ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ইলেকট্রার গান এবং ৩২ নম্বরের বাড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ মার্চ ২০১৬

ইলেকট্রার গান এবং ৩২ নম্বরের বাড়ি

একটি বাড়ি যখন জাতির তীর্থালয়ে পরিণত হয় বা একটি জাতি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন শত সহস্র্র ষড়যন্ত্র করেও তার নাম ভোলানো যায় না। বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িটির নামও ভোলানো যায়নি। যাবে না কোনদিন। এই বাড়িতেই কি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে পিতাকে, তার সহধর্মিণীসহ গোটা পরিবারকে। নামটি মুছে দেয়া যায়নি। সেই মর্মস্পশী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাঁর “ইলেকট্রার গান’ কবিতায় এভাবে- “শ্রাবণের মেঘ জটলা পাকায়/ মেঘময়তায় ঘন ঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে/ মিত্র কোথাও আশে পাশে নেই/ শান্তি উধাও/ নির্দয় স্মৃতি মিতালী পাকায় শত করোটির সাথে/ নিহত জনক এ্যাগামেমন, কবরে শায়িত আজ”। ভোলানো যায়নি ৩২ নম্বরের বাড়িটির নাম। এমনকি বাড়িটির নাম ভোলানোর জন্যে রাস্তার নামটি পর্যন্ত পাল্টানো হয়েছে- ৩২ নম্বর পরিবর্তন করে (সম্ভবত) ১১নং করা হয়েছিল। কিন্তু আজও যে কোন রিকশা বা অটোরিকশায় উঠে শুধু ৩২ নম্বর বললেই চলে, ধানম-িও বলতে হয় না, চালক ঠিকই সেখানে নিয়ে যাবে। এমনকি এই বাড়ির নাম ভোলানোর জন্যে পিতাকে ঢাকায় দাফন করা হয়নি, টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়ি নিয়ে দাফন করা হয় অত্যন্ত অবহেলায়। তারপরও সেই বাড়িটি আজ বাঙালীর তীর্থালয়। বস্তুত ৩২ নম্বরের বাড়ি তো বটেই, টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটিও বাঙালীর তীর্থালয় এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছে। হাজার বছর ধরে তিল তিল করে বাড়ি দু’টি গড়ে উঠেছে। শক্তি ভিতের ওপর। যদিও ক্ষতার্ত এবং ক্ষতের বোঝা বয়ে চলেছেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। শামসুর রাহমানের ভাষায়- “আড়ালে বিলাপ করি একা একা, ক্ষতার্ত পিতা/ তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ/ এমনকি, হায় আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/ নিষিদ্ধ আজ/ তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়।” পিতাকে হত্যা করেছে পরিবার-পরিজনসহ, কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১৯ বার, চট্টগ্রাম, রাসেল স্কোয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির মতো বোমা ও গুলি চালানো হয়েছে, এমনকি খালেদা-তারেকরা মা-বেটার ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সিরিজ গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে (পাকিস্তান আর্জেস গ্রেনেড, যা কেবল আর্মির কাছে থাকে)- এমনি হেন ষড়যন্ত্র নেই যা করা হয়নি পিতা ও পিতার উত্তরাধিকারকে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়ার জন্যে। সেই সাথে ৩২ নম্বরের বাড়িটিও। এ বাড়ির প্রতিটি ইট বাঙালীর হাজার বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি মিছিল। সেই ইট দিয়ে গড়ে উঠেছে যে তীর্থালয় তাকে ভেঙ্গে ফেলা যায় না। কোনদিন যাবেও না। ৩২ নম্বরের বাড়ি ও সুধাসদন, যে ইতিহাস সবার জানা দরকার অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা প্রবাসী এম নজরুল ইসলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়ির বিরুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী বিএনপির ষড়যন্ত্রের সম্যক জবাব দিয়েছেন। তার সদ্য প্রকাশিত “৩২ নম্বরের বাড়ি ও সুধাসদন : যে ইতিহাস সবার জানা দরকার।” তথ্যবহুল এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হবার পর গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন নজরুল। দু’দিন আগে এর প্রকাশনা উৎসব হয়েছে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে। কানায় কানায় ভর্তি দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে গ্রন্থের লেখক এম নজরুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য দেন। এখানে নজরুল সম্পর্কে দু’একটি কথা বলা দরকার। ভিয়েনায় থাকেও দুই যুগ ধরে বাংলাদেশ, বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে লালন করে চলেছেন। আর তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার, ৩২ নম্বরের বাড়ি সম্পর্কে কেউ কোন খারাপ কথা বললে অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। নজরুলও ক্ষুব্ধও হন, তবে ক্ষুব্ধ হয়ে বসে থাকেননি, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গ্রন্থাকারে তার জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন। তার “৩২ নম্বরের বাড়ি ও সুধাসদন : যে ইতিহাস সবার জানা দরকার” গ্রন্থটিতে তারই বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও মহান একুশের সঙ্গীত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি....” এর রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, “ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতা ও মনীষীদের বাসগৃহ পর্যন্ত ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। লন্ডনে কার্ল মার্ক্স যে সব গৃহে বাস করতেন তা এখন পর্যটনকেন্দ্র, লেলিন লন্ডনে যে অফিস ঘরটিতে বসে ‘ইশক্রা’ পত্রিকা বের করতেন তা এখন জাদুঘর, ভারতে মহাত্মা গান্ধী যে সব বাড়িতে বাস করেছেন, তা এখন আশ্রমের মতো, এলাহাবাদে নেহেরু পরিবারের ‘আনন্দ ভবন’ এর নাম ভারতের ইতিহাস যুক্ত হয়েছে। প্রিয় পাঠক, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটিও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আমি শুধু দুটি উদাহরণ দিচ্ছি : ১. ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্যন্ত গোটা বাংলাদেশ এই ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পরিচালিত হয়েছে। সেইদিন এই বাড়ি থেকে যে আদেশ নির্দেশ গেছে জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ২. এই বাড়িতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। অন্যায় দখলদার খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে হাইকোর্টের নির্দেশে উচ্ছেদের (মামলাটিও করেছিল ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) পর তখন তারা প্রশ্ন তুলেছিল বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘নি¤œ মধ্যবিত্ত’ ঘরের সন্তান। তিনি কি করে ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ি করলেন।” নজরুল তার গ্রন্থে কিভাবে জমিটি পেয়েছিলেন, কিভাবে একটা দুইটা ইট গেঁথে তিন কক্ষের একতলা বাড়িটি করেছেন; একইভাবে শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত অনুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার সুধাসদন বাড়িটিও ৩২ নম্বরের মতোই দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছিলেন। বঙ্গমাতা বেগম মুজিব যেমন বাড়ি নির্মাণে কারও সাহায্য নেননি, ড. ওয়াজেদ মিয়াও কারও সাহায্য নেননি। ৩২ নম্বরের বাড়ি নির্মাণের জন্য হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর প্রথমে তো শেখ হাসিনাকে বাড়িতে উঠতেই দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে মিলাদ পড়িয়েছেন। পরে অবশ্য বাড়িটি শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা জানতেন না ‘ঋণের কথা’। তাই ঐ অনুপস্থিতির সময় ঋণের কিস্তি শোধ করা হয়নি, এই সুযোগ নিয়ে বাড়িটি ‘নিলামে’ তোলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার নজরে এলে তিনি বাকি কিস্তি পরিশোধ করে জমির দলিল ও অন্যান্য কাগজপত্র ছাড়িয়ে নেন। হাউজ বিল্ডিং-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ভুল হয়েছে এবং তারা সাধারণ বাড়ি মনে করেছেন। আমি মনে করি এটিও একটি চক্রান্ত ছিল, বাড়িটি অন্যের কাছে কিংবা রাজাকারের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়ার