ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এক ভাগেরও কমভোট পড়েছে লাঙ্গলে

ইউপি নির্বাচনে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়, অস্তিত্ব সঙ্কটে জাপা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ মার্চ ২০১৬

ইউপি নির্বাচনে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়, অস্তিত্ব সঙ্কটে জাপা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ উপজেলা ও পৌরসভার পর এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ফল বিপর্যয় হয়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে মাত্র এক ভাগেরও কম ভোট পেয়েছেন দলের প্রার্থীরা। সেই সঙ্গে মাত্র একভাগ ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী দিতে পেরেছে জাপা। একের পর এক ফল বিপর্যয়ে অনেকটাই চাপের মুখে দলটি। বিরোধী দলের ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কিত খোদ জাপা নেতাকর্মীদের অনেকে। দলটির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, তৃণমূলে সংগঠন না থাকাতেই ওই ভয়াবহ ফলাফল বিপর্যয়ের মূল কারণ। ফল থেকে শিক্ষা নিয়ে দলকে শক্তিশালী করার কথা জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এখন থেকে আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতির কথাও বলছেন অনেকে। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে দলটি। এদিকে নানা জটিলতায় পেছাল জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলন। নতুন তারিখ অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল কাউন্সিল হতে পারে। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রথম ধাপের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মোট ৫৫ হাজার ভোট পেয়েছেন, যা প্রদত্ত ভোটের এক শতাংশেরও কম। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন নেতাকর্মীরা। ৩১ মার্চ থেকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৬৪৩ ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ১৫৬টিতে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে দলটি। ইউনিয়ন পরিষদের এই ফলকে জাতীয় পার্টির জন্য রেড এ্যালার্ট হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জাতীয় পার্টি জেপির (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) চেয়েও কম ভোট পেয়েছে এরশাদের জাপা। মঞ্জুর জেপি প্রদত্ত ভোটের দশমিক ৯৭ শতাংশ পেয়েছে। আর এরশাদের জাপা পেয়েছে মাত্র দশমিক ৮৯ শতাংশ। ভোটের সমীকরণে এরশাদের জাপার চেয়ে মঞ্জুর জেপি এখন বড় দল। আবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে আরও বেহাল মনে হয় এরশাদের জাপার। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা প্রথম দফার নির্বাচনে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ভোটের এই অনুপাত প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও দলের মুখপাত্র জিএম কাদের বলেন, এ হিসাব বলে দেয় ভোট সঠিক হয়নি। পাতানো নির্বাচন হয়েছে। রাস্তায় কান পাতলে বুঝতে পারবেন মানুষ কী চায়। তাই এ ফল দিয়ে কোন দলের জনপ্রিয়তা মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। তবে নেতারা যে যাই বলুন, কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। প্রথম দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর এমন আলোচনা তুঙ্গে নেতাকর্মীদের মধ্যে। আর এ আলোচনার সূত্র কর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের নিজেই। ইউনিয়ন পরিষদের তফসিল ঘোষণার পর দলের এক প্রতিনিধি সম্মেলনে জিএম কাদের বলেছিলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে জাতীয় পার্টির জন্য টেস্ট পরীক্ষা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে আমরা সাধারণ নির্বাচন হিসেবে দেখতে চাই না। পার্টির অবস্থান কী, সামনে কিভাবে আমরা কাজ করব, তার পরীক্ষা হবে এ নির্বাচনে। জিএম কাদের বলেছিলেন, আমরা যদি এ নির্বাচনে ভাল ফল করি তাহলে মানুষ আমাদের সেভাবে মূল্যায়ন করবে, যা আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। এই টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ হবে সংসদ নির্বাচনের জন্য কতটা প্রস্তুত জাতীয় পার্টি। দলের নেতাকর্মীদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন জিএম কাদের। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দলের একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কোন ভিত্তি নেই। এ নিয়ে দিনের পর দিন কেন্দ্রীয় কোন কার্যক্রম নেই। ৭৬ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এখনও ত্রিশটির বেশি জেলায় কমিটি নেই বছরের পর বছর। উপজেলা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠনের অবস্থা খুবই নাজুক। প্রথম ধাপে ৭১১ ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ৪ নম্বর পেয়েছে জাতীয় পার্টি। কেউ কেউ আবার হাস্যরস করে বলেছেন, সংগঠন নেই। তাই এমন ফল অপ্রত্যাশিত নয়। তাদের এ কথার যুক্তি হচ্ছেÑ প্রথম ধাপের ৭১১ ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ১২৭টিতে প্রার্থী দিয়েছিল। যেখানে প্রার্থী দেয়াই সম্ভব হয়নি সেখানে ভাল ফলের আশা করা দুরাশার শামিল। জিএম কাদের বলেন, আমাদের প্রার্থীদের সঠিকভাবে প্রচার চালাতে দেয়া হয়নি। ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। পেশীশক্তি ও টাকা দিয়ে ভোট প্রভাবিত করা হয়েছে। অনেক এলাকায় ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মারা হয়েছে। এই ভোটে জনমতের প্রতিফলন হয়নি। তিনি বলেন, তবুও আমরা শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকতে চাই। এখন ফলের পর আপনার মূল্যায়ন কী? জবাবে জিএম কাদের বলেন, আমি টেস্ট পরীক্ষা বলেছি এ কথা সত্য। এখান থেকে মূল্যায়ন করে আগামীর কর্মপন্থা নির্ধারণ করব। পাস ফেল মূল্যায়ন করার বিষয় নয়। একের পর এক ফল বিপর্যয় ॥ সর্বশেষ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০ ভোট পেয়েছিল বিরোধী দলের তিন মেয়র প্রার্থী। এর আগে মাত্র একটি উপজেলাতে জয় পায় জাপার প্রার্থী। তখনও জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রংপুরের কোন উপজেলায় দলের প্রার্থীদের কেউ পাস করতে পারেননি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে রংপুরে শোচনীয় পরাজয় হয়েছে জাতীয় পার্টির। জেলার বদরগঞ্জ পৌসরভা নির্বাচনে উপজেলা ছাত্রসমাজের সভাপতি লাতিফুল খাবীর লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন। ফল অনুযায়ী জাপার এই প্রার্থী পেয়েছেন ১৭১ ভোট। জাতীয় পার্টির এমন ধরাশায়ীতে হতবাক স্থানীয় নেতারাও। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পৌরসভায় জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদ পান মাত্র ১৩৭ ভোট। ২৩৪ পৌরসভার মধ্যে শুধু কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে আবদুর রহমান মিয়া একমাত্র লাঙ্গল প্রতীকে মেয়রপদে বিজয়ী হন। তখন রহমান মিয়া বলেন, জাপা থেকে নির্বাচন করলেও পাস করেছি ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে। বিজয়ের জন্য দলের কোন ভূমিকা নেই। অথচ পৌর নির্বাচনে দল মনোনীত ৭৩ মেয়র প্রার্থীই শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিলেন। সেই নির্বাচনে গড়ে প্রায় ৭৪ ভাগ ভোট পড়লেও জাপা প্রার্থীরা বেশিরভাগ পৌরসভায় ৩-৫ ভাগ ভোট পান। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এসে ভোটের হার আরও নিচে নামে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এ প্রসঙ্গে বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়া কোন মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। কেউ বলছে আটটিতে বিজয়ী হয়েছি। কেউ বলছে চারটিতে। এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সাংবাদিকদের জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
×