ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা চাই

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৫ মার্চ ২০১৬

২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা চাই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘গত শতাব্দীতে অনেক দেশেই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধের বিচার হয়নি। তদন্ত হয়নি। এখনও ক্ষতিগ্রস্তরা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ এক রাতে বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেই পৈশাচিক বর্বরতা যা গণহত্যার ইতিহাসে এক ভয়াবহতম ঘটনা। এই জঘন্যতম হত্যাকা-ের ইতিহাস, দলিল পত্র, ভিডিও বা ছবি দেখলে যে কেউ অপরাধীদের ধিক্কার জানাবে। মানুষ ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াবে বিশ্ব বিবেক। এর মধ্য দিয়ে আরও জোরালো হবে জেনোসাইডে যুক্ত পাকিস্তানী বাহিনীর বিচারের দাবি।’ এভাবেই আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের কাছ থেকে পঁচিশে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে চায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে সংগঠনটি। তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী সমর্থন আদায়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জানানো হবে। পুরো বিষয়টির নেপথ্যে কাজ করবে সামাজিক এই সংগঠনটি। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, দাবি আদায়ে আন্তর্জাতিক সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষাবিদ, লেখক, কবিসাহিত্যিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন। দাবির প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সমর্থন চায় সংগঠনটি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মিত্র দেশগুলোও তাদের প্রধান লক্ষ্য। যারা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল ও দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাশাপাশি যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে সে দেশগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ শুরু করেছে কমিটি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যেসব দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় তারা সহজেই জেনোসাইডের ভয়াবহতা বুঝতে পারবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পুরো বিষয়টি আসবে উপলব্ধিতে। এতে দুটো কাজ হবে এর একটি হলোÑ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ১৯৫ সেনা সদস্যের বিচারের পাশাপাশি মূল দাবি আদায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে পাকিস্তানী সেনা সদস্যের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘প্রতীকী বিচার’ করার ঘোষণা দিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন।’ চলতি সপ্তাহে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে সংগঠনটি। এতে সংগঠনের আহ্বায়ক শাজাহান খান বলেন, ‘পঁচিশে মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি আমরা দেশবাসীর কাছে উত্থাপন করছি। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আজকের সুসভ্য বিশ্ব সমাজ ও বিশ্ব মানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা দরকার।’ জাতিসংঘের বিধান অনুযায়ী প্রস্তাবটি কোন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আসতে হবে বিধায় জনগণের এই যৌক্তিক দাবির আলোকে গণহত্যার নির্মম শিকার বাঙালী ও বিশ্বের সকল হতভাগ্য মানুষের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের সরকারের কাছে এই প্রস্তাব তুলে ধরছি। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যাকেও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ারও প্রস্তাব করেন তিনি। পঁচিশে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি দাবি জানায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলন। যেভাবে দাবি আদায় হবে ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশে জনমত যথেষ্ট। তবুও হাল ছাড়তে রাজি নন সংগঠকরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে সকল স্তরের মানুষকে তাদের কর্মসূচীতে যুক্ত করবেন। তুলে ধরা হবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতার চিত্র। তাছাড়া প্রবাসে এ দাবি জোরালো করতে প্রবাসী বাঙালীদের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলা হবে। দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন দেশে ২৫ মার্চ কালরাতে জেনোসাইডের ইতিহাস তাদের কাছে