ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেটই সান্ত্বনা

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৭ মার্চ ২০১৬

মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেটই সান্ত্বনা

মিথুন আশরাফ, কলকাতা থেকে ॥ এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ- এক এক করে পাঁচটি উইকেট নিয়ে নিলেন বাংলাদেশ ‘কাটার মাস্টার’ মুস্তাফিজুর রহমান। এর মধ্যে চারটিই করলেন বোল্ড! নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইডেন গার্ডেনে এমন সব ‘কাটার’ মারলেন মুস্তাফিজ, তাতে হেনরি নিকোলস, কেন উইলিয়ামসন, গ্র্যান্ড ইলিয়ট, মিচেল সান্টনার ও নাথান ম্যাককুলাম বল বুঝতে হিমশিম খেয়ে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন। ৪ ওভারে মাত্র ২২ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করে ফেলেন মুস্তাফিজ! কি দুর্দান্ত বোলিং তার। ওয়ানডে কিংবা টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোন বোলার এখন পর্যন্ত ৫ উইকেট শিকার করতে পারেননি। মুস্তাফিজ সেই কাজটিও করে দেখালেন। ওয়ানডে বিশ্বকাপে শফিউল ইসলাম (২০১১ আয়ারল্যান্ড), মাশরাফি বিন মর্তুজা (২০০৭ ভারত), রুবেল হোসেন (২০১৫ ইংল্যান্ড) ও সাকিব আল হাসান (২০১৫ নিউজিল্যান্ড) ৪ উইকেট করে নিয়েছিলেন। তাদের ছাপিয়ে গেলেন মুস্তাফিজ। আর টি২০ বিশ্বকাপে সাকিব দুইবার (২০১৬ ওমান ও ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ) চার উইকেট করে নিয়েছিলেন। সাকিবকে পেছনে ফেলে এখন টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা বোলার হয়ে গেলেন মুস্তাফিজই। ৫ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ উইকেট নিলেন। যেহেতু শনিবার ম্যাচটি শেষেই এবার বিশ্বকাপে আর কোন ম্যাচ নেই বাংলাদেশের। পরের বিশ্বকাপ আসার আগ পর্যন্ত তাই বিশ্বকাপে সেরা হয়ে থাকলেন মুস্তাফিজই। শেষ দিনে এসে ঝলক দেখিয়ে দিলেন। গত বছর এপ্রিলে টি২০তে অভিষেকের পর প্রথমবারের মতো টি২০তে ৫ উইকেট শিকার করলেন মুস্তাফিজ। বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এক ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নিলেন। ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে এক ম্যাচে যে ইলিয়াস সানি ৪ ওভারে ১ মেডেনসহ ১৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, সেটি এখনও টি২০তে বাংলাদেশ বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট অর্জনের তালিকায় ওপরেই আছেন। সানি যে রান কম দিয়েছিলেন। তবে পেসার হিসেবে টি২০তে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ১৩ ম্যাচে ২২ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজই সবার উপরে থাকছেন। ভারতের সেরা পেসার এ মুহূর্তে আশীষ নেহরা। সেই নেহরা যখন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বলেন, ‘দুর্দান্ত বোলার মুস্তাফিজ। ‘গড গিফটেড’ বোলার। ভাগ্যক্রমে আইপিএলে আমার দলেই খেলবে মুস্তাফিজ।’ তখন কি আর মুস্তাফিজের সাধুবাদের প্রয়োজন পড়ে। নেহরা যখন মুস্তাফিজকে নিজের দলে পেয়েছেন, সে কথা বলেন, চোখে মুখে নেহরার সে কি উজ্জ্বলতা। যেন মহামূল্যবান একটি ডায়মন্ডই পেয়ে গেছেন। মুস্তাফিজকে নিয়ে এমন কথা যখন নেহরা বলেন, তখনই বোঝা যায় এ ‘কাটার’ বোলারকে নিয়ে কতটা ভাবনা আছে। সেই মুস্তাফিজ ‘কাটার’ যে কি তা ভালভাবেই বুঝেছে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুইয়ে, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া। এবার বুঝলো নিউজিল্যান্ডও। গত বছরটিতো পুরোদমে মুস্তাফিজময় হয়েই থেকেছে। একের পর এক ম্যাচ খেলেছেন মুস্তাফিজ। আর শুধু উইকেট নিতে থেকেছেন। প্রতিপক্ষরাও বাংলাদেশের সামনে কাত হতে থেকেছে। গত বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেন মুস্তাফিজ। সেই ম্যাচে ২ উইকেট নেন মুস্তাফিজ। আফ্রিদি ও হাফিজের মতো সেরা দুই ব্যাটসম্যানকে আউট করে দেন। বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের বিপক্ষে টি২০ ম্যাচ জেতে। কি দুর্দান্ত অভিষেক হয় মুস্তাফিজের। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি২০তে খুব বেশি আলোড়ন ছড়াতে না পারলেও জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে উজ্জ্বলই থাকেন। ইনজুরি মুস্তাফিজকে যেন ঘিরে ধরতে থাকে। বিশ্বকাপের আগে এশিয়া কাপে মাত্র ৩টি ম্যাচ খেলতে পারেন। ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন। ইনজুরিতে যে সেই জোশ নেই, তা ধরা পড়ে। শেষ পর্যন্ত টি২০ বিশ্বকাপে মুস্তাফিজের উপস্থিতি যে দরকার, তাই ইনজুরি মুক্ত হতে এ পেসারকে দলের বাইরে রাখা হয়। গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ও এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে খেলতেই পারেননি মুস্তাফিজ। এমনকি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বেও খেলা হয়নি। তাসকিন ও সানিকে নিয়ে এত ঝড়ঝাপটা গেল, তবুও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে না ওঠায় মুস্তাফিজ বল হাতে নিতে পারেননি। ‘সুপার টেনে’ পাকিস্তানের বিপক্ষেও খেলা হয়নি। মুস্তাফিজের অভাব তখন ভালভাবেই বুঝা যাচ্ছিল। তিনি খেললে যে দল কতটা উপকৃত হতো তা বোঝাই যাচ্ছিল। অবশেষে ব্যাঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নামেন। অসিদের বিপক্ষে প্রথমবার খেলতে নেমেই ২ উইকেট তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে কাঁপিয়ে দেন। আর ভারত ক্রিকেটাররাতো আগে থেকেই ‘মুস্তাফিজ’ নামে মনের ভেতর ভীতি জমিয়ে রেখেছিলেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই ২০১৫ সালে জুনে ওয়ানডেতে অভিষেক হয়েছিল মুস্তাফিজের। সেই তিন ম্যাচের সিরিজেতো শুধু ‘মুস্তাফিজ মুস্তাফিজ’ রবই উঠেছে। ভারত যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কাছে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হেরেছে, ভারতকে হারানোর নায়কতো ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সর্বোচ্চ ১৩ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা হওয়া মুস্তাফিজই। প্রথম ম্যাচে ৫ উইকেট ও দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে টানা দুই ম্যাচে ম্যাচসেরাও হয়েছেন মুস্তাফিজ। ভারত ব্যাটসম্যানরাতো ভয় পাবেনই। যতই ভারতের মাটিতে খেলা হোক। তাইতো ২ উইকেট টপাটপ নেন এ ‘কাটার মাস্টার’। খুব অল্প সময়ে মুস্তাফিজ নিজেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তার ভীতি ক্রিকেট বিশ্বে ছড়িয়েও দিয়েছেন। যে দলই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ থাকুক এখন, মুস্তাফিজ একাদশে থাকা মানেই প্রতিপক্ষকে মুস্তাফিজকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করতেই হয়। কিভাবে ব্যাটসম্যানরা মুস্তাফিজকে ঠেকাবেন, সেই ভাবনাই শুধু মাথায় ঘুরপাক খায়। নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদেরতো তার বল দেখে যেন মাথা ঘুরতেই থাকল। তাইতো একের পর এক ব্যাটসম্যান বোল্ড হতে থাকলেন। এবার বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দুজন বোলার এক ম্যাচে ৫ উইকেট নিতে পেরেছেন। একজন অস্ট্রেলিয়ার জেমস ফকনার। পাকিস্তানের বিপক্ষে ২৭ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন। আরেকজন বাংলাদেশের মুস্তাফিজ। তিনি ২২ রান দেয়ায়, তালিকায় এখন সবার ওপরেই আছেন। ২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপ থেকে এক ম্যাচে উইকেট নেয়ার দিক থেকে সবার ওপরে আছেন শ্রীলঙ্কার অজন্থা মেন্ডিস। ৮ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেন। এর বাইরে ৫ উইকেট করে নিয়েছেন ৬ বোলার। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শুধু আছেন মুস্তাফিজ। শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ (৩ রানে ৫ উইকেট), পাকিস্তানের উমর গুল (৬ রানে ৫ উইকেট), হল্যান্ডের আহসান মালিক (১৯ রানে ৫ উইকেট), বাংলাদেশের মুস্তাফিজ (২২ রানে ৫ উইকেট), অস্ট্রেলিয়ার ফকনার (২৭ রানে ৫ উইকেট) ও শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা (৩১ রানে ৫ উইকেট) আছেন। ভারতের মাটিতে এখন টি২০তে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী বোলারের নামটিও মুস্তাফিজই! শেষ ওভারে চতুর্থ ও পঞ্চম বলে যে দুটি উইকেট নিলেন টানা দুই বলে, শেষ বলে আরেকটি উইকেট নিলে হ্যাটট্রিকই হয়ে যেত। নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানরা মুস্তাফিজের ‘কাটারে’ ক্ষতবিক্ষতই হয়ে গেলেন।
×