জন্যে এবং তাতেও যে তখনকার ক্ষমতাসীনদের হাত ছিল না এমনটি ভাবার কোন কারণ নাই। নজরুল অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন ৫০-এর মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার যখন ঢাকা আসেন এবং ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। সম্ভবত সেগুন বাগিচায়। অল্পদিনেই সে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না, দরদ থাকলেও না, কারণ ভাড়া দিলে বাড়িঅলার ওপর খড়গ নেমে আসত। এমনকি শুনলে অবাক হতে হয়, বিশেষ বিশেষ স্কুল শেখ হাসিনাকে ভর্তি পর্যন্ত করেনি। এই প্রেক্ষাপটেই বেগম মুজিব একটি নিজস্ব আবাসিক বাড়ির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। জমির দাম ছিল মাত্র ৬০০০ টাকা, সংসার খরচ থেকে টাকা জমিয়ে জমিয়ে তবেই দ্বি-কক্ষ ও ড্রয়িং রুম বিশিষ্ট বাড়িটি বানিয়ে ১৯৬১ সালে এ বাড়িতে ওঠেন। তারপর তো এই বাড়িই ছিল আমাদের স্বাধীতা ও মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়ার্টার। এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে বেশির ভাগ সময় কারাগারে থাকতে হতো। সে সময় বেগম মুজিব দল পরিচালনার নির্দেশাবলী প্রদান করতেন। শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করার আগে থেকে কতগুলো মিথ্যা-বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হয়েছিল-২০০ ভরি সোনার অলংকার পাওয়া গেছে, অবৈধ অস্ত্র ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়িটি হস্তান্তরের দিন দৈনিক ইত্তেফাক-এর রিপোর্টার হিসেবে আমি দেখেছি। যে ২০০ ভরি সোনার অলংকারের কথা বলা হয়েছিল, তা সব অলংকার নয়- ১৯৭০ ও ৭৩ সালের নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন এলাকার নেতৃবৃন্দ সোনার নৌকা উপহার দেন। অনেকে রুপোর নৌকাও দেন। সোনা-রুপার অধিকাংশই নৌকা। অলংকার ছিল খুবই কম। কারণ এ বাড়ির সবাই ছিলেন উন্নত সংস্কৃতি ও রুচির মানুষ। সেগুলোকে মিলিয়ে চরম মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র করা হয়। শেখ কামাল, শেখ জামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র ড্যামি করে স্যুভেনির হিসেবে রাখা হয়েছিল। অথচ সেগুলোকে বলা হয়েছে ‘অবৈধ অস্ত্র’। আমি অবাক হই না, বিএনপি এমনই। তবে হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে সবচেয়ে দামী জিনিস ছিল বই, শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট, (ছায়ানটের ছাত্র ছিল), আর ক্রিকেট ব্যাট, ফুটবল এসব। যখন ঐ সিজারলিস্ট প্রকাশ হয়েছিল তখন আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আলোচনায় প্রশ্ন ওঠে এত সোনার অলংকার? বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল- এই ৫ জনের কিছু অলংকার তো থাকতেই পারে। প্রশ্ন করলাম, আপনাদের বাড়িতে ক’জন নারী এবং কত ভরি স্বর্ণালংকার আছে? উত্তর দিতে গিয়ে তারা জিহ্বায় কামড় দিয়েছিলেন। একটি কথা বলে আমি শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু পরিবার ‘নি¤œ মধ্যবিত্ত’ ছিল, না ‘উচ্চ মধ্যবিত্ত’ সে আমার জানা নেই। তবে যেটা দেখেছি, অনেক জমি এবং গোলাভরা ধান। বহুবার শেখ হাসিনার সাথে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছি। শেখ হাসিনাকে ‘রাজার মাইয়া’ বলতেও শুনেছি। সব কিছুর উর্ধে বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গেছেন। এমনকি দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা চরম অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেও তাদের সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। আমি এম নজরুল ইসলামকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আমাদের উপহার দেবার জন্যে। সেই সঙ্গে গ্রন্থটির অঙ্গহানি না করে আরও তথ্য পরবর্তী সংস্করণে যোগ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। ঢাকা : ২৫ মার্চ ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×