তুলে ধরা হবে সবার কাছে। সেই সঙ্গে ভিডিও, ছবি, জার্নালের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে ঘটনার ভয়াবহতা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, মুক্তিযোদ্ধারাও এ বিষয়ে কথা বলবেন। এ ব্যাপারে সংগঠনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক আলামিন বাবু জনকণ্ঠ’কে বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা বিশ্বের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে দাবির পক্ষে রেজুলেশন সংগ্রহ করব। তিনি জানান, আমরা নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ে মাঠ তৈরি করে দেব। দেশের মানুষের পক্ষে সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাবে। আশা করি আমরা সফল হব। তিনি বলেন, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নানা মাধ্যমে ইতোমধ্যে যোগাযোগ হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সাংবাদিক, সরকারের বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দাবির সঙ্গে যুক্ত করে জেনোসাইড সম্পর্কে ধারণা দেয়া। ইয়েল ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক আছেন, যিনি জেনোসাইড নিয়ে অনেক বই লিখেছেন। আমরা এই লেখকের সহযোগিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইড তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে সেখানেও যোগাযোগ করার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টায় সব দেশ থেকেই দাবির প্রতি সমর্থন আসবে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবিটি আরও ত্বরান্বিত হবে বলেও মনে করেন তিনি। বাবু জানান, গোটা পৃথিবীতে পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা এখন নেই বললেই চলে। তাছাড়া তারা বাংলাদেশে জেনোসাইডের সঙ্গে যুক্ত এ বিষয়টি গোটা দুনিয়া জানে। এমন বাস্তবতায় পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবি প্রতিষ্ঠা আরও সহজ হবে। দাবি আদায়ে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন সংগঠনের এফএম শাহীন। তিনি জনকণ্ঠ’কে জানান, দাবির বিষয়টি তুলে ধরতে প্রবাসী বাঙালীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। সংগঠনের আন্তর্জাতিক ইউনিটে ১১ সদস্য ইতোমধ্যে কাজ করছেন। এর বাইরেও সহযোগিতায় আছেন অনেকেই। তিনি জানান, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক একটি দিবসের দাবি আদায় করতে হলে অনেক ধাপ পাড়ি দিতে হয়। প্রত্যেকটি ধাপেই আন্তর্জাতিক পরিম-লের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। কিভাবে, কাকে যুক্ত করলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানা গেছে, দাবি আদায়ে দেশব্যাপী কর্মসূচী ঘোষণা হবে। সম্ভাব্য কর্মসূচীসমূহের মধ্যে রয়েছে, দেশের সকল বধ্যভূমিগুলোতে সমাবেশ, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সেমিনারের আয়োজন করা হবে। গেল ১৭ জানুয়ারি দাবি আদায়ে দেশের সকল জেলায় শহীদ মিনারে সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল সংগঠনের পক্ষ থেকে। ৩৪টি জেলায় এ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। আজকের কর্মসূচী ॥ আজ ২৫ মার্চ জাতীয় জীবনের ভয়াল এই দিনটিতে দাবিটি বিশেষভাবে উত্থাপনের জন্য দিনব্যাপী কর্মসূচী নেয়ার কথা জানান সংগঠনের নেতারা। মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ের সামনে ফুটপাথে জাতীয় সংসদের সামনে সকাল ১০টা থেকে ’৭১-এর ভয়াবহ গণহত্যার আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হবে। বিকেল ৪টা থেকে হবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ ছাড়াও চারুশিল্পীদের অংশগ্রহণে চলবে গণহত্যা নিয়ে ক্যানভাসে চিত্রাঙ্কন। সন্ধ্যায় সহস্র মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিশ্বের গণহত্যার শিকার সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। একই সঙ্গে হাজার কণ্ঠে দাবি জানানো হবে ‘পঁচিশে মার্চ’কে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি চাই।’ এরপর চলবে গণহত্যার ওপর প্রামাণ্য ও চলচ্চিত্র। নেতৃবৃন্দ জানান, ‘আমাদের দাবি আমরা শুধু এ দেশের মানুষের মধ্যে সীমাবন্ধ রাখব না। প্রবাসী বাঙালী যারা আছেন, তাদের কাছেও এ দাবি পৌঁছে দিয়ে আমাদের আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাব। তারা বলেন, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকা-ই ছিল না। এটা ছিল বিশ্ব সভ্যতার জঘন্যতম হত্যাকা-ের সূচনা। এর পর নয় মাসে পাকিস্তানী হানাদাররা ৩০ লাখ নিরপরাধ নারী, পুরুষ শিশুকে জঘন্যভাবে হত্যা করে।
×