেনদেনের পরও ওই ৬৮ হাজার ডলার জব্দ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শাখা ব্যবস্থাপক ওই এ্যাকাউন্টগুলোতে হ্যাক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছে শুরু থেকেই জানতেন। জানার পরও ডলার জমা হলে তড়িঘড়ি করে তা ট্রান্সফার করা হয়। ক্যাসিনোর কর্মকর্তা উইক্যাং জু চীনের নাগরিক। তার মাধ্যমে এই অর্থ হংকংয়ে কিম অং নামের এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। উইক্যাং জু বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। এসব ঘটনায় বিস্মিত ফিলিপিন্সের তদন্তকারীরা। দেগুইতোর বিরুদ্ধে মামলা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আরসিবিসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো এবং তার সহকারীর বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জাল করে এ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগে মামলা করেছেন উইলিয়াম গো নামে এক ব্যবসায়ী। মূল হোতা কিম অং ॥ চীনা ব্যবসায়ী কিম অং। বেশিরভাগ সময় ফিলিপিন্সেই কাটান। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে একটি গার্মেন্টস ও তিনটি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। এছাড়া গলফ ও টেনিস ক্লাবের সদস্য অং। শুধু তাই নয়, প্রতারণা ও অবৈধ কর্মকা-ের খাতায় বহু আগেই নাম লিখিয়েছেন এ ধনকুবের। তবে ফিলিপিন্সের পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের কারণে পার পেয়ে যান বারবার। ফিলিপিন্স স্টক একচেঞ্জের ওয়েবসাইট ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় ওঠে এসেছে তার নাম। ফিলিপিন্সের সিনেট কমিটির চেয়ারপার্সন সার্জেই অসমেনা মনে করেন, রিজাল ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির মূল পরিকল্পনাকারী এই কিম অং। জালিয়াতির ঘটনা জানতেন লরেঞ্জা ট্যান ॥ গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিপুল অর্থ আরসিবিসি ব্যাংকে যায়। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একটি নির্দেশ ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টার মধ্যেই আরসিবিসিতে পৌঁছায়, যেখানে ওই অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিতে নিষেধ করা হয়। তবে চীনা নববর্ষের কারণে ব্যাংক বন্ধ ছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি বন্ধ থাকলেও ৯ তারিখ ব্যাংক খোলে। ওই দিন শুরুতেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নির্দেশ দেখা উচিত ছিল। কিন্তু ওই নিষেধ গুরুত্ব না দিয়ে বিপুল অর্থ উঠানোর সুযোগ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অনুরোধ আরসিবিসি উত্তর দিয়েছে ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে, যখন ব্যাংকের খোলা থাকার সময় প্রায় শেষ।
×