ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতি পরিবার বছরে এক হাজার টাকা প্রিমিয়াম পাবে ॥ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা

টাঙ্গাইলের ৩ থানায় এক লাখ পরিবার পাবে হেলথ কার্ড

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৫ মার্চ ২০১৬

টাঙ্গাইলের ৩ থানায় এক লাখ পরিবার পাবে হেলথ কার্ড

নিখিল মানখিন, কালিহাতি টাঙ্গাইল থেকে ॥ অবশেষে উদ্বোধন করা হয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর পাইলট প্রকল্প। বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানায় হেলথ কার্ড বিতরণের মাধ্যমে এই কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে মধুপুর, কালিহাতি ও ঘাটাইল থানায়। গত জানুয়ারি থেকে টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় স্বাস্থ্য কার্ড প্রদানের লক্ষ্যে রেজিস্ট্রেশন পরিচালিত হয়। রেজিস্ট্রেশন শেষে বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করা হয় হেলথ কার্ড বিতরণের। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনামূল্যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা দিতে এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রকল্প ধাপে ধাপে সারাদেশে সম্প্রসারণ করা হবে। বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানায় প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মন্জুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক, জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান ফারুক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোঃ নুরুল হক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক ওয়াহিদ হোসেন, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক আসাদুল ইসলামসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই মুক্তির সংগ্রাম বন্ধ হয়ে যায়। আজ স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আবার সেই মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের কোটি মানুষ চিকিৎসা সেবা পাবে। যেখানে আমেরিকার কোটি কোটি মানুষ ন্যুনতম চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয় সেখানে আমরা আবার এ কাজ শুরু করেছি। ওবামা অনেক আগেই এ কাজ শুরু করেছিলেন। এজন্য তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছেন। সেজন্য আমেরিকাতে এটাকে ওবামা হেলথ ইন্স্যুরেন্স বলা হয়। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার এই কর্মসূচী চলবে। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এই কর্মসূচী শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার তিনটি কারণে আবারও নির্বাচিত হবে। তিনটি কারণ হলো- ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া, কোটি মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়া এবং পদ্মাসেতু নির্মাণ। তিনি বলেন, আমরা ৫ বছর পর পর নির্বাচনে বিশ্বাসী। আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু তারা সাড়া দিলেন না। কিন্তু নির্বাচন বয়কট করে তারা জ্বালাও-পোড়াও করল। বাংলার জনগণ আগামী নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগকেই নির্বাচিত করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দরিদ্রবান্ধব সরকার। দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী গ্রহণসহ নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। ফলে গত কয়েক বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। তিনি বলেন, সরকার গরিব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে যেসব কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তার সুফল জনগণ পাচ্ছে। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অতি দরিদ্র মানুষ যেন জটিল রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করাতে পারে সেলক্ষে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানানো হয়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, মধুপুর ও কালিহাতিতে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে ওই তিন উপজেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা সুবিধা দিতে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ করা হবে। এই কার্ডধারী ব্যক্তির কয়েকটি নির্দিষ্ট জটিল রোগের চিকিৎসাসেবা পাবেন উপজেলা, জেলা পর্যায়ের সরকারী হাসপাতাল থেকে। পরিবার প্রতি একজন এই কার্ড পাবে। কার্ড পেয়েছেন কালিহাতি থানার দুর্গাপুর গ্রামের ওয়ারী বেগম (২৮)। স্বামী আব্দুল বাতেন দিনমজুর। চার সদস্যের সংসার। প্রায় সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। স্বামী আব্দুল বাতেন উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। হেলথ কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে ৫০ রোগ চিকিৎসা পাওয়া গেলে তাদের এই সমস্যা থাকবে না বলে জানান ওয়ারী বেগম। তিন সদস্যের সংসার জমিলা বেগমের (৪৫)। স্বামী মোজাফফর অনেক আগেই মারা গেছেন। হার্টসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কালিহাতির সাততিয়া গ্রামে তাদের বাড়ি। হেলথ কার্ড পেয়ে তারা খুব খুশি। অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, এ প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষ জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ৫০ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাবে। এই চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিবার প্রতিবছরে ১ হাজার টাকা প্রিমিয়াম হিসেবে প্রদান করবে সরকার। আর প্রতি পরিবার বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা লাভ করবে। এই কর্মসূচীর অধীনে নির্দিষ্ট সূচক ব্যবহার করে পাইলট এলাকায় দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী প্রায় ১ লাখ পরিবার চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব পরিবারকে একটি হেলথ কার্ড প্রদান করা হবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছে একটি বেসরকারী কোম্পানি। সচিবালয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উপস্থিতিতে ওই কোম্পানির সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, জটিল ও ব্যয়বহুল রোগের প্রাদুর্ভাব, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি নানা কারণে চিকিৎসা সেবার খরচ বেড়েছে। এতে নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষের আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নতুন এ উদ্যোগ। এছাড়া সর্বজনীন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য ‘হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্রাটেজি ২০১২-২০৩২’-এ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে সরকারের। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আরও জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পটি টাঙ্গাইল জেলার তিন উপজেলায় (কালিহাতী, মধুপুর, ঘাটাইল) পাইলট কার্যক্রম শুরু করবে। পরবর্তীতে পাইলট কার্যক্রম থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজের পরিধি বাড়াবে সরকার। পাইলট প্রকল্প চলাকালে এই প্রিমিয়ামের অর্থসহ প্রকল্পের যাবতীয় ব্যয় স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উন্নয়ন সেক্টরের উন্নয়ন কর্মসূচী হতে সংস্থান করা হবে। পরবর্তীতে সরকারী বরাদ্দ এবং সচ্ছল পরিবারের কাছে থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে কর্মসূচীর অর্থায়ন করা হবে। চিকিৎসা ব্যয়, দরিদ্র নির্বাচন, স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটি গবেষণা পরিচালনা করে পাইলটের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যমান রোগের ধরন বিশ্লেষণ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চিকিৎসাযোগ্য ৫০ রোগ চিকিৎসার একটি প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটি রোগ চিকিৎসার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ‘ ট্রিটমেন্ট প্রটোকল’ তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা প্রদানের জন্য পরিবারপ্রতি এই নির্ধারিত হারে অর্থ লাভ করবে। এই কর্মসূচী পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যানুয়ালসমূহ প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং এবং সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়েছে। কর্মসূচী বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে একটি সেল (এসএসকে সেল) গঠন করা হয়েছে। এস এস কে সেলকে সহায়তার জন্য এবং মাঠ পর্যায়ে এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি নির্বাচন করা হয়েছে। এই এজেন্সির মূল কাজ হলো চিহ্নিত দরিদ্র পরিবারগুলোকে নিবন্ধন, এসএস কার্ড ইস্যু করা, কার্ডধারী রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সাহায্য করা এবং চিকিৎসা পরবর্তী হাসপাতালের অর্থ পরিশোধে সহায়তা করা। ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি হিসেবে নির্বাচিত গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে রবিবার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই পাইলট প্রকল্পের সাফল্য কামনা করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সারাদেশে সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশে-বিদেশে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। জনবলবৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামোর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশের দরিদ্র মানুষের সেব প্রদানে সর্বদা তৎপর রয়েছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী’ নামে নতুন একটি প্রকল্প (পাইলট) যাচাই করতে যাচ্ছে সরকার। নানা প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে মধ্যআয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের এই গতি থামিয়ে রাখা যাবে না।
×