ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৫ মার্চ ২০১৬

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ২৪ মার্চ, ১৯৭১। ভেস্তে যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমঝোতা বৈঠক। বাঙালী জাতি নিশ্চিত হয়, আলোচনা নয়, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই ছিনিয়ে আনতে হবে মহার্ঘ স্বাধীনতা। একাত্তরের এ দিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়- আমরা আর মুখ বুঝে সহ্য করব না। এবার আঘাত এলে হানা হবে পাল্টা আঘাত। সে লক্ষ্যে প্রতিটি বাঙালীকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। একাত্তরের এ দিনটিও ছিল আন্দোলনমুখর। দেশের সবকিছু চলছে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে। কিন্তু বাঙালী জাতি সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি আর কয়েক ঘণ্টার পর নেমে আসবে অমানিশার অন্ধকার। বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পরই গণহত্যার হুকুম দিয়ে বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করে পাকিস্তানে ফিরে যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধুও কয়েকদফা বৈঠক করেন দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে। আর রাতেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন আন্দোলনকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতে পাক হানাদাররা চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সেই রাতের আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বাঙালীরা। একাত্তরের অগ্নিঝরা এ দিনে বাঙালী জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংসতা। গণহত্যার নীলনকশা অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে ওঠে নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালী নিধনযজ্ঞে। এ রাতেই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে ভয়ঙ্কর মাত্র এক রাতেই হানাদাররা হত্যা করেছিল হাজার হাজার ঘুমন্ত বাঙালীকে। কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর রাতে বসে থাকেনি বীর বাঙালীরা। মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম সম্মুখসমরে পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রগুলো গর্জে উঠেছিল আজ থেকে ৪৬ বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞের পর পাক হানাদাররা আঘাত হানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ব্যারাক থেকে বাঙালী পুলিশ সদস্যরা তালাবন্ধ অস্ত্রাগার ভেঙ্গে হাতে তুলে নেন অস্ত্র ও গুলি। গড়ে তুলে সশস্ত্র প্রতিরোধ। দু’পক্ষের মধ্যে চলে প্রচ- গোলাগুলি। কিন্তু পাক বাহিনীর অত্যাধুনিক মেশিনগান, মর্টার ও হেলিকপ্টার গানশিপের প্রচ- আক্রমণে পুলিশ বাহিনী বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। সশস্ত্র প্রতিরোধে পাক হানাদারদের হামলায় দুজন ডিআইজিসহ অসংখ্য পুলিশ সদস্য শহীদ হন। রাতভর চলে লুটপাট। আর গ্রেফতার পুলিশ সদস্যদের ওপর চলে নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। পুড়িয়ে দেয়া হয় পুলিশের হেড কোয়ার্টার। এক রাতেই রাজারবাগ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। স্বাধীনতার ৪২ বছর ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের সেই শহীদদের বীরত্বগাথা আর স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে রাজারবাগেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। একটিমাত্র কক্ষের জাদুঘরটি গত তিন বছর ধরে একটু একটু করে সমৃদ্ধ হচ্ছে। প্রতিদিনই জাদুঘরের সংগ্রহশালা বড় হচ্ছে। পরিসর বাড়াতে এর জন্য নির্মিত হচ্ছে দোতলা ভবন। তবে তিন বছরেও জাদুঘরে স্থায়ী জনবল নিয়োগ হয়নি। এর জন্য বিঘিœত হচ্ছে জাদুঘরের দাফতরিক কাজ। কর্তৃপক্ষ বলছে, জাদুঘরের ভৌত পরিসর ও সংগ্রহশালা বাড়ানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্থায়ী জনবল নিয়োগের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজারবাগ আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ওয়ারলেস বা বেতারযন্ত্রের অপারেটর কনস্টেবল মোঃ শাহজাহান মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগে ইংরেজিতে পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের বার্তাটি দেশের সব থানায় পাঠিয়ে দেন। ২৫ মার্চ তিনি তাঁর বার্তায় বলেন, ‘বেইজ ফর অল স্টেশন অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন এ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি এটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ফ, ওভার।’ রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বেতারযন্ত্রটির মাধ্যমে সারা দেশে এই বার্তা প্রচার করেন। রাজারাবাগের জাদুঘরে সেই বেতারযন্ত্রটি স্থান পেয়েছে।
×